আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের সেবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন। বিভিন্ন অজুহাতে জানতে চাওয়া হচ্ছে গ্রাহকের বিস্তারিত তথ্য। হুবহু কাস্টমার কেয়ারের নম্বর থেকে ফোন আসায় গ্রাহকরাও সহজেই পা দিচ্ছেন অভিনব প্রতারণার ফাঁদে!
সেসব কাস্টমার কেয়ারের নম্বর স্পুফিং করে কৌশলে গ্রাহকের তথ্য জেনে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা কার্ডের সব অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। তবে নম্বর এক হলেও প্রতারকদের কলের ক্ষেত্রে সাধারণত নম্বরের আগে ‘প্লাস চিহ্ন’ থাকে বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
শনিবার (৬ জুন) রাজধানী এবং ফরিদপুরের ভাঙা এলাকা থেকে র্যাব-২ এবং র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে এ চক্রের ১৩ সদস্যকে আটক করা হয়েছে।
আটকরা হলেন- নাজমুল জমাদ্দার (১৯), হাসান মীর (১৮), ইব্রাহিম মীর (১৮), তৌহিদ হাওলাদার (২৩), মোহন শিকদার (৩০), পারভেজ মীর (১৮), সোহেল মোল্যা (২৬), দেলোয়ার হোসেন (৩৫), সৈয়দ হাওলাদার (২০), রাকিব হোসেন (২৪), মোহাম্মদ আলী মিয়া (২৬), পলাশ তালুকদার (৩৪), ইমন (২৫)।
এসময় তাদের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৪৬২ টাকা, ৩১টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ২টি ট্যাব, ১২০টি সিম, ১টি রাউটার এবং ১টি টিভি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
রোববার (৭ জুন) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যারের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।
তিনি বলেন, “করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মানুষের বাইরে যাওয়া এড়াতে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে প্রতারক চক্র। বেশকিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে এ চক্রের ১৩ সদস্যকে আটক করা হয়। তারা প্রত্যেকেই প্রাথমিকভাবে এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।”
আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, “একজন মাস্টারমাইন্ডের অধীনে ৩০-৩৫ জন সদস্য কাজ করে থাকেন। সাধারণত ৫টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে চক্রটি।”
প্রথম ধাপে চক্রের “হান্টার টিমের” সদস্যরা মাঠপর্যায়ে গ্রাহকদের তথ্য সরবরাহ করে থাকে। তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের নম্বর সংগ্রহ করে মাস্টারমাইন্ডদের সরবরাহ করে।
দ্বিতীয় ধাপে ‘স্পুফিং টিমের’ সদস্যরা কাস্টমার কেয়ার নম্বর কিংবা ব্যাংক কর্মকর্তার নম্বর ক্লোন করে। ফলে প্রতারকরা যখন গ্রাহকদের টার্গেট করে ফোন দেয়, তখন হুবহু সংশ্লিষ্ট নম্বরটি দেখতে পায়। এতে গ্রাহকরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যান। অনেক উচ্চশিক্ষিত গ্রাহকও এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন। প্রতিটি নম্বর স্পুফিং বা ক্লোন করতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পায় এ টিমের সদস্যরা।
তৃতীয় ধাপে সবচেয়ে প্রধান কাজটি করে থাকে ‘কাস্টমার কেয়ার’ টিমের সদস্যরা। তারা ১৫-২০ জন একসঙ্গে একটি রুমে বসে কথাবার্তা বলে একটি সত্যিকারের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের আবহ তৈরি করে। গ্রাহককে ফোন দিলে আশেপাশের নয়েজের মাধ্যমে তাকে বিভ্রান্ত করা হয়।
চক্রের মাস্টারমাইন্ড নিজেই দলটি পরিরিচালনা করেন। তারা কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তা সেজে কৌশলে গ্রাহকের কাছ থেকে গোপন পাসওয়ার্ড কিংবা ভেরিফিকেশন কোডসহ বিভিন্ন তথ্য জেনে নেন। সঙ্গে থাকা অন্য কেউ অ্যাপসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এজন্য তারা নির্জন কোনো চর বা গাছপালা ঘেরা নিরাপদ জায়গা বেছে নেয়।
চতুর্থ ধাপে ‘টাকা উত্তোলন’ টিমের সদস্যরা গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ ট্রান্সফারের পর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে নগদ টাকা উঠিয়ে নেয়। যেসব ব্যালেন্স উত্তোলন করা সম্ভব হয় না, সেসব দিয়ে বিভিন্ন কেনাকাটা করে নেয় তারা।
শেষ ধাপে ‘ওয়াচম্যান’ টিমের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে ছোটখাট দোকান চালানোর কাজে সম্পৃক্ত। তারা এলাকায় কোনো আগন্তুক কিংবা সন্দেহভাজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সন্দেহ হলে মাস্টারমাইন্ডকে খবর দেন। তারা ঘণ্টা বা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকেন।
প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দলের মাস্টারমাইন্ড নিজের জন্য ৫০ ভাগ, সহযোগীদের জন্য ৩০ ভাগ, হান্টার টিমকে ২০ ভাগ এবং স্পুফিং টিমকে নম্বর প্রতি এক-দেড় হাজার টাকা কিংবা কথা বলার সময়ের ভিত্তিতে টাকা দিয়ে থাকে। এছাড়া, লটারি জেতার কথা বলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল তারা।
আটকদের মধ্যে নয়জনই মাস্টারমাইন্ড উল্লেখ করে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আটক মোহন গত দুই মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করেছে বলে জানতে পেরেছি। একটি গ্রুপকে আমরা ধরতে পেরেছি। সারা দেশে এমন ৪-৫টি গ্রুপ সক্রিয় থাকতে পারে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
গ্রাহকদের নম্বর হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ চক্রের সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত কি-না খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, নম্বর স্পুফিং বা ক্লোন করায় গ্রাহকরা হুবহু সংশ্লিষ্ট নম্বর থেকেই ফোন পাবেন। ফোন করে অ্যাকাউন্ট বাতিল, স্থগিত বা সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে তথ্য, পিন বা ভেরিফিকেশন কোড জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে নেয়। কিন্তু প্রতারকদের স্পুফিং নম্বরের আগে সাধারণত ‘প্লাস চিহ্ন’ থাকে। উদাহরণস্বরূপ কোনো কাস্টমার কেয়ারের নম্বর যদি ‘১২২১’ হয়, তাহলে প্রতারকদের দেওয়া ফোন কলে নম্বর হবে ‘+১২২১’।
সূত্র : বাংলানিউজ২৪