রেজিনা আখতার ।।
রাতে খাবার টেবিলে গাইড ক্যারেন জানালো, আগামীকাল আমাদের জন্য রয়েছে এক বিশেষ সারপ্রাইজ। মুহূর্তেই সবাই আগ্রহী হয়ে উঠলাম, কী ধরনের সারপ্রাইজ! মেসিডোনিয়ার এলমেদিনাতো একের পর এক ক্লু দিতেই থাকলো। কিন্তু কোনটাই মিলছে না! নাছোড়বান্দা ক্যারেনও খোলাসা করে কিছু বলছে না। সবার চাপে পড়ে শুধু এটুকুই জানালো, আগামীকাল আমরা “রাজকীয় হাঁস” বা “রয়্যাল ডাক” দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে যাচ্ছি। রাজকীয় হাঁস দর্শনের জন্য হোয়াইট হাউস কনভেনশন্স হল থেকে নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট আগেই আমরা লিটলরক শহরের বিখ্যাত হোটেল পিবডিতে পৌঁছে যাই। ক্যারেন তো মহা পুলকিত! বারবারই বোঝাতে চাইছে, কী রাজকপাল নিয়ে যে আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি। রয়্যাল ডাকদের ক্যাটওয়াক দেখার মত বিরল সৌভাগ্য অর্জন করতে যাচ্ছি!
পাঁচতারকা হোটেল পিবডির বিশাল লবিতে প্রচুর লোকের সমাগম। সবার মধ্যেই অস্থিরতা, কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কখন দর্শন দেবেন রাজকীয় সেই হাঁসগণ! ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা নিয়ে সবাই প্রস্তুত, যেন উনারা এলেই ক্লিক ক্লিক ক্লিক ক্লিক। রাজকীয় হাঁসগণের নেতৃত্বে যিনি থাকবেন, তিনিও রাজকীয় পোশাকে প্রস্তুত। তার পরনের টকটকে লাল রঙের লম্বা ওভারকোটের সোনালি বোতামগুলো চকচক করছে। কুচকুচে কালো গামবুটও এমনভাবে পালিশ করা, যেন চেহারা দেখা যাবে! সোনালি পাত দিয়ে মোড়ানো ব্যাটনটি বগলদাবা করে তিনিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান বিশেষ অতিথিবৃন্দের জন্য।
লবির একপাশে ছোটখাট একটি চৌবাচ্চা, যেখানে রাজকীয় হাঁসগণ জলকেলি করবে বলে নির্ধারিত। একটি লিফটও প্রস্তুত, যাতে করে তারা সপ্তম তলা থেকে নিচে নেমে আসবেন। সেই লিফট আবার সাধারণ জনগণের জন্য নিষিদ্ধ। যে পথে তারা ক্যাটওয়াক করে যাবেন, তা-ও লালগালিচা দিয়ে মোড়ানো, রাজকীয় হাঁস বলে কথা! লিফটের পাশেই দণ্ডায়মান বিশেষ ব্যাচ পরিহিত মধ্যবয়সী ছয় জন নারী-পুরুষ। যারা বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে গদগদ ভাব নিয়ে অপেক্ষা করছেন বিশেষ অতিথিদের বরণ করে নেওয়ার জন্য। এই দায়িত্ব পেয়ে তাদের এমন একটা মনোভাব যেন- সার্থক জনম আমার, এ কাজের দায়িত্ব পেয়ে। হাঁস লালন-পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আজকে তাদেরকেও পুরস্কৃত এবং সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে।
হোটেলের লোকজন, দর্শনার্থীরা সবাই খুব ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনারা নেমে আসবেন। আমার সহকর্মীরাও দেখলাম মহা উৎসাহী। ডিজিটাল ক্যামেরা হাতে সবাই প্রস্তুত, এমন একটা ভাব যেন ক্ষণিক মুহূর্তও মিস করা যাবে না। পানির দেশের মানুষ আমি। নদী-নালা, খাল-বিল, হাটে-মাঠে-ঘাটে হাঁস দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এতসব দক্ষযজ্ঞ দেখে আমার ভেতরেও এক ধরনের কৌতূহল কাজ করতে লাগল। রাজকীয় হাঁসদের নিয়ে নানা রকম কল্পনার ডানা মেলতে মেলতে আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম! না জানি কী দেখবো!
এ পর্যায়ে ক্যারেনকে দেখলাম হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে আসছে। আহা! বেচারি ভারি শরীর নিয়ে হাঁটতেই যার কষ্ট হয়, সে কি-না আসছে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে! এসে আবারো জানালো, ভাগ্যদেবী আমাদের প্রতি আসলেই সহায়। কারণ মার্কিন সরকারের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমরা রাজকীয় হাঁসদের প্রাতঃরাশ দেখার বিরল সুযোগ পেতে যাচ্ছি। যা কি-না আজ পর্যন্ত কোন দর্শনার্থী পাননি। কপাল বটে আমাদের!
সবাই মিলে ক্যারেনকে আবারো ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। মার্কিন মুলুকে এসে এই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার রীতিটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছি। আমার দলের সবাই তো উত্তেজনার চরমে আছেন। তাদের এমন একটা ভাব, যেন গিয়ে দেখবে রাজকীয় হাঁসগণ টেবিল-চেয়ারে বসে কাঁটা চামচ-ছুরি দিয়ে প্রাতঃরাশ পর্ব সারতে ব্যস্ত। আমি আছি মহা ফাঁপড়ে। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে চিরচেনা রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বালিহাঁস ইত্যাদি।
যা হোক, ক্যারেনের সাথে আমরা নির্ধারিত স্থানে গিয়ে পৌঁছলাম। বেশ বড়সড় একটি রুমের অর্ধেক দেয়াল এবং বাকি অর্ধেক গ্রিল দিয়ে ঘেরা। দু’জন হোটেল কর্মী মহা যতনে হাঁসগণকে খাওয়াতে ব্যস্ত।আমার ভিনদেশি সতীর্থদের ক্রমাগত শাটারের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম, ওরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাজকীয় হাঁস দর্শন করে তো আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। হায় হায়, এ কী দেখছি! এযে অতিচেনা পাতিহাঁস। দু’জন হোটেল কর্মী পরম যতনে পাঁচটি পাতিহাঁসকে খাওয়াতে ব্যস্ত। হাঁসগণ তাদের সহজাত ভঙ্গিতেই খেয়ে যাচ্ছে, রাজকীয় কোন ব্যাপার-স্যাপার আমি দেখতে পেলাম না। তারপরও আশায় আছি শেষমুহূর্তে হয়তো কোন ভেলকি আছে।
ক্যারেনের তাড়ায় আবার লবিতে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত লিফটে চড়ে উনারা নেমে এলেন নিচে। সেই ছয় জন বিশেষ ব্যক্তিত্ব সসম্মানে তাদের বরণ করে নিলেন। হাঁসগণ সেই বিশেষ সম্মান কতটুকু বুঝতে পারল কে জানে? তারা তাদের সহজাত ভঙ্গিতে “প্যাক প্যাক” করতে করতে হেলেদুলে এগিয়ে চললো লালগালিচা মাড়িয়ে, নেতৃত্বে আছেন সেই লাল ওভারকোটওয়ালা। একপর্যায়ে হাঁসগণ সেই সুইমিং পুলের পানিতে ঝপাং ঝপাং করে লাফিয়ে যথারীতি সাঁতার কাটতে লাগল।
দর্শনার্থীদের মুহুর্মুহু হাততালিতে বুঝতে পারলাম, রাজকীয় হাঁসগণের ক্যাটওয়াক এবং সাঁতারে তারা মুগ্ধ। আর আমার কাছে শুধুই মনে হচ্ছিল, বাংলার চিরচেনা পাতিহাঁস আমেরিকায় পাচ্ছে “রয়্যাল ডাক”র সম্মান! শুধু এই “রয়্যাল ডাক ক্যাটওয়াক শো”র জন্য এই পিবডি হোটেল প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করার পাশাপাশি এর রয়েছে আলাদা মর্যাদা ও চাহিদা।
লেখক : হেড অব লাইব্রেরি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।
সূত্র : জাগোনিউজ২৪