শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।
হাওরপাড়ের সংস্কৃতি যা আজ আমরা হারিয়েছি। ভুলে গেছি অতীতের অনেক কিছুই। আর এ অতীতকে সবার মাঝে তুলে ধরার জন্যই আমার এ ক্ষুদ্র চেষ্টা। আর এ চেষ্টার ফল নিজের মাঝে লুকিয়ে না রেখে মেলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম “চৈতালী ভাঙ্গন খেলার” কথা। কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ শতবর্ষী নারীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ২য় পর্বে যে “চৈতালী ভাঙ্গন খেলার” কথা তুলে ধরেছি তা আজ থেকে প্রায় ৪০০ (চারশত) বছর আগে খেলত বলে জানিয়েছেন। ছেলেরা ঘর ভাংগার ফলে মারামারিও হতো বলে জানা যায়। তাই দিনকে দিন এ খেলা বন্ধ হয়ে পড়ে।
নিকলী উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের শতবর্ষী নারী মারাজি বেগম (১০২) জানালেন, “হজরের আজানের হরে উইঠা, গোবর আইন্না, ফুল আইন্না, দূর্বা আইন্না, তার হরে ধান-দূর্বা দে গর বানাইতাম। গর টারে গুবর দে লেপতাম আর গীত গাইতাম।”
এ খেলা চৈত্র মাসের প্রথম ১৩ দিনের মধ্যে যে কোনো একদিন খেলা করলেই চলত। তবে পাড়াভিত্তিক এ খেলার পার পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায় বলে জানা যায়। মারাজি বেগমের সময় খেলাকে সংক্ষিপ্ত করে আনা হয়েছিল।
চৈতালী ভাঙ্গন খেলা চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকে ১৩তম দিনের মধ্যে যে কোন এক ভোরবেলায় শুরু হয়। প্রায় ২৫-৩০ জন অংশগ্রহণ করে এ খেলায়। ঘরে ঘরে গিয়ে চাল মাগা হয় এবং তা দিয়ে এক প্রকার সিন্নি রান্না করা হয়। দিন শেষে সবাই এক সাথে নদীতে গোসল করে ছোট-বড় সবাই এ সিন্নি খায় এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। নদীতে দলবেঁধে মেয়েরা যখন যায় সবাই এক সাথে গাইতে থাকে :
” চৈত্র মায়া চৈতালী বান্দি,
মেঘের লাইগ্গা কান্দি।
হাটও যায়, ঘাটও যায়,
চৈত্র মায়া চৈতালী বান্দি”।
“এই গীত গাওয়ার ফরে ঘাটে গিয়া গোসল করছি” বললেন মারাজি বেগম।
চি/ মাইট্টা বউ চি/ বউ চোর
হাওরপাড়ের ছেলেমেয়েরা ঋতুভেদে খেলাধুলা করে থাকে। মেয়েদের কুত কুত খেলা থেকে শুরু করে বৌ চি, কানামাছি, গাউচ্ছা খেলা, কট খেলা (ছোট ৫টি পাথরের টুকরা দিয়ে খেলা) ইত্যাদি খেলা খেলে থাকে। এ ধরনের খেলায় দু’টি দল অংশ নেয়। দম ধরে কোনো একটা ছন্দের মধ্যে খেলে।
বৌ চি খেলার মধ্যে একদল বৌ পাহারা দিবে অন্য দল তা চিয়ের মাধ্যমে চুরি করে নিয়ে যাবে। এ চিয়ের শ্বাস থাকাকালীন প্রতিপক্ষ ধরতে পারলে সে হবে পচা এবং সে খেলা থেকে প্রথম রাউন্ডে বাদ। আবার বৌ চুরি করে নেওয়ার সময় প্রতিপক্ষ তাকে ছুঁয়ে দিলে বিপক্ষের সবাই পচা তথা তারা খেলায় হেরে গেছে।
এ খেলার চি’গুলো হতো ধারাবাহিকভাবে। খেলার প্রথম চি দিত এমন :
পইলা চি সেলামালী
গোল্লা ভরি আলি আলি
চি কুত কুত কুতানি
লাইলী আমার মামানী
মজনু আমার ভাই
পইলা চি খেলায়
পইলা চি সেলামালী
গোল্লা ভরি আলি আলি।।
মজার ব্যাপার হলো, মোট সাতটি চি দিয়ে বউ চুরি করতে হতো।
দ্বিতীয়জন যখন চি দিত, এ দলে সবচেয়ে যে সেরা সে-ই চি দিত। এ সময় তাদের প্রতিপক্ষ চি-দাতাকে বিভিন্ন শব্দে উস্কানি দিত। যেমন :
কলা গাছের ডাগ্গো
বেডা অইলে আগ্গো।
এখানে বৌ-এর নাম রাখা হতো। আর এ নাম ধরেই চি দিত। তবে অঞ্চলভেদে এ চি’র পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমনঃ
চি কুত কুত
কুদে মালা
কম্পানিটা জারইতলা
দশটার গাড়ি যা গা
রেখা নারে নেগা।
এ খেলায় দেখা যায়, বিপক্ষ দল যখন বৌ চুরি করতে পারে না বা প্রতিপক্ষের কাউকে ছুঁতে পারে না তখন নিম্নে ছন্দটি বলে থাকে :
ধরছি চি ছাড়তামনা
না মাইরা যাইতামনা।
এমন আরো কিছু হাওরপাড়ের বৌ চি খেলার ছন্দ উল্লেখ করছি :
১। আমি গেছলাম সাজনপুর
দেইখ্যা আইছি দুই চুর
দুই চুরে বাড়া বান্ধে ধাপ্পুর ধুপ্পুর।
২। ও বেডি তর টুনাত কি? নাইল্লার আলি।
যাইবা কই? মদনখালি।
তোমার কান্দঅ কি? দু’তারা,
বাজাওছেন্। প্যাঁ পুঁ।
৩। ছুডুমুডু বাতারি ঠারে কথা কয়
কাইজ্যা লাগাইয়া বাতারি
চাঙ্গঅ উইট্যা বয়।
৪। বাজিতপুইরা বাই
ফতে ফাইলে টানাটানি
বাড়িত গেলে নাই।
৫। দাদাগো দাদা খাদা কিন্যা দাও
খাদার তলে গঁতা ব্যাঙ ফালাইয়া দাও।
একলা ঘরঅ থাকতামনা, বউ আইন্যা দেও।
বউ জবর কালা, নাক কাইট্যা ফালা
বউয়ের নাহ ক্যারে লউ?
সাত দাদার বউ।
৬। চি মারলাম চিকর গোটা
আত্তি মারলাম মোটা মোটা
বঁইশ মারলাম লাফে,
তেরুয়াল কাঁফে।
(এ ছড়াগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে আমার মায়ের কাছ থেকে)
সংগ্রহ সূত্র : নিকলী উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের “মারাজি বেগম” এবং আমার মা মোছাঃ জুমেনা খাতুন, জারইতলা।
সহযোগিতায় : কারার বদরুল মোমেন হিমেল, রাজিকা আক্তার লাকি, মোঃ জুনায়েদ হাসান রাজু, আবু সাইদ।