এলাকাবাসী ও পুলিশের সামনে ছেলের হাতে পিতা খুন

বিশেষ সংবাদদাতা ।।
একমাত্র সন্তান হওয়ায় ছেলের কোনো চাহিদাই অপূর্ণ রাখেননি বাবা। অনার্স-মাস্টার্স পাস করিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাবার সার্বিক সহযোগিতায় ছেলে পায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি। বিস্তর সহায় সম্পত্তির মালিক বাবা তাকে ধুমধামের সাথে বিয়েও করান। শেষ পর্যন্ত সেই বাবাকে সন্তানের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে গত বুধবার এ ঘটনা ঘটে। নিহত বাবার নাম এমদাদুল হক মানিক (৬৫)। ছেলে আনোয়ারুল কবীর জন (৩৮)। বাবাকে ঘরে প্রায় চার ঘণ্টা আটকে রেখে এলাকাবাসী ও পুলিশের সামনেই রড দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে সে। ছেলের হাত থেকে বাঁচতে বাবা বারবার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও রক্ষা পাননি। বুধবারের নির্মম ঘটনাটির ভিডিওচিত্র এখন কটিয়াদীর মানুষের হাতে হাতে। এতে দেখা যায়, বসতঘরের মূলগেটে তালা লাগিয়ে ছেলে জন রড দিয়ে পিটাচ্ছে বাবাকে। স্থানীয় লোকজন অনুরোধ করছে বাবাকে না মারতে। কিন্তু সে কিছুতেই শুনছে না এ কথা। একটু বিরতি দিয়ে এভাবে চলে অন্তত তিন-চার ঘণ্টা নির্যাতন। পরে অবশ্য পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙে মুমূর্ষু মুক্তিযোদ্ধা মানিককে উদ্ধার করলেও মৃত্যু হয় তার। পুলিশের অভিযোগ, তাদের দেরি করে খবর দেয়া হয়েছিল। সময়মতো খবর দিলে হয়তো জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হতো মুক্তিযোদ্ধাকে।
সরেজমিন কটিয়াদীর পশ্চিমপাড়া গ্রামে এমদাদুল কবির মানিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, যে ঘরে আটকে বাবাকে নির্মমভাবে রড দিয়ে হত্যা করে তারই ছেলে, সেই ঘরটি এক নজর দেখতে দলে দলে লোকজন ভিড় করছেন। ওই ঘরটি বর্তমানে পুলিশ তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, জনের বাবার সংসারে অভাব অনটন ছিল না কোনো দিনই। এলাকায় তিনি একজন প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তারপরও শিক্ষিত ছেলেকে বাড়তি রোজগারের জন্য কয়েক বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিও পাইয়ে দেন। এত কিছুর পরও আনোয়ারুল কবির জন (৩৫) মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। শেষে ইয়াবা হেরোইনসহ নানা রকম মাদকে জড়িয়ে পড়লে শিক্ষকতা পেশা আর করতে পারেনি।। সম্প্রতি সে বেপরোয়া আচরণ করতে থাকে। মাদক সেবন করতে গিয়ে প্রতিদিন তার অনেক টাকা খরচ হতো। টাকার জন্য মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের ওপর চলত নিয়মিত অত্যাচার। ছেলের অত্যাচার সইতে না পেরে কিছু দিন আগে বাবার বাড়ি চলে যান মা শামসুন্নাহার হেনা। তিন কন্যাসন্তানের জনক জন সম্প্রতি তার স্ত্রী কবিতাকেও পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার ভোরে বাড়ি খালি পেয়ে বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জন।
স্থানীয়দের মতে, অতি আদর পেয়ে ছেলেটি বখে যায়। মৃত্যুর আগেও পুলিশ ও আত্মীয়স্বজনকে মুক্তিযোদ্ধা মীর এমদাদুল কবির মানিক বলেছেন তার ছেলেকে যেন মারধর করা না হয়। মাদকাসক্ত ছেলে আনোয়ারুল কবির জনের অত্যাচারে গুরুতর আহত হলেও মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছেলের মঙ্গল চেয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছেন জনের মামা মুসা মারুয়া।
কটিয়াদীতে বুধবার ঘটে যাওয়া এ ঘটনা এলাকাবাসী বিশ্বাসই করতে চান না। তাদের প্রশ্ন, কী করে একজন শিক্ষিত ছেলে সবার সামনে বাবাকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে! এ ঘটনায় পুলিশেরও চরম ব্যর্থতা আছে বলেও মনে করছেন এলাকাবাসী। পুলিশ ঘটনাস্থলে দুই-তিন ঘণ্টা উপস্থিত থেকেও মুক্তিযোদ্ধা মানিককে জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি। এটি তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুবিনয় সাহা ও বিজয় স্যানাল বলেন, মীর এমদাদুল হকের ছেলে জন মঙ্গলবার রাতে তাদের বাড়িসহ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে মাদকাসক্ত হয়ে তাণ্ডব চালায়। এ সময় তার হাতে দা ছিল। তারা (হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন) তার হাতে-পায়ে ধরে মাফ চাইলে সে নিবৃত্ত হয়। পরের দিন ভোরে ঘরে তালা দিয়ে বাবাকে আটকিয়ে এ ঘটনা ঘটায়।
তবে পরিবারের লোকজন জানান, বাবাকে জিম্মি করার খবর পেয়ে সাথে সাথেই পুলিশের লোকজন আসে। পুলিশ আসার পরে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়। তারা বলেন, কিশোরগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে খবর দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশীদের দাবি, পুলিশ আন্তরিক থাকলে এমদাদুল হক মানিককে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হতো।
জনের মামা মুসা মারুয়া বলেন, পুলিশ প্রায় তিন-চার ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। তাদের আরো আন্তরিক হওয়া উচিত ছিল। মারুয়া জানান, একবার অবশ্য পেছনের দরজা ভেঙে কয়েকজন পুলিশ, পরিবারের কয়েকজন ও এলাকাবাসী ঘরের ভেতরে ঢুকেছিল। তখন পুলিশের ওপর চড়াও হয় জন। এতে একজন উপপরিদর্শক গুরুতর আহত হন। তার সাথে আরো দু’জন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে পুলিশ ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওই সময় কিছু একটা করা গেলে ভগ্নিপতিকে হয়তো বাঁচানো যেত। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, প্রথম দিকে পুলিশ ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, ওই সময় কটিয়াদীর ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউ মানিককে দ্রুত উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
কটিয়াদীর ব্যবসায়ী মাওলানা সাঈদ আহমেদ বলেন, সন্তানদের আদরের পাশাপাশি শাসন না করার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।
শুক্রবার সকালে জনের বাড়িতে গিয়ে শামসুন্নাহার হেনা গুরুতর অসুস্থ বলে জানা যায়। ফলে তার সাথে কথা বলা যায়নি। স্ত্রী কবিতার দেখা পাওয়া গেলেও তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা মানিককে লোহাজোড়া গ্রামের বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।
কটিয়াদী থানার ওসি আবদুস সালাম পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা এমনিতেই দেরি করে পুলিশকে খবর দেন। তাছাড়া পুলিশও ঝুঁকি নিয়ে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছে। তিনি জানান, এ ঘটনায় জনের মামা গোলাম সারওয়ার মারুয়া বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। তা ছাড়া জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ছেলের রডের আঘাতে মানিকের দুই পা, মাথা, ঘারসহ পুরো শরীর থেঁতলে যায়।

Similar Posts

error: Content is protected !!