শাহ মোঃ আহসান উল্লাহ ।।
কোথাও চলিয়া যাব একদিন তারপর রাত্রির আকাশে
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি।
কবির এই আশঙ্কা যেদিন কিশোরগঞ্জ জেলার তথা ভাটি এলাকার শিক্ষাদানের কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ, কৃতি শিক্ষক, শিক্ষকের শিক্ষক, অনেক কৃতি মানুষের শিক্ষক, সকল স্তরের মানুষের অতি শ্রদ্ধেয় এবং আপনজন আবদুল হামিদ স্যারের বেলায়ও যখন সত্য হলো, একঝাঁক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে উঠল।
আমি তখন মনোহরদী থানার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাতিরদিয়া এস এ মডেল হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র। প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আফসার উদ্দিন স্যার খুবই খ্যাতিমান এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয়। একদিন ইংরেজি ক্লাসে প্রসঙ্গক্রমে হাওর অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কেউ নিকলী চিনি কিনা। একমাত্র আমি ছাড়া আর কোন ছাত্রছাত্রী নিকলীর নামও জানে না। স্যার বললেন, “তোমরা নিকলীর নামও জান না! কিশোরগঞ্জের পূর্বাঞ্চলের হাওরে অবস্থিত নিকলীর কৃতি সন্তান, গুরুদয়াল কলেজে পড়াকালীন আমার বন্ধু আবদুল হামিদ সম্পর্কে তোমরা তো কিছুই জান না”। স্যারের এই বক্তব্যের পর চার/পাঁচজন ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে গেল। তারা তাদের অভিভাবকদের কাছে হাওরের আবদুল হামিদ স্যারের নাম শুনেছে। পূর্ব থেকে শিক্ষা-দিক্ষায় অগ্রসর এই অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের আবদুল হামিদ স্যারের উদাহরণ টেনে উপদেশ দিতেন।
আমি পার্শ্ববর্তী উপজেলার মানুষ। ছোটবেলায় দেখতাম আমার বাপ-চাচা এবং করিমগঞ্জ উপজেলার সকল স্তরের মানুষ আবদুল হামিদ নামটি গভীর শ্রদ্ধা, সম্মান এবং ভক্তির সাথে উচ্চারণ করতেন।
চারণের মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নেয়ার অভ্যাস, শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালবাসা, শ্রেণিকক্ষে অসাধারণ পাঠদান, নিকলী গোরাচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত সুপারভিশন, সুচিন্তিত মনিটরিং এবং আন্তরিকতার জন্য তিনি এলাকায় শিক্ষার কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
নিকলীর মতো হাওরের জল বিধৌত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের বিস্ময়কর এবং অবিস্মরণীয় প্রতিভার জন্ম হওয়া সত্যিই উপাখ্যানের মতো।
নিকলী উপজেলায় এক সময় একটিমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে, জনসচেতনতার কারণে ধীরে ধীরে আরো মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ খ্রি. নিকলীর প্রত্যন্ত অনগ্রসর দুর্গম এলাকা আলিয়াপাড়া গ্রামে এ.বি. নূরজাহান হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে অন্যদের সাথে আমিও একমত হলাম, নতুন এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করবেন একজন শিক্ষাবিদ। আবদুল হামিদ স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি আনন্দের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। স্যারের নাম শুনে এলাকার এবং আশপাশের এলাকার শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হাজারো মানুষের ঢল নামলো অনুষ্ঠানে। স্যার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করলেন। অনুষ্ঠান শেষে পরিদর্শন বইয়ে মন্তব্য লিখলেন। আমাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দানের জন্য ম্যানেজিং কমিটিকে ধন্যবাদ জানালেন।
স্যার যতদিন সুস্থ ছিলেন, আমি একজন অনভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর মূল্যবান পরামর্শ নিয়েছি। তাঁর পরামর্শে এবং আমাদের পরিশ্রমে এই বিদ্যালয়টি তাঁর জীবনদ্দশাতেই নিকলী উপজেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
একটি খণ্ড স্মৃতি এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি তখন গচিহাটা কলেজের ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আমি কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলী আসার পথে গচিহাটা রাস্তার মোড়ে স্যারের সাথে দেখা। স্যার যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “চল আমরা কথা বলতে বলতে পায়ে হেঁটে নিকলী চলে যাই।” রাজি হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো একটি চলমান পাঠাগারের সাথে আমি চলছি। জ্ঞানগর্ভ কতাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তিনি দু’-একটি কবর জিয়ারত করলেন এবং আমাকে নিয়ে মোনাজাত করলেন। সেদিনের সেই চলমান শ্রেণিকক্ষে বিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত কোন বিষয়টি স্যার বাদ দিয়েছিলেন আমি ভেবে পাই না। উন্নয়ন পরিকল্পনা, কৌশল, অগ্রগতি, সিদ্ধান্ত, কৃতিত্ব, প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য, নেতৃত্ব, সম্পদের ব্যবহার, বিদ্যালয়ের ঝুঁকি, সম্পদের ব্যবহার, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষা পদ্ধতি মূল্যায়ন, Assessment strategies, Teaching Learning Techniques, Learning task, Equal Probability hypothesis, Correlation, systematic random sampling সহ সবই ছিল। মনে মনে ভাবলাম সরকারি বাধ্যবাধকতার কারণে আমরা বি.এড এবং এম.এড করতে ঢাকা, মায়মনসিংহে যাই। স্যার তো চলমান বি.এড, এম.এড প্রতিষ্ঠান।
স্যার যখন নিকলী গোরাচাঁদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, নিকলীতে এলে তাঁর ব্যক্তিত্বের ভয়ে কাছে বেশি যাওয়া হতো না। ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে জেলার এবং জেলার বাইরের নামকরা অনেক শিক্ষকমণ্ডলী বিদ্যালয়টিতে কর্মরত ছিলেন।
শেষ আক্ষেপ : নিকলী পোস্ট অফিসের সামনে হঠাৎ একদিন স্যারের সাথে দেখা। আমাকে নির্দেশ দিলেন, “আগামী রোববার সকাল ১০টায় আমার বাসায় দেখা করবে”। কিন্তু বাড়িতে জরুরি কাজ থাকায় স্যারের এই নির্দেশ পালন করতে পারিনি। এরপরও তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে, তিনি তখন বাকরুদ্ধ এবং অসুস্থ।
আমার চলার পথে স্যারকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু আজ উপলব্ধি করি, তাঁর মতো হতে পারিনি। কারণ তাঁর মতো জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মনন, মানসিকতা কোনটিই আমার নেই।
স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : এ.বি. নূরজাহান হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক।
[লেখাটি ২০১৬ সালে প্রকাশের জন্য উদ্যোগ নেয়া “আবদুল হামিদ স্যার”-এর ওপর স্মারকগ্রন্থ উপলক্ষে লেখা হয়েছিলো। অনিবার্য কারণবশত স্মারকগ্রন্থটি তখন প্রকাশ করা যায়নি। ২০১৮ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহ মোঃ আহসান উল্লাহও মৃত্যুবরণ করেন]