শেকড়ের সংস্কৃতির অনুসন্ধান : পর্ব-ধামের গান

মামুন আহমেদ ।।

ধামের গান
“শুনেক শুনেক প্রানের ঝিলিক শুন মোর কথা
শিষ্যের বাড়ি যজমানে মুই চাহাচু যাবা।”

উপরোক্ত প্রবচনটি ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের টাঙ্গন নদীর অববাহিকায় লোকসংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ ধামের গানের। ধামের গান আদতে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের স্থানীয় লোকনাট্যের একটি ধারা। এ লোকনাট্য ধারাটি উক্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনে সকল ধর্মের সকল বয়সের সাধারণ মানুষের বিনোদনের এক নির্মল উৎস।

ধামের গানের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছে এ সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হচ্ছে কয়েকশত বছর আগে থেকে এই এলাকার মানুষ ধামের গান উদযাপন করে আসছে। ধাম শব্দের অর্থ স্থান বা আশ্রয়স্থল। শব্দটি ধর্মীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য স্বীকৃত সমবেত হওয়ার জায়গাকে বোঝায়। এমন স্থানে কথোপকথন ও গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত লোকজ নাট্যকেই “ধামের গান” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; যা বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের লোকনাট্যের একটি বিশেষ প্রকরণ। এই ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য ধারার আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। ধান মাড়াইয়ের সাথে মিল থাকার কারণে কোথাও কোথাও এর নাম মারাঘুরা গান, পালা করে গাওয়া হয় বলে পালাটিয়া গান, কালীপূজার (হোলি) সময় অনুষ্ঠিত হয় বলে হুলিগান, লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে আয়োজন করা হলে লক্ষ্মীর ধামের গান নামেও অভিহিত করা হয়। গানের সংলাপ হয় সংক্ষিপ্ত আর ভাষা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক। সংলাপ গদ্যেও হয়, আবার গানেও হয়। গানের আধিক্যের কারণেই এর নামের শেষে গান যুক্ত করা হয়েছে।

ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে এর আয়োজন করা হলেও দৈনন্দিন জীবন যাপনের নানা উপকরণ নিয়েই এর গল্প ও গান তৈরি হয়। প্রান্তিক কিংবা সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সাংসারিক জটিলতা, প্রেম, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলা, দুশ্চরিত্রের লাম্পট্য সহ যাবতীয় বিষয়াদি অত্যন্ত সরল সহজভাবে উঠে আসে এসব গানে। জটিল বিষয়গুলোকেও হাস্যরসের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে তোলা হয় অভিনয়ের মাধ্যমে। গুণী শিল্পীরা ব্যঙ্গাত্মকভাবে সমাজের নানা বৈষম্য অন্যায় অসঙ্গতিও তুলে ধরেন। অর্থাৎ গ্রামীণ জীবনের সরল প্রবহমান ধারায় ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা সমাজের নানা তির্যক প্রপঞ্চই ধামের গানে বিষয়বস্তু।

মঞ্চ
ধামের গানের মঞ্চটি এরিনা মঞ্চ অর্থাৎ চারদিক খোলা মঞ্চ। দর্শকেরা এই মঞ্চের চারদিকে বসে পরিবেশনা উপভোগ করে। মূলত ধামের গানের মঞ্চটি মাটি দিয়ে ঢিবি আকারে চারকোণাভাবে নির্মাণ করা হয়। এর পরিমাপ সাধারণত ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৫ ফুট প্রস্থ; অর্থাৎ বর্গক্ষেত্র আকারের হয়ে থাকে। ভূমি থেকে মঞ্চটির পাটাতন পর্যন্ত উচ্চতা দুই থেকে আড়াই ফুট হয়ে থাকে। মঞ্চের চারদিকে সুতলি বা রশি দিয়ে একটি বা দুইটি লাইন টেনে ঘিরে দেওয়া হয়। এছাড়া মঞ্চের চারদিকে বাঁশের বেড়া দিয়েও ঘিরে দেওয়া হয়ে থাকে। মঞ্চের যে কোন এক কোণে কলাকুশলী ও অভিনয় শিল্পীদের যাতায়াতের জন্য ৩ থেকে ৪ ফুট পরিমাণ প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য খোলা রাস্তা রাখা হয়। দর্শকদের আসন বলতে তেমন কিছুই থাকে না। দর্শকরা বেশিরভাগ সময় মাটিতে কাপড় বিছিয়ে, গাছের পাতা ছড়িয়ে, চটের বস্তা বিছিয়ে, কাঠের টুল পেতে পরিবেশনা উপভোগ করেন। মহিলাদের জন্য আলাদা বসার সারি থাকে। মঞ্চের প্রবেশ ও প্রস্থানের প্রায় ১০ থেকে ১২ ফুট দূরে অস্থায়ীভাবে বাঁশের ঘেরা দিয়ে সাজঘর (গ্রিনরুম) তৈরি করা হয়। এই সাজঘর থেকে অভিনয়শিল্পীরা রূপসজ্জা এবং অঙ্গসজ্জা গ্রহণ করে সরাসরি অভিনয়ের জন্য মঞ্চে যান এবং দৃশ্য অনুযায়ী অভিনয় শেষে ফিরে আসেন।

রূপসজ্জা ও অঙ্গসজ্জা

ধামের গানে উপস্থাপিত কাহিনীর আলোকে চরিত্র বিশেষে রূপসজ্জা ও অঙ্গসজ্জার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রূপসজ্জায় সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে শিল্পীরা প্রথমে মুখমণ্ডল ও গলার দৃশ্যমান অংশে সাদা প্রলেপ ব্যবহার করে। এই প্রলেপটি সপেদা (আঞ্চলিক উচ্চারণ), সিঁদুর, পিউরি এবং নারকেল তেল অথবা পানির মিশ্রণে তৈরি করা হয়ে থাকে। চরিত্র অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে রূপসজ্জা গ্রহণ করা হয়।

This image has an empty alt attribute; its file name is dhamer-gaan-saaj.jpg

পরিবেশনা রীতি
ধামের গানের পরিবেশনা রীতি চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকনাট্যের অনুরূপ। পরিবেশনার শুরুতে দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য বেশ কিছুক্ষণ বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সুরে বাজনা বাজানো হয়। বাদ্যযন্ত্রের এই বাজনাটি মূলত দ্রুতলয়ের কোন তাল ও আকর্ষণীয় সুরের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়। মোটামুটি দর্শক উপস্থিত হলে পরিবেশনা শুরুর জন্য প্রস্তুত হয় দলটি। দলের পরিচালককে স্থানীয়ভাবে সরকার, ম্যানেজার অথবা অধিকারী পরিভাষায় অভিহিত করা হয়।

পরিবেশনা শুরুর আগেই বাদ্যযন্ত্রী দল মঞ্চের মাঝখানে বৃত্তাকারে মুখোমুখি অবস্থানে বসে। এরপর পরিবেশনার শুরুতে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে পালার অভিনয়শিল্পীরা মঞ্চে প্রবেশ করেন। শুরু হয় বন্দনা বা দর্শক অভ্যর্থনা পর্ব। এই পর্বে কখনো কখনো পালার কাহিনীর সারমর্মও উঠে আসে। এছাড়া অনেক সময় দেশাত্মবোধক কোন গানের সুরেও বন্দনা পর্ব শুরু করা হয়। এ পর্বে অভিনয়শিল্পীরা মঞ্চের চারদিক ঘুরে ঘুরে দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। পরিবেশনাটির কাহিনী সূত্রানুযায়ী একটি দৃশ্যের পর আরেকটি দৃশ্যে ভাগ করা হয়। ধারাবাহিকভাবে একটির পর আরেকটি দৃশ্য পরিবেশিত হয়। প্রতিটি দৃশ্যের মধ্যবর্তী সময়ে বাদ্যযন্ত্রী দল নির্দিষ্ট একটি সুরে বাজনা বাজাতে থাকে। এ সময় মঞ্চে কোনো অভিনয়শিল্পী উপস্থিত থাকেন না। শুধু বাদ্যযন্ত্রী দল মঞ্চের মাঝখানে গোল হয়ে অবস্থান করে। সম্পূর্ণ পরিবেশনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাদ্যযন্ত্রী দল মঞ্চের মাঝখানে বৃত্তাকারভাবে মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করে।

This image has an empty alt attribute; its file name is dhamer-gaan-bondona-1.jpg

অভিনয়রীতি
ধামের গানের অভিনয়রীতি দীর্ঘদিন ধরে একটা নিজস্ব ধারায় পরিবেশিত হয়ে আসছে। প্রায় সবগুলো পালাতেই চরিত্রভেদে অভিনয়রীতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। আদি থেকেই ধামের গানে মূলত পুরুষরাই নারী ও পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে আসছে। উপস্থাপিত চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে অভিনয়ের একটি স্বতন্ত্র ধারা পরিলক্ষিত হয়। এতে বেশিরভাগ চরিত্রের ক্ষেত্রে অতিঅভিনয় চোখে পড়ে। অনুরূপভাবে নারী চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়েও ধামের গানের স্বতন্ত্র ধারা লক্ষণীয়। যেহেতু নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করেন, সুতরাং মানানসই অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এর উত্তরে বলা যেতে পারে, পুরুষ কর্তৃক নারী চরিত্রে অভিনীত চারিত্রিক অভিনয়শৈলী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিখুঁতভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করতে সফল হয়। সংশ্লিষ্ট নারী চরিত্রের অঙ্গ ও রূপসজ্জা যেমন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে তেমনি ওই নারী চরিত্রের অঙ্গভঙ্গি, চাহনি, বাচনভঙ্গি (নারীসুলভ স্বর প্রয়োগের মাধ্যমে সংলাপ প্রক্ষেপণ) এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে ওই নারী চরিত্রটি নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয়। প্রতিটি দৃশ্যের গল্প কাঠামো ঠিক রেখে অভিনয়শিল্পীরা সংলাপ আদান-প্রদান করেন। এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, একই পালার একই সংলাপ পরবর্তী পরিবেশনায় কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কারণ কাহিনী ও গল্পের অবকাঠামো ঠিক রেখে উপস্থিত সংলাপ প্রয়োগ এবং উপস্থিত অভিনয় পদ্ধতি ধামের গানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকনাট্যের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক বটে।

ধামের গান “নটপটিয়া ব্রাহ্মণ ও ফুলেশ্বরী বাঁশ মালিনীর কেচ্ছা”
ঠাকুরগাঁওয়ের ধামের গানের বিখ্যাত একটি দলের পরিবেশনা “নটপটিয়া ব্রাহ্মণ ও ফুলেশ্বরী বাঁশ মালিনীর কেচ্ছা”। এই পালাটি পরিবেশনা করেছিল- রায়পুর লোকনাট্য গোষ্ঠী, ঠাকুরগাঁও। এই পালাটি রচনা করেছেন শচীন্দ্রনাথ রায় যিনি পেশায় একজন পল্লী চিকিৎসক। নির্দেশনা দিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ বর্মণ যিনি পেশায় একজন কৃষক। এই পালার কয়েকটি সংলাপ উপস্থাপন করছি যা আঞ্চলিক ভাষায় রচিত।
“কায়রে বা তোমহা কায়? এমন চেঁচামেচি করেছেন কিতায়?”

“দূরদেশত বাড়ি হামার, তোমহা হামাক চিনিবেন নি, তেষ্টায় জীবন যাছে হামাক খিলাও তোমহা পানি।”

“শুনেক বেটি ফুলেশ্বরী, শুনেক মন দিয়া;
দুইজন আইসছে মেহমান সেবা করেক যায়া।
জল খাবার দে বেটি না করিস দেরি,
অচেনা মেহমান ভাগ্যে আইসছে হামার বাড়ি।”

“মুই হনু অবলা নারী না জানু রান্ধন,
কিছু মনে না করেন ঠাকুর করহ ভোজন।”

“তোর মতন সুন্দরী মাই নাই দেখু জগতে
বহু ভাগ্যে দেখা মোর হোইল তোর সাথে
জগতের রূপ তোর অঙ্গে করে খেলা
তোরহে মতন সুন্দর তোর হাতের গাঁথা মালা।”

“ও সুন্দরী ফুলেশ্বরী না করিস দুখ
দে মালা পাইস যদি তুই মনত সুখ।”

“এই নেও মালা ঠাকুর দিনু তোমহাক গলে
দিনু নারীর মন প্রাণ না ভাসাইয়ো জলে।”

“ছি ছি ফুলেশ্বরী এ তুই কি করিলো
হাতে না দিয়া মালা মোর গলেতে দিলো?”

“হায় হায়রে
কি জাত কি কুল জানা শোনা নাই
একেবারে গলায় মালা,
এইবার ঠাকুর তুই বুঝিবো কী ঠ্যালা।”

উপরিক্ত সংলাপে যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছু অর্থ-
তোমহা=তোমরা, কিতায়=কেন, হামার=আমাদের, তোমহা=আপনারা, বেটি=মেয়ে, মুই=আমি, হনু=হইল, মাই=নারী, মোর=আমার, তোরহে=তোমার, তোমহার=আপনার, গলেতে=গলায়।

শব্দ ও আবহ সংগীত প্রয়োগ
ধামের গানের সংগীত দল সাত থেকে আট জন বাদ্যযন্ত্র শিল্পী সমন্বয়ে গঠিত হয়। ধামের গান পরিবেশনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গানে গানে কাহিনীর ধারাকে সামনে এগিয়ে নেয়া। সেজন্য সংগীত এবং সংগীত দলের আবশ্যকতা এখানে অপরিহার্য। যে ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়- বাঁশের বাঁশি, ক্লারিওনেট বাঁশি, দোতরা, ঢোল, খোল, হারমোনিয়াম ও করতাল। এখানে মূলত দেশীয় ও সহজলভ্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয়। বিশেষত ধামের গান দৃশ্যের অন্তর্নিহিত ভাব ও রসকে ফুটিয়ে তুলতে এবং দর্শকের সাথে বিশেষ অনুভূতি ও দৃশ্যের সাথে বিশেষ সংযোগ তৈরি করতেই আবহ সংগীত প্রয়োগ। যা ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকনাট্যের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে নির্দেশ করে।

আলোক প্রক্ষেপণ
ধামের গান পরিবেশনায় আলোক প্রক্ষেপণ বা আলোক সম্পাতের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যেহেতু গ্রামীণ জনসমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে সৃজনশীল মানুষদের আয়োজনে ধামের গান পরিবেশিত হয় সেজন্য আলোক সম্পাতের ক্ষেত্রে বাহুল্য বা ব্যয়বহুল আলোক ব্যবস্থার আয়োজন করা সম্ভবপর হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবেশিত এই পালাগুলো সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়ে সারা রাতব্যাপী চলে। সেজন্য রাতের আধারকে আলোকিত করতে অনেক বেশি পরিমাণ আলোর প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছায়নি এমন অঞ্চলে কিছুদিন আগ পর্যন্ত হ্যাজাক বাতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যেত। পরবর্তীকালে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার শুরু হয়। এর মধ্যে টিউব লাইট, এনার্জি সেভিংস লাইট, হ্যালোজেন লাইট এমনকি এলইডি বাতির ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

This image has an empty alt attribute; its file name is dhamer-gaan-alok.jpg

রচনাশৈলী
আমরা আগেই একটি ধামের গানের কিছু সংলাপ আলোকপাত করেছি। এবার এই পালাটির রচনা তথা ধামের গানের রচনাশৈলী নিয়ে কিছুটা ধারণা নেয়া যেতে পারে। “নটপটিয়া ব্রাহ্মণ ও ফুলেশ্বরী বাঁশ মালিনীর কেচ্ছা” নামক পালাটি নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ রায় খুব সহজ সরলভাবেই রচনা করেছেন। কাহিনীর তেমন কোনো উত্থান-পতন পর্ব নেই। গল্পের নেই তেমন প্যাঁচ। মূলত প্রণয় আবেগের সূত্র ধরেই মূল কাহিনীর বীজ বোনা। সামাজিক স্তরের উঁচু এবং নিচু উভয় চরিত্রের দেখা মেলে গল্পে। বাংলা নাটকের ঐতিহ্যবাহী বর্ণনাত্মক রীতির বুনন কৌশল ধামের গানে অনুসৃত। ফলে একই সাথে যেমন ঘটনার বর্ণনায় এখানে উঠে এসেছে কাহিনীর আদল, তেমনি একই ছন্দে এগিয়ে চলেছে সংলাপ ও দৃশ্যের অন্তর্নিহিত কথা। নাট্য রচনায় দৃশ্য বিভাজন খুব সরলভাবে অনুসৃত। এক্ষেত্রেও বলা যায়, ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ণনাত্মক রীতি অনুসরণ করে দৃশ্য শিরোনামায় রচিত হয়েছে। একটি ঘটনার ধারাবাহিকতায় আরেকটি নতুন ঘটনা এবং সকল ঘটনার আর্বতন কাহিনীর ফলাফল বা পরিণতিকে ঘিরেই। যেন একের ভিতর বহু আবার বহুর ভেতর এক। শ্রদ্ধেয় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের (১৯৪৯-২০০৮) ভাষায় যা “দ্বৈতাদ্বৈতবাদ” নামে অভিহিত।

অন্তিম কথা
ধামের গানের শিল্পীদের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ থাকে না। এঁরা আহামরি কোনো পেশাদার অভিনেতাও নন। অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এঁরা বর্গাচাষি, দিনমজুর, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রীর জোগালি ইত্যাদি সাধারণ পেশার লোক। এসব গানের আসরের কোনো পাণ্ডুলিপিও হয় না, থাকে না যাত্রাপালার বা মঞ্চ নাটকের মতো কোনো প্রম্পটার। প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী থেকেই নেওয়া হয় চরিত্রগুলো। সুতরাং মূল ধারার নাটক-যাত্রাপালার মতো এখানে সংলাপ নিয়েও আহামরি কোনো বিচার বিবেচনা করতে হয় না। শিল্পীরা মঞ্চে আসেন আর সাবলীলভাবেই অভিনয় করেন। তাদের অভিনয়ের দক্ষতা সমাজের প্রতি তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতারই পরিচয় বহন করে। ধামের গান আঞ্চলিক ভাষাতেই পরিবেশিত হয়। এর বিষয়বস্তু হল প্রতিদিনের চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ এবং তা খুবই জীবন্ত ও সাহিত্যিক মারপ্যাঁচ শূন্য। এ কারণে এতদঞ্চলে ধামের গানের আসক্তি ও জনপ্রিয়তা অন্য সব লোকনাট্য থেকে অনেক বেশি।

বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে ধামের গানকে শাস্ত্রীয়, রংপাঁচালি, পাঁচমিশালি ও যাত্রাপালা এ কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। ধামের গানে যাত্রাপালা আদলে বিষয়বস্তুর সংযোজন সাম্প্রতিকতম সময়ে চলমান, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান।

পরিশেষে, ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকসংস্কৃতির গ্রথিত শেকড় ধামের গানের সূত্রে ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।

তথ্যসূত্র :

  • উইকিপিডিয়া
  • নটপটিয়া ব্রাহ্মণ ও ফুলেশ্বরী বাঁশ মালিনীর কেচ্ছার পালা
  • সৈয়দ জাকির হোসেন (জেলা কালচারাল অফিসার, জেলা শিল্পকলা একাডেমি ঠাকুরগাঁও)
  • ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্য ধামের গান” ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে, সামিউল্যাহ সমরাট, ১৩ নভেম্বর ২০১৬, বাংলা ট্রিবিউন
  • লোকনাট্য প্রসঙ্গ ও ধামের গান”, রকমারি ডটকম
  • লোকনাট্য প্রসঙ্গ ও ধামের গান”, অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে’র লেখা গবেষণা গ্রন্থ।

Similar Posts

error: Content is protected !!