নয়মাস দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও উৎকণ্ঠার পর মায়ের কোল আলো করে যে নবজাতকটি পরিবারে আসে তার প্রাথমিক যত্ন ও পরিচর্যা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এই অবুঝ সোনামনি শুধু কান্না ছাড়া আর কোনভাবে তার প্রয়োজন বা অসুবিধার কথা জানাতে পারে না। মা-বাবাসহ পরিবারের সবারই দায়িত্ব তার সঠিক যত্নের মাধ্যমে নানাবিধ অসুখ-বিসুখ থেকে তাকে বাঁচিয়ে সুস্থ্য, সবল ও প্রাণচঞ্চল রাখা।
প্রথমেই আমাদের জানা দরকার গর্ভাবস্থায় মায়ের কোন প্রকার জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই শিশুর জন্ম কোন দক্ষ ডাক্তার, নার্স বা দাইয়ের কাছে করানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোনো জরুরি সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ যেন থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। জন্মকালীন অল্পক্ষণের সমস্যার জন্য শিশুটি সারা জবিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে। স্বাভাবিক জন্মের পর শিশুকে শুষ্ক, উষ্ণ কাপড়ে ভালো করে মুছে নিয়ে আর একটি মুকনো কাপড়ে জড়িয়ে রাখতে হবে। নাভী দুই ইঞ্চি পরিমাণ রেখে কমপক্ষে ২টি শক্ত বাঁধন দিয়ে নতুন ব্লেড বা পরিষ্কার চাকু দিয়ে কাটতে হবে। মায়ের ফুল পড়তে দেরি হলে বা শিশুর কাঁদতে দেরি হলে নাভী কাটা বন্ধ রাখা চলবে না।
জন্মের সাথে সাথে শিশু কেঁদে না উঠলে পিঠে ও পায়ে একটু ঘষা দিয়ে তাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করতে হবে। এতে ফল না হলে শিশুকে চিৎ করে শুইয়ে ঘাড়ের নিচে এক ইঞ্চি পরিমাণ কাপড় দিয়ে মাথা সোজা করে ধরে নাক ও মুখের উপর পাতলা একটি কাপড় দিয়ে তার উপরে হালকাভাবে মিনিটে ৩০-৪০ বার শ্বাস দিয়ে শিশুর বুক ফুলিয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে। এমনিভাবে অল্পক্ষণ শ্বাস দিলেই শিশু নিজে থেকে শ্বাস নেয়া শুরু করতে পারে। শিশুর পা উঁচু করে উল্টো করে ধরে পিঠ থাপড়ানো উচিত না।
শিশু কাঁদার পর পরিষ্কার কাপড়ে পেঁচিয়ে মায়ের কাছে দিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শালদুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। নবজাতকটির ওজন নেবার চেষ্টা করতে হবে। এটি জানা থাকলে পরবর্তীতে তার সঠিক বৃদ্ধি নির্ণয় করা যায়।
জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই শিশুর কিছু কিছু স্বাভাবিক সমস্যা হয়ে থাকে। যেমন:
প্রস্রাব হতে দেরি হওয়া
বেশিরভাগ নবজাতকের জন্মের সাথে সাথে একবার প্রস্রাব হয় এবং পরে প্রায় ২৪ ঘণ্টা আর প্রস্রাব নাও হতে পারে। এটি স্বাভাবিক। জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সাধারণ পায়খানা হয়-কালো রংয়ের হয়- এবং তা এক সপ্তাহের মতো থাকতে পারে।
বুকের দুধ আসতে বিলম্ব হওয়া
প্রথম ২/৩ দিন মায়ের দুধ কম আসে এবং এ সময় শিশুর কম দুধেরই প্রয়োজন থাকে। এ সময় শিশু দুধ কম খায় ও পায় এবং শিশুর শরীরে কিছু অতিরিক্ত পানি থাকে তা আস্তে আস্তে শুকাতে থাকে। অন্য কোন খাবার না দিয়ে বার বার দুধ টানাতে থাকলে সাধারণত তৃতীয় দিনে দুধের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এ সময় শিশুর পায়খানা একটু পাতলা ও দিনে আট দশবারও হতে পারে। শিশু বুকের দুধ যখনই খেতে চাইবে তখনই তাকে খেতে দিতে হবে। সময় বেঁধে বা ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানো ঠিক নয়। দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের স্তনের বোটাসহ কালো অংশের যতটুকু সম্ভব শিশুর মুখের ভেতর দিতে হবে এবং তার ঠোঁট দুটো যেন মুড়িয়ে না যায় সেটা দেখতে হবে। এক স্তনে খাওয়া শেষ হলে অপর স্তনে খাবে। মাকে অবশ্যই এ সময় একটু অতিরিক্ত ও দুধসহ তরল খাবার বেশি খেতে হবে।
নবজাতকের জন্ডিস
জন্মের তিন-চার দিন পর প্রায় সকল নবজাতকের শরীরই কমবেশি হলদে দেখায় বা জন্ডিস হয়। এটি স্বাভাবিক। এক সপ্তাহে থকে দশ দিনে তা প্রায় মিশে যায়। কিন্তু নিচের লক্ষণগুলো থাকলে তাকে অস্বাভাবিক জন্ডিস ভাবতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
* যদি জন্মের পরের দিন জন্ডিস ভালোভাবে বোঝা যায়।
* যদি কোনো সময় জন্ডিসের মাত্রা অনেক বেশি মনে হয় যেমন চোখ-মুখ, শরীর ছাড়াও হাত ও পায়ের তালু পর্যন্ত হলুদ মনে হয়।
* শিশু কম খেতে চায় বা তাকে নিস্তেজ মনে হয়।
* যদি শিশুর পায়খানার রং ফেকাসে বা সাদা সাদা হয়।
* যদি জন্ডিসের সাথে শিশুর জ্বর/বমি ইত্যাদি থাকে।
* দুই সপ্তাহ বয়সের পরও যদি বেশ স্পষ্ট জন্ডিস থাকে।
* যদি মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয়।
* শিশু যদি অনেক কম ওজনের হয়।
স্বাভাবিক জন্ডিসের সময় শিশুদের গায়ে সকালে ১৫-২০ মিনিট সূর্যের হালদা রোগ লাগাতে পারলে তা তাড়াতাড়ি কমে। খেয়াল রাখতে হবে রোদ লাগাতে গিয়ে শিশুর গায়ে ঠাণ্ডা বাতাস লেগে যেন শরীর ঠাণ্ডা হয়ে না যায়।
গায়ে লাল লাল দানা
প্রথম সপ্তাহে অনেক শিশুর গায়ে লাল দানা ওঠে, একে অনেকে মাসিপিসী বলেন, যা স্বাভাবিক এবং কয়েকদিনের মধ্যে আপনা থেকেই তা ভালো হয়ে যায়। এ সময় শিশুর গায়ে কোনো তেল বা লোশন লাগানো ঠিক নয় তাতে এটি বাড়তে পারে।
ফুসকুরি
যদি ত্বকে পুঁজসহ সাদা দানা হয় তবে তাতে জীবাণুনাশক পাউডার বা ক্রিম দিতে হবে এবং সহজে ভালো না হলে বা চড়াতে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
নবজাতকের ত্বকের যত্নে সরিষার তেল ব্যবহার না করাই ভালো। অলিভ অয়েল, বেবী অয়ের দেয়া উত্তম।
নাভীর যত্ন
নাভীতে কোনো কিছু না লাগিয়ে শুকনো থাকতে হবে। যদি নাভীর চারপাশ লাল হয় অথবা পুঁজের মত রস আসে, তখনই ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। নাভীতে কোনো প্রকার সেক দেবার প্রয়োজন নেই।
চোখ ওঠা
যদি চোখে ময়লা আসে বা ভোরবেলা চোখ এঁটে থাকে তবে চোখে রোজ চারবেলা চোখের ড্রপ (কোরামফেকিনকল আই ড্রপ) সপ্তাহখানেক দিতে হবে।
গোসল করানো
জন্মের সাথে সাথে শিশুকে গোসল না করিয়ে পরিষ্কার কাপড়ে ভালো করে মুছে পেঁচিয়ে রাখা উচিত। শিশুর গায়ে ও হাত পায়ের ভাঁজে যে সাদা আঠালো প্রলেপ (Vernix) থাকে তা কিন্তু ক্ষতিকর বা খারাপ কিছু না। অপরিণত শিশুদের বেলায় এটি বেশি থাকে। এই প্রলেপ শিশুর ত্বককে রক্ষা করে। জন্মের সাথে সাথে তা মুছে ফেলার প্রয়োজন নেই। শিশু পরিণত ও সঠিক ওজনের হলে ২/১ দিন পর গোসল করানো যায় তবে নাভী না শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। প্রতিদিন ঊষ্ণ গরম পানিতে ভালো করে সমস্ত শরীর মুছে দেয়া উচিত।
গোসলের সময় যেন কানে পানি না যায় তা খেয়াল করতে হবে এবং গোসলের পরে তাড়াতাড়ি নাভীসহ সমস্ত শরীর ভালো করে মুছতে হবে।
শিশু যদি অপরিণত ও কম ওজনের হয় তবে অন্তত প্রথম দু’সপ্তাহ গোসল না করানোই ভালো।
চুল কাটা
জন্মের অল্প দিনের মধ্যেই মাথার চুল না কেটে কিছু দেরিতে কাটা উত্তম। চুলগুলো পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। এগুলো শিশুকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে।
অপরিণত ও কম ওজনের শিশু
শিশু যদি ৩৫ সপ্তাহ পূর্ণ হবার পূর্বেই জন্ম নেয় তবে তাকে অপরিণত নবজাতক ও ২.৫ কেজি ওজনের কম হলে তাকে কম ওজনের নবজাতক বলে।
দুই কেজির বেশি ওজন হলে সাধারণত তেমন কোনো অসুবিধা হয় না তবে তার কম হলে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে যেমন: ঠিকমত খেতে না পারা; সহজে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া; সহজে রোগ সংক্রমিক হওয়া; অতিরিক্ত জন্ডিস হওয়া ইত্যাদি। এসব শিশুদের ভালোভাবে ঊষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে হবে। মায়ের দুধ ভালো মতো টেনে খেতে না পারলে হাতে গালিয়ে চামুচে বা ড্রপারে বারে বারে অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে। নবজাতক যদি খুব কম ওজনের (১.৫ কেজির কম) হয়, যাদেরকে ঘরে ঊষ্ণ রাখা কঠিন এবং চামুচেও যারা দুধ গিলতে পারে না তাদেরকে হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে হবে। সকল নবজাতকের যত্নে একটি জিনিষ ভালো করে খেয়াল রাখতে হবে যে সব সময় পরিষ্কার হাতে তাকে ধরতে হবে এবং তার কাপড় চোপড় বিছানা যাতে শুকনো পরিষ্কার থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
নবজাতকের টিকা
নবজাতক অবস্থায় টিকা শুরু করতে হবে। এ সময় বিসিজি, প্রথম ডোজ পোলিও ও জন্ডিসের প্রথম টিকা দিতে হবে। পরবর্তী টিকাগুলো টিকাকেন্দ্র বা ডাক্তারের পরামর্শমতো সঠিক সময়ে অবশ্যই দিবেন।
একটি সুস্থ নবজাতকের যদি কখনও নিচের যেকোনো সমস্যা দেখা দেয় তবে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
* যদি হঠাৎ করে শিশু খাওয়া কমিয়ে দেয় বা দুধ টানতে না পারে।
* যদি জন্ডিস বেশ বেড়ে যায়।
* অনেক বমি বা ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়্
* খিঁচুনি হয়: নবজাতকের সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে খিঁচুনি হয় না। লক্ষণগুলো হলো হঠাৎ একদিকে চোখ ঘুরিয়ে রাকা, চোখ-মুখের মাংসপেশি হঠাৎ কেঁপে ওঠা, কোন হাত বা পা হঠাৎ একদিকে ঝাঁকানো বা সোজা করে রাখা, মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
* যদি শিশুর শ্বাস অতি দ্রুত হয় অথবা শ্বাসের সাথে বুকের পাজর বসে যায় বা অস্বাভাবিক শব্দ হয়্
* যদি শিশুর শরীরের তাপ হঠাৎ বেড়ে বা কমে যায়।
আমাদের দেশের শিশু মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হলো নবজাতকের বিভিন্ন দরনের প্রদাহ এবং সময়মতো তার সঠিক চিকিৎনা না করা। নবজাতকের অসুস্থতায় কোনোভাবে বিলম্ব করা মোটেই ঠিক নয়।
আসুন আমরা সবাই আমাদের এইসব অবুঝ সোনামনিদের যত্নের ব্যাপারে আরো সচেতন হই এবং তাদের সুস্থ সবল হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করি। আপনার সোনামনির সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অধ্যাপক এমএএকে আজাদ চৌধুরী
বিভাগীয় প্রধান, নবজাতক বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল