হাওরপাড়ের নিজস্ব সম্পদ “ঘাটুগান” আজ লুপ্তপ্রায়। অন্যান্য সংস্কৃতির কিছুটা রেশ থাকলেও ঘাটুগানের কোনো অস্তিত্ব আজ খুঁজে পাওয়া অধুনাভাগ্য।
বন্ধু এমন হলে আমার বাড়ি
আর আইও না-
আর আইও না।।
এস বস কাছে
হাত দিও না ডালুম গাছে
পাকলে ডালুম তোমায় দিব
নাইলে দিব নারে বন্ধু
নাইলে দিব না
আর আইও নারে বন্ধু
আর আইও না।।
এস বন্ধু বস কাছে
রাখব তোমায় হৃদয় মাঝে
ভালবাসা দেব তোমায়
আর কাউকে দিব নারে বন্ধু
আর কাউকে দিব না
আর আইও নারে বন্ধু
আর আইও না।। ঐ
গত পর্বগুলো কতটুকু পরিশ্রমের ফসল হতে পারে তা একজন সংগ্রাহকই জানেন। তার মধ্যে অনেকের নিরুৎসাহিত কথা আমাকে আঘাত করেছে বারবার। প্রতিবার আমার এ ক্ষতগুলো মুছে দিয়েছেন নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর ও আমার পরম শ্রদ্ধেয় বড়ভাই তোফায়েল আহছান। পরম শ্রদ্ধেয় প্রিন্স রফিক খান যখন বলেন-
“তরী তোমার ভিরেছে তীরে,
নিন্দুকেরা নিন্দা করে ফিরে।”
আমি আছি তোমার সাথে। সত্যিই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার সংগ্রহ কাজে আরো কিছু দেবতাতুল্য ব্যক্তি আছে তাদের নাম না হয় আমার হৃদয় ঘরে বন্দি থাক।
তবে সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছে এ ঘাটুগান সংগ্রহ করতে। কোনো হদিসই পাচ্ছিলাম না আমি। অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ঘুরে সবশেষে ঘাটুগান সংগ্রহ করা বাদ দেওয়ার উপক্রম, ঠিক তখনই মোহাম্মদ আজমল ভাই আমাকে জানালেন নিকলী সদরের মীরহাটি একটা ঘাটি গানের দল ছিল এবং তাদের মধ্যে এখনো কেউ কেউ জীবিত আছেন। শুনে মুখে একটা হাসি আসলো। এবার নাম লিস্ট করে প্রত্যেকের কাছে হাজির হলাম। কিন্তু আমার ভাগ্য এতটায় মন্দ যে বয়সের ভারে ও ধর্মীয় সামাজিকতার কারণে আমাকে তারা কোনো তথ্য দিতে নারাজ। পরে আজমল ভাইয়ের মাধ্যমে তাঁর এক চাচাকে রাজি করালাম। কিন্তু তিনিও আমাকে আজ-না-কাল, আগামী সপ্তাহ, অন্য কেউ রাজি হচ্ছেন না। এমনভাবে তার পেছনে ঘুরলাম দেড় মাস। পরিশেষে তার একজন সহযোগীকে নিয়ে রাজি হলেন। অতপর আজকের এ পর্ব।
গত পর্বের শেষে ঘাটুগান নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। এ পর্বে আরো একটু ধারণা দিতে চাই। ঘাটুগান সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। তারপরেও আমি হয়তো নতুন কোনো তথ্য দিতে পারি। অন্য কোনো শাস্ত্র পাঠ করে নয়, সরেজমিনে যা পেয়েছি তার থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি। তাই পাঠক বা বিচারক হিসাবে আপনাদের দ্বিমত আমার কাছে গ্রহণযোগ্য।
বন্ধু এমন হলে আমার বাড়ি আর আইও না
আর আইও নারে বন্ধু
-আর আইও না।।
এস বন্ধু বস কাছে
হাত দিও না ডালুম গাছে
পাকলে ডালুম তোমায় দিব
নাইলে দিব নারে বন্ধু
নাইলে দিব না।
আর আইও নারে বন্ধু
আর আইও না।।
এস বন্ধু বস কাছে
রাখব তোমায় হৃদয় মাঝে
ভালবাসা তোমায় দেব
আর কাউকে দিব নারে বন্ধু
আর কাউকে দিব না।
আর আইও নারে বন্ধু
আর আইও না।।
এ ঘাটুগানের জন্ম কবে, কোথায় তার কোনো দালিলিক প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি। তবে তার জন্ম যে আমাদের হাওরপাড়ে, তার কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এ ঘাটুগানের উদ্ভব হয় আমাদের নিকলীতে। যদিও বিজ্ঞজনেরা বিভিন্ন অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেছেন। এটা তর্কের খাতিরে বলছি না। জানা ও জানানোর জন্যেই বলছি। সারা বাংলাদেশে যখন কিশোরগঞ্জকে সংস্কৃতির রাজধানী বলা হতো তখন এই সংস্কৃতি চর্চা হতো নিকলীতে। আমার আগে যত গবেষক নিকলীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন সবাই এ কথাই উল্লেখ করেছেন।
তার আরো একটি প্রমাণ হচ্ছে, সারা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র “রপ্তানি নৌকা” ছিলো নিকলীতে। যে নৌকার মধ্যে বর্তমানের ৩০টি বড় নৌকা অনায়াসে ঢুকে যবে। এ নৌকাগুলো যখন খালি থাকতো তখন হাওরপাড়ের মানুষ এর মধ্যে ঘাটুগান চর্চা ও ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে ঘাটুগান পরিবেশন করত। নিকলীতে ঘাটুগানের জন্ম হয় মধ্যযুগে। সম্ভবত পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে যখন দ্বিজ কন্যা চন্দ্রাবতীর জন্ম। অথবা ইটনার উদয় আচার্যদেবের সময়কাল থেকে। এই উদয় আচার্য্যের খোঁজে গত সুদিনে আমার সফরসংগী কারার বদরুল মোমেন হিমেলকে নিয়ে ইটনায় গিয়েছিলাম; কিন্তু স্থানীয় মতে কোনো তথ্য পেলাম না।
নিকলী যে সংস্কৃতির রাজধানী ছিল এ ব্যাপারে হাওর গবেষক প্রিন্স রফিক খান বলেন- “নিকলী সদর থানাসংলগ্ন বড়হাটিতে রয়েছে পরেশ বাবুর বাড়ি। বাড়িটিতে এককালে হতো নিকলীর নাটক থিয়েটার ইত্যাদি। এ বাড়িটিকে বলা যায় নিকলীর সাংস্কৃতিক অংগনের আতুর ঘর। এখন সবকিছুই বিলুপ্ত। বাড়িটি বিলুপ্তের পথে। তবে এখনো একটি মন্দির ও মঠ রয়েছে। মন্দিরের ভিতরে ও বাহিরে রয়েছে অনেক চিত্র ফলক। এগুলো এককালে ভারতের রাজস্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। যা আজকের যুগে বিলুপ্তের পথে। এই চিত্র ফলকগুলো টাইলস নামে পরিচিত। এগুলো ইতিহাসের অংশবিশেষ। এ যেন “দেখা হয় না চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।”
ঘাটুগানের জন্ম যে নিকলীতেই তার চুলচেরা তথ্য-উপাত্ত পেতে আমার “হাওরপাড়ের সংস্কৃতি” শিরোনামে বইটি সংগ্রহ করতে হবে। সেখানে আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন।
উপরোক্ত তথ্য ও গান সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী সদর ইউনিয়নের সাবেক ঘাটু মোঃ জসিম উদ্দিন (৬২) । পিতা (ঘাটু দলনেতা) মৃত মনহর আলী। তার পেশা কৃষি (বর্তমান)।
তবে এ ঘাটুগানের প্রচলন ষোড়শ শতকের শেষের দিকে হয় বলে গবেষকরা ধারণা করছেন। বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণের প্রেমমগ্ন কোনো এক ভক্ত রাধা সেজে কৃষ্ণের অপেক্ষায় ছিলো। তখন তার কিছু ভক্ত গড়ে ওঠে। এই ভক্তদের মধ্য হতে ছেলে শিশুদের রাধার সখি সাজিয়ে নেচে নেচে বিরহের গান গাওয়া হতো এবং এভাবেই ঘাটু গানের প্রচলন শুরু হয়।
ঘাটুগান আজ বিলুপ্তপ্রায়। অঞ্চলভেদে ঘাটু শব্দের উচ্চারণগত ভিন্নতা দেখা যায়। কোথাও কোথাও শব্দটি “ঘাঁটু”, “ঘেটু”, “গেন্টু”, “ঘাড়ু”, “গাড়ু” নামে পরিচিত। তবে শিক্ষিত লোকজন একে “ঘাটু” হিসেবেই ব্যবহার করেন। নিকলীতে “ঘাটু”কে “ঘাডু” বলে থাকে।
হাওরগবেষক (অপ্রকাশিত) খাইরুল আলম বাদলও দাবি করেন এ ঘাটুগানের উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায়। তার কিছু অকাট্য যুক্তিও দিয়েছেন তিনি।
একজন মূল গায়েন এবং তার সঙ্গে দোহারী। বাদ্যযন্ত্র সংযোগে এই গান পরিবেশিত হয়। ঘেটু শব্দের অর্থ নাচনেওয়ালী। পুরুষকে মেয়ে সাজিয়ে ঘেটু বানানো হয়। বালক ও কিশোর বয়সের ছেলেদের ঘাটু সাজানো হয়। তৎকালীন সময়ে রক্ষণশীল সমাজের মেয়েরা গান-বাজনা, অভিনয় করত না।
কৃষ্ণলীলা ঘাটুগানের থেকেই এই গানের উদ্ভব হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ গানের সুরে মোহিত হয়ে পড়ে। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান, কৃষ্ণলীলা এবং এই ধারার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম প্রেম নিবেদনমূলক গান, বিচ্ছেদ, মান- অভিমান বিষয়ক গান গ্রামে রচিত এইসব গানকে “ছম” গান বলা হয়। ঘাটুগানের গ্রামীণ নাম হলো “ছম” গান। তখনকার দিনে দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক গান হত। গায়েন গান গাইতেন এবং দোহারীরা গান ধরতেন। ঘেটু নৃত্য গীতের মাধ্যমে নেচে নেচে দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দ দান করত। ছোকরা বয়সের ঘেটুদের প্রভাবশালী কৃষক, জমিদার নিয়ন্ত্রণ করতেন। অল্পবয়সের সুন্দর চেহারা ও সুকণ্ঠের অধিকারী ছোকরাদের ঘাটু বানানো হত। ঘাটু গ্রামীণ আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। সুন্দর একজন ঘাটুর কাছাকাছি যেতে পারলে অনেকে নিজের জীবন ধন্য মনে করতেন।
ঘাটুর পালনকর্তাগণ ঘাটুকে বাইজি ও রক্ষিতাদের মত ব্যবহার করতেন। নিকলীতে বিদেশি বণিকদের আগমন ছিল সেই মধ্যযুগেই। তাই নিকলীতে ঘাটুর ব্যাপক প্রচলিত ছিল। তখন সমাজের প্রভাবশালী জমিদার ও ব্যক্তিগণ আনন্দ, গান-বাজনা করার জন্য, মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য, অবসর সময় কাটানোর জন্য ঘাটু পালতেন। তার একটা প্রমাণও প্রিন্স রফিক খান দিয়েছেন।
জীবিত ঘাটুদের সাথে কথা বলে এমনটাই জানতে পারলাম। তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কিছু ঘাটুগান নিচে তুলে ধরলাম।
১.
বন্ধুরে তুই জলে ভাসা সাবান কিইন্ন্যা দিলে না
সাবান কিইন্ন্যা দিলে নারে
সাবান কিইন্ন্যা দিলে না।।
কারে বলি সাবানে বন্ধুরে
আমার শইল্যের ময়লা যায় না
বন্ধুরে তুই সাবান কিইন্যা দিলে না।।
সাবান আছে ঘরে ঘরে
বিকায় সাবান বিষুদবারে
যুদি কর আমার আশা
সাবান আইন্ন জলে ভাসা
নইলে রবে মন ভাসা
নইলে রবে মন ভাসা
আশা তোমার মিটবে না
বন্ধুরে তুই সাবান কিইন্যা দিলে না
সাবান কিইন্যা দিলে নারে বন্ধু
সাবান কিইন্যা দিলে না।।
২.
কে দিল পিরিতের বেড়া
আমার লেচুর বাগানে
লেচুরও বাগানে সই গো
কমলার বাগানে।।
ছুডু ছুডু লিচুগুলি
বন্ধু তুলে আমি তুলি
বন্ধু দেয় গো আমার মুখে
আমি দেই বন্ধুর মুখে
না জানি কি আছে বন্ধুর মনে
কে দিল পিরিতের বেড়া
আমার লেচুর বাগানে।।
৩.
পালল্ক সাজাও প্রাণপিয়াসী
আসব তোমার মন্দিরে।।
গুয়া কাড কুডি কুডি
লং দিয়া বানাইও বিড়ি।
পান খাইয়া ঢালব পিচকি
তোমার পাকা যৈবনে।
পালল্ক সাজাও প্রাণ পিয়াসী
আসব তোমার মন্দিরে ।।
৪.
শোয়া পাখিরে….
কুহু সুরে আর ডাকিছ না,
ডাকিছ নারে প্রাণ কোকিলা
বহিছ না তামাল ডালে। (আমার মনে হয় এখানে তমাল=কদম হবে)
বিরহের বেদনার সেলগো
বহিল কালিয়ারে। ঐ
কোন বা দেশে থাক বন্ধু
কোন বা তোমার থানা
ও কালিয়ারে
দেখা দিতে কে কইরাছে মানা ।।
কুহু সুরে আর ডাকিছ না। ঐ
মনে লয় উড়িয়া যাইতাম।।
বিধি না দেয় পাখা,
কুহু সুরে আর ডাকিছ না। ঐ
৫.
কার্তিক মাসে শুকনা নদী
ডালেতে শুকাইল কলি
ভ্রমর এসে করে গুনগুন রে।।
ওরে আমি মরলে ঐ করিও
না ভাসাইও পুরাও
ওগো বেধে রাইখ
তমাল গাছের ডালেরে।।
সখিরে পুড়তে পুড়তে
হইলাম ছাই
আর তো পুড়ার বাকি নাই
সেই পুড়াতে হইয়াছি অঙ্গার।
প্রাণ সখিরে…
সেই পুড়াতে হইয়াছি অঙ্গার।
বন্ পুড়া যায় সবাই দেখে
মনের আগুন কেউ দেখে গো
প্রাণ সখিরে ….
সেই পুড়াতে হইয়াছি অঙ্গার। ঐ
কেউ কেউ আবার উল্লেখ করেছেন, ঘাটুগানের জন্ম ময়মনসিংহে (ত্রিশাল) এলাকায়। যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেখানে ময়মনসিংহ গীতি বেশিরভাগই সংগ্রহ করা হয়াছে কিশোরগঞ্জ থেকে। কোথাও কোথাও গানের ভনিতায় সে কথা প্রকাশও পেয়েছে। সরেজমিন বিশ্লেষণ সাপেক্ষে এই মতের সাথে আমি একমত হতে পারছি না। তবে আমরা অনুমান করি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার অন্তর্গত কিছু কিছু স্থানে (যেখানে মূলতঃ হাওরের আধিক্য রয়েছে) এর প্রচার প্রসারের ফলে এই অঞ্চলেই মূলত ঘাটুগানের উদ্ভব হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।[১]
যে, ঘাটুগান অঞ্চলভিত্তিক হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয়বস্তুর হাত ধরেই ঘাটুগান পরবর্তীতে বিকাশ লাভ করে। ঘাটুগানের প্রধানত তিনটি ধারা:
১. আখ্যানভিত্তিক বর্ণনা ও সংলাপাত্মক পালাগান
২. প্রশ্ন-উত্তরমূলক প্রেম ও তত্ত্বের গান
৩. বিভিন্ন ভাবের খণ্ড গান।
এছাড়াও গবেষকগণ বাংলাদেশের অন্যান্য লোকনাট্যের বাছ-বিচারে বিলুপ্তপ্রায় এই বিশেষ উপস্থাপনটির বিশেষ কিছু দিক চিহ্নিত করেছেন; যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পবোধে নতুনতর বোধ ও মাত্রা যোগ করেছে। এবং প্রযোজনা নির্মাণে বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। যেমন- বিষয়, আঙ্গিক পরিবেশনা রীত বিচার করে ঘাটুগানের নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা যায়:-
১. ঘাটুগান মুখ্যত প্রেমাত্মক গান; এ প্রেম সম্পূর্ণ মানবিক। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা রূপকমাত্র; এতে মর্মভাব আধ্যাত্মিকতার স্থান নেই। মানবিক প্রেমের আবেগ ও রস-রুচি প্রস্ফুটিত হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণ লীলাবিষয়ক গানগুলো ঈষৎ মার্জিত হলেও লৌকিক প্রেমভাব নিয়ে রচিত গানগুলি প্রায়শই লঘু ও ইন্দ্রিয় সুখকর হয়ে থাকে।
২. রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানগুলিতে প্রেম আছে, মিলন নেই; মিলনের আকাঙ্খা ও বিচ্ছেদের বেদনা ঘাটুগানকে করুণ রসে সিক্ত করেছে।
৩. ঘাটুগান নৃত্য সম্বলিত লোকসংগীত। গায়েন বা সরকার গান করেন, ঘাটু নেচে সে গানের ভাব ফুটিয়ে তোলে। ঘাটু যখন একা গায়, তখনও সে অঙ্গভঙ্গি করে নাচে। আলকাপ গানের ছোকরা এবং লেটো গানের লেটো একই ভূমিকা পালন করে থাকে। দর্শক-শ্রোতারা একই আসরে নাচ-গান উভয় প্রকার রস উপভোগ করে থাকে।
৪. ঘাটুগানের মৌলিক উদ্দেশ্য বিনোদন। বালককে কিশোরীর বেশ-ভূষণ পরিয়ে নাচ-গান দ্বারা দর্শনেন্দ্রিয় এবং গানের ভাব ভাষা দ্বারা শ্রবণেন্দ্রিয় তৃপ্তিবিধান করা হয়। বিষয় পরিবেশন করার মধ্যে এ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে।
৫. ঘাটুগান সংলাপাত্মক। রাধা-কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক “শ্যাম-রাই” ধারার গানগুলি রাধা-কৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক। “ছম” ধারার গানগুলি রাধা-কৃষ্ণ ও সখীদের স্বগতোক্তি বিশেষ। সংলাপাত্মক হওয়ায় গানগুলি নাটকীয়তার বৈশিষ্ট্য বহন করে। লৌকিক প্রেমের ঘাটুগানেও একই আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে। অর্থাৎ ঘাটুগান একাধারে সংগীতরস, নৃত্যরস ও নাট্যরস মণ্ডিত শিল্পকর্ম।
পরবর্তীতে এসে এ ঘাটুগান আর রাধা-কৃষ্ণর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাস্তব জীবনের চিত্রও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন ঘাটুরা। প্রেমময় আবেদন, মনের দুঃখ, আনন্দ বা পারিবারিক চিত্র ফুটিয়ে তুলতো ঘাটুগানের মাধ্যমে। তার কিছু প্রমাণ পাব নিচের ঘাটুগানগুলোর মধ্যে-
১.
বন্ধু জানিয়া জানলে না
হাইরে শুনিয়া শুনলে না ।
জ্বালায়া গেলে মনের আগুন
নিবাইয়া গেলে না।।
বন্ধু নয়নের কাজল,
বন্ধু নয়নের কাজল
ছিলে মাত্র না দেখিলে
মন হয়রে পাগল। ঐ
কেঞ্চি কাটা চুলরে বন্ধু
কেঞ্চি কাটা চুল
আসলে নারে চেংরা বন্ধু
ফুটতে গোলাপ ফুল ।
বন্ধু মানিয়া পিরিতি
বন্ধু শুনিয়া পিরিতি
আস পুরসি পাড়ার লোকে
বন্ধু ভাংল পিরিতি।। ঐ
২.
ও রঙ্গিলা নাইয়া
যাও তরনি বাইয়া
সোনালি পাল উড়াইয়া।।
টাকা চাই না
পয়সা চাই না
চাই ভালবাসা।
তোমার সনে যাব বলে
সেই তো মনের আশা গো।।
নিবা কিনা নিবা বন্ধু
বলে যাও আমারে।
সোনালি পাল উড়াইয়ারে
বুক ভাসিয়া যায় নয়ন জলে
কেঁদে হইলাম সারা।
তোমার সঙ্গে যাব বলে
সেইত মনের আশা গো।।
নিবা কিনা নিবা বন্ধু
বলে যাও আমারে (অসমাপ্ত)
৩.
বন্ধু রাখিও খবর
না জানিয়া করলাম পিরিত,
ভাঙ্গলাম সুখের ঘর
বন্ধু রে।
তোমার মনে যেই বাসনা
আমার মনে সেই কল্পণারে বন্ধু। ঐ
বন্ধু শুধু তোমার আনাগোনা
আমার মনে
দুঃখ লাগেরে। ঐ
আমি মরলে ঐ করিও তুমি মরলে সঙ্গে যাব রে। ঐ
৪.
আমার মন দিয়াছি ,
প্রাণ দিয়াছি
দিয়াছি গলার মালা।
আমি মরলাম বন্ধুর
যৈাবন জ্বালা,
আগে যদি জানতাম বন্ধু
যাইবারে ছাড়িয়া
আমি দুই চরণ বান্দিয়া রাখতাম
মাথার কেশও দিয়া।। ঐ
আগে যদি জানতাম প্রেমের এত জ্বালা
আমি না করে ছিলাম ভালা।।
থাকিতাম একেলা রে। ঐ
তুমি আমার মাথার বেণি
মনি-মুক্তার মালা।
আমি ভ্রমর হইয়া উইড়া যাইতাম
খাইতাম ফুলের মধু রে। ঐ
উপরোক্ত তথ্য ও গান সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী সদর ইউনিয়নের সাবেক ঘাটু মোঃ সাইদুর রহমান (৬০)। পিতা মৃত ঘাটু ইন্নছ আলী। পেশা ব্যবসা (বর্তমান)। ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার (২০১১-১৬)।
সহযোগিতায় : মোহাম্মদ আজমল আহসান (গণমাধ্যম কর্মী), মোঃ আঃ ছাত্তার রিটন চিশতী, পরাগ বর্মন, হারুন মিয়া, মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, মোঃ মোরাদ হাসান।
সংগ্রহ সূত্র : মোঃ জসিম উদ্দিন, পিতা মৃত মনহর আলী। মোঃ সাইদুর রহমান, পিতা মৃত ইন্নছ আলী, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার।
তথ্য সূত্র :
১। নাট্যবিদ্যা, ২য় সংখ্যা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, মৈমনসিংহ।
২। উইকিপিডিয়া।
৩। কিশোরগঞ্জ ডটকম।
৪। http://bn.wikipedia.org/wiki/কীর্তন
৫। ওয়াকিল আহমদ, ঘাটুগান (ঢাকা: বইপত্র, প্রথম প্রকাশ ২০১৪)
৬। জাহিদুল কবির, ত্রিশালে ঘাটুগান “শিল্পকলা ষান্মসিক বাংলা পত্রিকা (ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্প কলা একাডেমী, সপ্তবিংশ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০৮)
৭। কে মউদুদ এলাহী, গবেষণা পদ্ধতি এবং প্রতিবেদন প্রণয়ন (ঢাকা: লবেল পাবলিশিং হাউস, প্রথম প্রকাশ, মে ২০০৬)
৮। কিশোরগঞ্জের লোক ঐতিহ্য-প্রিন্স রফিক খান।