পল্টি খাওয়া দেখার সবচেয়ে উত্তম জায়গা

পৃথিবীতে মানুষের পাল্টি খাওয়া দেখার সবচেয়ে নিখুঁত জায়গা হচ্ছে একই পরিবারে একবার ছেলেপক্ষ আর আরেকবার মেয়েপক্ষ হয়ে বিয়ে খেতে যাওয়া!!

বিয়ে ব্যাপারটা ছেলেপক্ষের জন্য সব সময়ই দম্ভের- আমি বলছি না, ব্যতিক্রমী পরিবার কোথাও নেই, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের অধিকাংশ মানুষ ছেলেপক্ষ হলে যে দাম্ভিক আচরণ দেখায়, তাতে মনে হয় যে তারা মেয়ের ১৪ দু’গুণে ২৮ গুষ্টির মাথা কিনে নিয়েছে!

প্রথমে আসি দেনমোহরের বিষয়ে। দেনমোহর ঠিক করার সময় ছেলেপক্ষ যত দর কষাকষি করে, ভাব দেখলে মনে হয়, “এই মেয়েকে যে ২ লাখ টাকা দিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছি, তাই তো এর ৭ জনমের ভাগ্য। আরো বেশি কীভাবে চান? মেয়ে আপনাদের কালো, লম্বাও খুব বেশি না। তার ওপর রান্নাবান্না কিছু জানে না। এমন আদরের দুলালী আমাদের ছেলে না হলে কেউ নিতো?”

ঠিক এই পরিবারটাই যখন মেয়েপক্ষ, তখন বিয়ের আসরে গর্বিত সুরে গল্প করে এভাবে, “১৫ লাখ দেনমোহরে আমাদের মেয়ে নিচ্ছে, ঠিকই আছে। তবে ২০ এর কমে আসলে আমাদের মেয়ের সাথে অন্যায় হয়ে যায়। এতো ভালো মেয়ে তো আর কোথাও পাবে না, তাই না? তাও এতো করে বললো যখন আমাদের মেয়ে সুখে থাকলেই আমরা খুশি!”

marriage

তারপর বিয়ে পড়ানো। ছেলেপক্ষ হলে বলবে, তাদের আনা শাড়ি-গহনা পরিয়ে বিয়ে পড়াতে হবে। মেয়ের বাড়ি থেকে তো বাপ-মা তেমন কিছুই দেয়নি। এতো ছোট কম দামী জিনিস দিয়ে তাদের বাড়ির বউকে বিয়ে পড়ানো যায়? মেয়েপক্ষ হলে এরাই নিচু স্বরে ছেলের বাবামায়ের কাছে অনুমতি চাইবে, ছেলেদের শাড়ি-গহনা মেয়ে মূল অনুষ্ঠানে পরুক, বিয়ের সময় গায়ে শাড়িটা শুধু একটু ছুঁয়ে থাকুক না হয়? বিয়েতে কবুল বলার সময় বউ যদি না কাঁদে কিংবা রেজিস্ট্রি খাতার সবকিছু পড়ে সই দিতে চায়, তাহলে ছেলেপক্ষের কাছে মেয়ে হলো নির্লজ্জ বেয়াদব!

ঠিক এই পরিবারই মেয়েপক্ষ হলে তাদের মেয়ে বিয়েতে কেঁদে বুক ভাসালে, অনেকবার অনুরোধের পর নিচুস্বরে কবুল বললে তারা মেয়েকে নিয়ে গর্বিত হয়। তাদের মেয়ে মানুষ হয়েছে, তার লজ্জা সম্ভ্রম এখনো এ যুগে ভেসে যায়নি!!

বিয়ের পর ছেলে সবাইকে মুখে সালাম দিলে সমস্যা নেই অথচ মেয়ে মাথা নিচু করে পারলে পায়ের কাছে মাথা নিয়ে সালাম করলেই যেন সে ভদ্র সম্মানিতা। অথচ আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নিচু করাটাই নিষেধ!! মাঝে মাঝে ভাবি, শান্তি কামনা কি মন থেকে আসা উচিত নাকি দাসত্ব মেনে নেয়া থেকে?

ছেলেপক্ষের সামনে বিয়ে পড়ানোর পর বউকে তার বাড়ির কেউ মুখে তুলে খাইয়ে দিলে বউ লুতুপুতু ঢঙ্গী। আর এরাই মেয়েপক্ষ হলে মেয়েকে তার শাশুড়ি নিজে খাইয়ে দিলে তারা এমন আত্মীয় পেয়ে গর্বিত!

মোট কথা, ছেলেপক্ষকে দেখলে মনে হয় বউ না, তারা কামলা নিয়ে যাচ্ছে যত্ন করে। তাই মেয়েপক্ষের তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আর মেয়েপক্ষ হলে মনে হয়, তারা মাথা নিচু করে হুজুর হুজুর করে মরে যাবে যেন ছেলেপক্ষ তাদের মেয়েকে সুখে রাখে!!
আমি আসলেই বুঝি না, নিজেদের ছেলে নিয়ে মানুষ কেনই বা দাম্ভিক হয় আর মেয়েকে নিয়ে সবসময় কুণ্ঠিত থাকে! যখন ছেলেমেয়ে দুই-ই এক স্রষ্টার সৃষ্টি? সবচেয়ে দুঃখ হয়, যখন দেখি একই পরিবারের মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি এমন দু’মুখো চেহারাটা দেখায়। উপায় কী? সে নিজে মেয়ে হিসেবে এবং বউ হিসেবে পরিবারের কাছ থেকে যা পেয়ে এসেছে, তার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও তো সেই ধারাই বজায় রাখবে। খুবই স্বাভাবিক! আসলে শিক্ষা আর বিবেক যদি একটা মেয়ের মন থেকে ছেলে আর মেয়ের বৈষম্য মুছতে না পারে, তাহলে মেয়ে হয়েও নিজের মেয়ে সন্তান নিয়ে সে সবসময় মাথা নিচু করে থাকবে। সাম্যতার কথা স্বপ্নেও ভাববে না!! যতদিন মেয়েরা নিজের বাড়িতে ‘বউকে গ্রহণ’ করবে, আর পরের বাড়িতে ‘মেয়েকে দান’ করবে, ততদিন মেয়ে জাতটা দাসী হয়েই বেঁচে থাকবে। যতই সে সার্টিফিকেটে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিজ্ঞানী হোক না কেন!

কানিজ ফাতিমা ছন্দা

Similar Posts

error: Content is protected !!