কোন ধরনের খাবারে সহজেই শক্তি বৃদ্ধি হয় তা জানা থাকলে কার্যক্ষমতা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। দেখা যাক কোন খাবারে কেমন গুণাগুণ। বিভিন্ন খাবারের গুণাগুণ ও উপকারিতা নিয়ে লিখেছেন সৈকত আহমেদ
ডিমের কুসুম শরীরের জন্য খুব উপকারী। এতে প্রচুর ভিটামিন বি থাকে, যা শরীরে শক্তি সরবরাহে সাহায্য করে। ডিমের মধ্যে বিদ্যমান ভিটামিন ডি হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া প্রোটিনের ব্যাপক সরবরাহ করে ডিমের কুসুম। পানির বিকল্প কিছু নেই এটা আমরা সবাই জানি। তবে পানি কী জন্য এত প্রয়োজনীয় তা এর গুণাগুণ জানলেই বোঝা যায়। শরীরে শক্তি জোগাতে এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া শরীরের অপ্রয়োজনীয় উপাদান পানির কারণে মূত্র আর ঘামের সাথে বের হয়ে যায়। এতে শরীর অনেক বেশি সতেজ থাকে। চায়ের থেকে কফি অনেকের প্রিয়। এতে অনেক বেশি ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি থাকায় ব্যায়াম বা শারীরিক কসরতজনিত যেকোনো কাজে অনেক বেশি শক্তি জোগায়। সয়াবিনে ভিটামিন বি, বি কমপ্লেক্স থাকে। এ ছাড়া কপার ও ফসফরাস থাকার ফলে খাবারকে ভেঙে তার পুষ্টি গুণাগুণ শরীরে সরবরাহ করতে সাহায্য করে। বাদাম আর শুকনো ফলের মিশ্রণ শরীরে ব্যাপক প্রোটিন সরবরাহ করে। এর মধ্যে থাকা আঁশ শরীরে গ্লুকোজ সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক রাখে। এ ছাড়া প্রোটিন পেশিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। কুমড়ার বীজ খাবার হিসেবে অনেকের প্রিয়। অনেকে ভেজে খেতে পছন্দ করেন কুমড়ার বীজ। এ বীজে প্রোটিন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক আছে। এ উপাদানগুলো শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ব্যায়াম বা শারীরিক যেকোনো কাজ করার সময় যে শক্তি প্রয়োজন হয়, কুমড়ার বীজের মধ্যে তার সব গুণাগুণ পাওয়া যায়।
চকোলেটের উপকারিতা
গাঢ় চকোলেট অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর থাকে, যা দেহের কোষগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করে। ফলে এ ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ চকোলেট বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। বেশ ঘন কিংবা গাঢ় চকোলেট শুধু মজাদার নয়, মানবদেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন উপাদান সৃষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। ঘন চকোলেট সপ্তাহে দু-তিনবার খেলে তা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এসব চকোলেট রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং বিশেষ কোনো স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া প্রতিহত করে। হার্ট অ্যাটাকেরও ঝুঁকি কমায়। মানসিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনও ঘটায়। চকোলেটের মধ্যে থাকা (পিইএ) নামক পদার্থ আনন্দদায়ক মনোভাব সৃষ্টি করে। মানুষ যখন একে অন্যকে ভালোবেসে আনন্দ অনুভব করে, তখনো কিন্তু ব্রেনে পিইএ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ঘন চকোলেট খাওয়ার অভ্যাস মানসিক প্রশান্তি তৈরি করে।
রক্তকে সবল এবং এর স্বাভাবিক গতিকে সচল রেখে ডায়াবেটিস টাইপ২-এর হাত থেকে রা করে। দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ অনাকাক্সিতভাবে কমে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে। গাঢ় চকোলেট অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর থাকে, যা দেহের কোষগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রা করে। ফলে এ ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ চকোলেট বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এ ধরনের চকোলেট অন্যান্য মিষ্টি উপাদানের মতো নয়। এতে রয়েছে থিওব্রমিন, যা দাঁতের অ্যানামেল মজবুত করে। চকোলেটে থাকা থিওব্রমিন গলা বা বুকের কফকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল থাকায় সুস্বাস্থ্যের জন্য চকোলেট বেশ কার্যকর। এর মধ্যে থাকা কপার এবং পটাশিয়াম হৃদরোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। এতে রয়েছে আয়রন, যা শরীরের জন্য উপকারী। ঘন চকোলেটের মধ্যে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ডায়াবেটিস টাইপ২, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক। প্রতিদিন একবার চকোলেট খেলে তা কর্মপ্রেরণাকে বেশ সক্রিয় রাখে।
শতমূলীর শতগুণ
শুধু বাগানের শোভা বাড়াতে নয়, খাবার হিসেবেও উন্নতমানের ঔষধি গাছ শতমূলী। এর কচি কাণ্ড অ্যাসপ্যারাগাস নামে পরিচিত। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ও ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয় শতমূলী। পুষ্টিকর পদার্থে ঠাসা এ ভেষজ। আঁশ, মিনারেলস, ক্রোমিয়াম থেকে শুরু করে ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, ‘ই’, ‘কে’ প্রভৃতি রয়েছে শতমূলীতে। এ উদ্ভিদে প্রচুর গ্লুটাথায়ন নামের উপকারী উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে। এ উপাদান ক্যান্সারের বিস্তার রোধ করে। একই সাথে সূর্যের তিকর ফ্রি রেডিক্যালও ধ্বংস করে দেয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর খাবার শতমূলী। এক গবেষণায় জানা গেছে, এটি ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া কমিয়ে দেয়। শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং স্নায়ুশক্তি বাড়াতে কাঁচা শতমূলীর রস খেয়ে দেখুন। তিন-চার চা চামচ রস এক গ্লাস দুধের সাথে মিশিয়ে মাত্র ১৫ দিন সকাল-বিকেল খেতে পারেন। এতে আছে উচ্চমাত্রার ফলিক এসিড। এ এসিডে রয়েছে সেরোটনিন নামক পদার্থ, যা আমাদের শরীরে সুখবোধের রাসায়নিক মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ এ সবুজ সবজি খেলে মেজাজমর্জি ভালো হয়ে যাবে। উচ্চমাত্রার অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে এ ভেষজে। এটা মূত্রবর্ধক ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শরীরকে অতিরিক্ত লবণ থেকে মুক্তি দেয়। তাই যাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে কিংবা যারা হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এক উত্তম দাওয়াই হতে পারে শতমূলী। এসিডিটি, ডায়রিয়া, আমাশয় নিরাময়ে বিশেষ উপকারী এ ভেষজ। পাশাপাশি রক্তের অনেক সমস্যার সমাধান রয়েছে শতমূলীতে।
শতমূলীর শিকড়ও মানবদেহের জন্য উপকারী। এর শিকড়ের রস কিডনি ও লিভারের জন্য উপকারী। বদহজম সমস্যায় ভুগলে মধুর সাথে শতমূলীর শিকড়ের রস মিশিয়ে খেতে পারেন। সমাধান পেয়ে যাবেন। পাইলস সারাতেও শতমূলীর বিশেষ গুণ রয়েছে।
ত্বক রক্ষায় গ্রিন টি
চাপ্রেমীদের কাছে গ্রিন টির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন টির মধ্যে বিদ্যমান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও পুষ্টিগুণ থাকার ফলে এর চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ত্বকসচেতন মানুষের কাছে তাই এ চায়ের গুরুত্ব অনেক। ত্বক ঠিক রাখতে গ্রিন টির উপকারিতাগুলো জানা থাকলে এ নিয়ে চিন্তা অনেকটাই দূর হবে। ত্বকের ব্রণ দূর করতেও এ চা উপকারী। কারণ এর মধ্যে বিদ্যমান অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল গুণাগুণ ত্বকের ব্রণ দূর করতে সহায়তা করে।
গ্রিন টি মূলত ত্বকের জন্য উপকারী। এটি ত্বকের পুষ্টি সরবরাহের স্টোর হাউজ হিসেবে কাজ করে।
এ চায়ের মধ্যে যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, তা সূর্যের অতি বেগুনিরশ্মির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে। সবুজ চা সান বার্ন থেকে ত্বককে রা করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শুধু ত্বককে অতি বেগুনিরশ্মি থেকে রাই করে না, ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকেও রা করে। গ্রিন টির মধ্যকার প্রাকৃতিক উপাদান শরীরের কোষ তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এ ছাড়া ডিএনএ সমন্বয়ে কাজ করে।
অনেক সময় ত্বকে প্রদাহ শুরু হলে গ্রিন টি অনেকটা ওষুধের মতো কাজ করে। ত্বকের মধ্যে গ্রিন টি প্রদাহ কমাতে ভূমিকা রাখে। পান করার পাশাপাশি গ্রিন টি মুখে মাখলে তা সান স্ক্রিন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ব্রণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পেঁপে বাড়ায় ঔজ্জ্বল্য
পেঁপে ফলটি আমাদের কাছে উপাদেয় খাবার হিসেবেই অধিক পরিচিত। কিন্তু ত্বকের সৌন্দর্যে পেঁপে এক উপকারী ফল, সেটিও জেনে রাখা যেতে পারে। সূর্যের তপ্ত কিংবা আর্দ্র আবহাওয়ায় ত্বককে শীতল, ময়েশ্চারাইজিং, আকর্ষণীয় করতে পেঁপে হতে পারে কার্যকর এক উপাদান। ত্বকচর্চায় কতই না নামী ব্র্যান্ডের দামি ক্রিম নিত্য ব্যবহার করি। পেঁপে সহজেই ত্বকের ব্রণ, ফুস্কড়ি, বদত প্রভৃতি দূর করতে পারে অনায়াসে।
পেঁপে খুবই পুষ্টিগুণসম্পন্ন ফল। এতে মেলে ভিটামিন ‘এ’ ও প্যাপেইন (এক ধরনের প্রোটিন)। প্যাপেইন ত্বকের মৃত কোষ দূর করে। কাঁচা পেঁপে মুখে ব্যবহার করলে দূর হয় দাগ ও ব্রণ। পেঁপে বাটা (ম্যাশড্) যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়া, ত ও গোড়ালির কাটা জায়গায় ব্যবহার করলে ভালো কাজ দেয়। কেবল মুখের ব্রণ কিংবা ত নিরাময়ই নয়, পায়ের ত্বক ফরসাকরণেও এটি ব্যবহার্য। নিয়মিত মুখে ব্যবহার করলে বয়সের ছাপও দূর হয় অনেকটা। যদি আপনার ত্বক শুষ্ক এবং রু হয়, তবে পেঁপে বাটার সাথে মধু মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন, ভালো ফল দেবে। পেঁপে অবশ্য খুশকি দূর করতেও সাহায্য করে। চুলের সমস্যা দূর করতে নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন এর পেস্ট।
এলাচের সুবাস
এলাচ সুগন্ধিময় ঔষধি। মূল্যের দিক দিয়ে বিশ্বে এর অবস্থান তিন। তরকারির স্বাদ বাড়াতে কিংবা স্বাস্থ্য সুরায় চমৎকার মসলা এ বীজ। এতে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। প্রচুর প্রোটিন, স্বল্প মাত্রায় ফ্যাট, ভোলাটাইল অয়েল প্রভৃতি। আরো আছে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস।
বুক জ্বালা কমিয়ে দিতে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লিভার, গলব্লাডারের সমস্যায় সমাধান আনে এ ভেষজ। ক্ষিদে না লাগলে এলাচ মুখে পুরে নিন। অথবা খাওয়ার আগে এলাচ গুঁড়ো পানি দিয়ে খেয়ে নিন। খাবারের আগ্রহ বেড়ে যাবে। পেটফাঁপা ভাব, পেট ব্যথা ও এসিডিটি দূর করতে সাহায্য করে এ ঔষধি। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও এলাচের কদর রয়েছে। হজমের সমস্যায় ভুগলে এলাচ খেয়ে যান। শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগের জন্য উপকারী ঔষধি এলাচ। এলাচ দিয়ে চা খেলে অনেক ভালো লাগবে।
এ ছাড়া কাশি থেকে মুক্তি পেতে এ চায়ের জুড়ি মেলা ভার। মাথাব্যথা থাকলে তাও পালাবে। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এলাচের মতো কার্যকর ভেষজ আর নেই। একই সাথে এটি মুখ ও গলার ক্ষত সারাতে সহায়তা করে। কিডনি থেকে বিষাক্ত উপাদান সরিয়ে দেয় এলাচ। এ ছাড়া প্রস্রাবে সমস্যা হয়ে থাকলে এলাচ গুঁড়ো করে নিন। এবার এ গুঁড়ো মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। মূত্রবর্ধক ওষুধ এবং ভরপুর আঁশের কারণে এটা উচ্চরক্তচাপ কমিয়ে দেয়।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা ফাঙ্গাসজনিত কোনো রোগ প্রতিরোধে বেছে নিতে পারেন এ অ্যান্টিসেপ্টিক। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস ও অ্যাসেনশিয়াল অয়েল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা ফ্রি রেডিক্যালস থেকে ত্বককে রা করে এবং বুড়িয়ে যাওয়া কমিয়ে দেয়। রক্তের জমাটবদ্ধতা কাটিয়ে দেয় এলাচ। হেঁচকি, খিঁচুনি রোধে এর ভূমিকা সুবিদিত।
তবে অনেক পুষ্টিবিদের মতে, গর্ভবতী, ব্রেস্ট ফিডিং করছেন এমন মায়েরাসহ যাদের পিত্তথলি পাথরের সমস্যায় আক্রান্ত, তাদের এলাচ এড়িয়ে চলাই ভালো।