ঈমানের সাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত বা নামাজ হচ্ছে ইসলামের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যুগে যুগে সালাত সব নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম এবং বিভিন্ন জাতির জন্য ফরজ বা অবশ্যই প্রতিপালনীয় ছিল। আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে অনেকবার সালাতের মর্যাদার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘আর আমি তোমাকে (মূসা) মনোনীত করেছি, অতএব যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে, তা শুনতে থাকো।… দেখো! আমি সত্যিই আল্লাহ। আমি ছাড়া আর কারো উপাসনা করা উচিত নয়। সুতরাং আমার উপাসনা করো এবং আমাকে স্মরণের জন্য সালাত কায়েম করো (সূরা তোয়া-হা; আয়াত ১৩-১৪)।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তেলাওয়াত করুন (হে মোহাম্মদ সা:) আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব এবং কায়েম করুন সালাত। নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহকে স্মরণ করা সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা করো। (সূরা আল আনকাবুত, আয়াত ৪৫)
আমরা অবশ্যই এই সত্যকে ভুলব না যে, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা সালাত ফরজ হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ যা আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন উপলক্ষে। ঈমানদার বান্দাদের প্রশংসা করে স্বয়ং মহান আল্লাহ তাদের সালাতে নিমগ্ন থাকার উল্লেখ করেছেন। যেমন- সূরা আল মুমিনুনের একেবারে সূচনাতেই তিনি বলছেন, মুমিনরাই প্রকৃত সফলকাম যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র এবং যারা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বর্জন করে, আর যারা প্রদান করে থাকে জাকাত (আয়াত ১-২)।
এক দিন এক ব্যক্তি রাসূল সা:কে প্রশ্ন করেছিল সবচেয়ে বেশি পুণ্যের কাজ সম্পর্কে। নবী মুহাম্মদ সা: বর্ণনা করলেন, সবচেয়ে বেশি সওয়াব বা পুণ্যের কাজ হলো সালাত। তিনি তিন-তিনবার কথাটা বলেছিলেন (আহমাদ ও ইবনে হিববান)। হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, শেষ বিচারের দিনে বান্দাদের যে কাজের হিসাব দিতে হবে সর্বপ্রথম, তা হলো- সালাত। যদি এ বিষয়টি সন্তোষজনক হয়, বান্দার অন্যান্য কৃতকর্মও হবে সন্তোষজনক। আর যদি তা মন্দ হয়ে থাকে, তার অন্যান্য কাজকর্মও হবে মন্দ (আল তাবারানি)।
আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সালাত সাহায্য করে। তাই সালাত যদি যথাযথ ও আদর্শস্থানীয় হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্যান্য কাজও যথার্থ হবে। আর সালাত সঠিকভাবে আদায় না হলে অন্যান্য কাজও সন্তোষজনক হবে না। নদভি সালাতের প্রভাব সম্পর্কে চমৎকারভাবে বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের অবচেতন সত্তায় এমন আধ্যাত্মিক শক্তি, ঈমানের আলো এবং আল্লাহ তায়ালার ভয় জাগিয়ে তোলা, যা তাকে সব ধরনের মন্দকাজ ও প্রলোভনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল হওয়ার যোগ্য করে তুলতে পারে। একই সাথে তা দুঃখ-যাতনা, বিপদাপদে অবিচল থাকা এবং রক্ত-মাংসের দুর্বলতা ও অনৈতিক প্রবৃত্তিজাত অপকর্ম থেকে বান্দার নিজেকে রক্ষা করার সক্ষমতা এনে দেয়।’ আখিরাত বা পরকাল সম্পর্কে বলা যায়, আল্লাহতায়ালার ক্ষমা ও সন্তুষ্টি সালাতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এটা। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহ দিনে পাঁচবার সালাত আদায় করা বাধ্যতামূলক করেছেন। যে ব্যক্তি তার ওজু করবে সঠিকভাবে, যথাযথ সময়ে সালাত আদায় করবে, পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও মনোযোগ দিয়ে রুকু-সিজদা করবে, তার জন্য আল্লাহ এই অঙ্গীকার করেছেন যে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি এসব কিছু করবে না, তার জন্য আল্লাহর কোনো ওয়াদা নেই। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারেন, অথবা দিতে পারেন শাস্তি (মালিক, আহমাদ, আবু দাউদ, আল নাসাঈ ও অন্যান্য)।
রাসূল সা: বলেছেন : যদি কোনো লোকের দরজার বাইরে একটি স্রোতস্বিনী থাকে এবং সে তাতে দিনে পাঁচবার গোসল করে, তোমরা কি মনে করো- তার গায়ে কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকতে পারে?’ শ্রোতারা বললেন, ‘কোনো ময়লা-আবর্জনাই আর তার গায়ে লেগে থাকবে না।’ তখন নবীজী সা: বললেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করাও ঠিক সে রকম। আল্লাহ সালাতের মাধ্যমে বান্দার পাপকে মুছে দেন’ (আল বুখারি ও মুসলিম)।
অন্য এক হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্তের সালাত এবং জুমার সালাত হচ্ছে এই সময়ের মধ্যে কৃতকর্মের ভুল সংশোধন (মুসলিম)।
পরিপূর্ণভাবে মুসলমান হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার প্রতি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের পরিচয় দিতে হবে এবং দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। যারা পার্থিব জীবনে শান্তি অবলম্বন করে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে পুরো আত্মসমর্পণ করে এবং আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধের অনুসরণ করে চলে, তাদের জন্য পরকালে রয়েছে বিরাট পুরস্কার।
শেষ বিচারের দিনে সবাইকে ইহজীবনে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের অবশ্যই শেষবিচারের দিনের বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে একজন মুসলিমের কাছে এই অস্থায়ী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত তার সৎ কর্মগুলো। এসব কাজই আল্লাহতায়ালার সন্তোষ ও আশীর্বাদ অর্জন করতে সাহায্য করবে। একজন মুসলমানের কাছে তার সালাত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সালাত তাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্যে আনবে।
একজন মুসলমানকে বিচার করা উচিত তার চরিত্র দ্বারা। সম্পদের পরিমাণ কিংবা বিলাসের বহর দিয়ে তাকে বিবেচনা করা যেতে পারে না। কারণ ঈমান ব্যতীত আর কিছুই চিরস্থায়ী নয়। ঈমান টিকে থাকবে।
একজন মুসলমানের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দেহের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি প্রয়োজন। মুসলমানের আত্মারও প্রয়োজন পরিপুষ্টি। ইসলামের ধর্মীয় শক্তি এবং সালাত, জাকাত ও অন্যান্য মহৎ কাজের চর্চা থেকে আসে এই পরিপুষ্টি।
শয়তান মুসলমানদেরকে অনবরত প্ররোচিত করবে মন্দ পথে যেতে। কিন্তু তাদের থাকা চাই সুদৃঢ় ঈমান, যাতে শয়তানের কুমন্ত্রণাকে পরাজিত করা যায়।
আল্লাহ সর্বদাই আপনার সাথে থাকবেন। তবে তার করুণা পেতে হলে আপনাকে যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ইসলামের সব মৌলিক বিধিবিধান প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
দিনে পাঁচবার সালাত আদায় করা সব মহৎ কাজের ভিত্তি। কারণ সালাত পরম দয়াবান ও করুণাময় আল্লাহতায়ালার সাথে একজন মুসলমানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। নিয়মিত নামাজ বা সালাত আদায় হলে অনেক পাপকাজ থেকে বিরত থাকা যায়। তখন আর সে লোক শরিক হবে না মন্দকাজে।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। জোর করে কারো ওপর এই ধর্ম চাপিয়ে দেয়া যায় না। মুসলমানদের অন্যদের সামনে নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত।
iqrasense.com-এর সৌজন্যে
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
সূত্র : অন্য এক দিগন্ত