কবি মহিবুর রহিমের “হাওর বাংলা” : যেন কাদামাটির সোঁদা গন্ধ ভরপুর

আকিব শিকদার ।।

 

কবি মহিবুর রহিমের জন্ম হাওর অঞ্চল বলে পরিচিত কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই একজন সক্রিয় ধারার প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক শক্তিমান কবিতা। এদেশের মাটি ও মানুষের নিখাদ সম্পর্কের বিষয়টি তার কবিতায় উঠে এসেছে নানা সময়ে, নানা রূপে, নানা ভঙ্গিমায়। “হাওর বাংলা” কাব্যগ্রন্থটি তারই একটি উত্তম নিদর্শন।

একজন কবি যে কত সহজে বাংলার প্রকৃতি ও রূপকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তার প্রমাণ মিলে মহিবুর রহিমের “হাওর বাংলা” বইটিতে। বইটির প্রথম কবিতা বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত। নাম “বঙ্গবন্ধু : অনিবার্য ইশতেহার”। যেখানে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে তিনি এ জাতির আদি ইতিহাস ও জাতিসত্তার বৈরী যুগে মানুষের অদম্য ইচ্ছার কথা এনেছেন। সেই সাথে কবি গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূমিকা উল্লেখ করেছেন।

কবিতার শরীর জুড়ে গঠনগত বৈচিত্র্য, বর্ণনার উৎকর্ষ, ভাবের মিশ্রন, মহিবুর রহিমের কবিতাকে দিয়েছে আলাদা উচ্চতা। কবিতায় হাওরের স্বতন্ত্র ভূ-প্রকৃতি, যাপিত জীবনের আত্মদহন, সামাজিক নানা অনিয়ম-অসঙ্গতিও ফুটে উঠেছে অবলীলায়; সব কিছুতেই পেয়েছে নতুন মাত্রা।

“ভাঙ্গনের রেখা ধরে যেতে যেতে বহুদূরে যদি/ খুঁজে পাও কোন গ্রাম ছোট কোন দ্বীপের মতন/ যেখানে দরিদ্র তবু মানুষেরা পরস্পর গভীর স্বজন/ যেখানে কালের নদী অন্তরঙ্গ জীবন অবধি।’ এ যেমন শ^াশত বাংলার অকৃত্রিম এক সরল সৌন্দর্যের ছবি, তেমনি হাওর জনপদের নিত্য প্রবহমান চিত্রও। তাঁর আরও এক কৃতিত্ব আবহমান বাংলার মানুষের মুখে মুখে বয়ে চলা গ্রামীণ শব্দগুলোকে কখনো কখনো তাঁর কবিতার অলংকার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন- ‘বন্দের বাথান ঘরে তিনটি গাই গরু ফর হয় আয়েশার সংসারে/ তার একবাটি দুধ খেয়ে নিশ্চিত মনে হবে আছি সেই স্বর্গের ঘরে / যেখানে পূর্বপুরুষেরা সত্যিকার শ্রমের সার্থকতা গিয়েছেন বলে/ যেখানে মা বোনেরা স্নান করে ভরা বিলে ডালিমের রহস্যতুল্য জলে।”

প্রকৃত কবি তো তিনি, যিনি তাঁর কবিতায় সমসাময়িক সময়কে ধারণ করতে পারেন। মহিবুর রহিম তা পেরেছেন। তার অনেক কবিতাই সমসাময়িক যুগ যন্ত্রণাকে ধারণ করে আছে। এখানেও তাকে আরও গতিশীল, আরও স্বতন্ত্র রূপে পাই। ছন্দাশ্রিত কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কবি মহিবুর রহিম। তার কবিতায় আছে শৈশবের স্মৃতিচারণ, আছে শহরবাসী মানুষদের গ্রামে ফেরার জন্য মন টনটন করা অনুভূতি। “শস্যগন্ধী ভোর’ কবিতাটা এমন ‘এখনো আমাকে টানে / দামপাড়া সিংপুর দূরে মিটামন / বরুণ করস আর হিজলের সকরুণ বন/ প্রকৃতির উদারতা স্বপ্ন ভরা বিল/ বাতাস ও রোদের স্নেহে খেলা করে বুনোহাঁস আর গাঙচিল/ ধান কাটা শুরু হলে দাওয়ালীরা আসে এইখানে/ চারিদিক ভরে ওঠে নিষ্কলুষ ফসলের ঘ্রাণে/ এখনো আমাকে টানে/ ঘোড়াউত্রা ধলেশ্বরী কালনী বানার/ শস্যগন্ধী জীবনের / শেষ নেই যার…”

“হাওর বাংলা” বইয়ের কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে যেন কাদামাটির সোঁদা গন্ধ লেগে আছে, যেন মাছের লেজের ঝাপটায় পানির নিচের বুদবুদের মত হৃদয়ে ধাক্কা দেয় প্রতিটি উপমা। ‘কি আশ্চর্য! আবার আগের মতো পেঁকে ওঠে ধান / পাখিরাও নেমে আসে মাঠে মাঠে/ নদীর ক্ষয়ের চিহ্ন মুছে দিয়ে /আবার রঙিন সাদা স্বপ্নেরেখা একে দেয় পথ।’

কবি মনে করেন প্রকৃতি কখনো কখনো মানুষের জন্য আর্তনাদে কেঁদে ওঠে। ‘পতাকা’ কবিতাটি এমন ‘কাল সারারাত সমুদ্রের গর্জনে শুনেছি আর্তনাদ / মানবতা! মানবতা! / সন্তানের দুর্দিনে যেন কেঁদে ফিরছেন আদি মাতা।

“তিতাসের নিরবধি ঢেউ” কবিতার কিছু উক্তি দুর্দান্ত, যেন হৃদয়ে গেঁথে যায় মার্বেলের ভেতর কাঁচের রঙিন ফুলের মত। মহিবুর রহিমের কবিতা শুধু নিছক প্রকৃতিপ্রেমের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, মাঝে মাঝে প্রকৃতির সাথে মানুষের সুখ-দুঃখ, মনোবেদনা ভাগাভাগির একটি ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়, প্রকৃতি থেকে বিপ্লবের উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা লক্ষ করা যায় ‘শেষরাতে বাবা ফিরে আসতেন ঘরে/ কাঁধে তার সমাজবিপ্লবের দুঃসহ বোঝা/ তাকে ঘিরে থাকতো অসংখ্য ভয় ও আশঙ্কা / তার নিদ্রাক্লান্ত চুলে থাকতো শিশিরের মতো শাদা উদ্বেগ/ লাল বইয়ের স্বপ্ন বিছিয়ে তিনি নীরব ঘুমিয়ে পড়তেন।’

সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবিতায় পুর্ণ এই ‘হাওর বাংলা’ বইটি। পাঠককে কবিতার মাঝে ডুবিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখেন কবি মহিবুর রহিম।

যতিচিহ্নের ব্যবহার যথাসম্ভব কম করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এই কবি। বাক্যের উপস্থাপন ভঙ্গি তার কবিতাকে আলাদা করেছে সমকালীন অন্য সবার কবিতা থেকে। ছন্দ অলঙ্কার উপমা চিত্রকল্পে এনেছেন নিজস্বতা ও নতুনত্ব। কিছু উদ্বৃতি দেয়া যায়-

* ‘হিজল মান্দার বনে ফোটে থাকা আশার মুকুল
* নদী ও খালের রেখা বুকে তার রূপের মাধুরী
* নিটোল বিলের মতো চোখে তার ফসলের ছবি
* বুকে তার গাংচিল পানকৌড়ি পাখির কাকলি

উপমার এমন অনন্যতা বইটিকে দিয়ে আলাদা বিশেষত্ব। কিছু কিছু চিত্রকল্পেও চোখ ও মন আটকে থাকে। অভিনবত্ব ও অসাধারণত্ব দুটোই মুগ্ধ করে রাখে-

* আমি এক দ্রাবিড় যুবকের মতো মাটিতে উপুড় হয়ে
অচ্যুত সেই স্বপ্নকে পুতে রাখলাম।
* একটি বদ্বীপের দলিত তরঙ্গ
ভেসে চলেছে বেহুলার ভাসনে
* মনের গহীন রেখা ধরে স্নায়ুতন্ত্রে বয়ে যায় নদী
কী সতেজ ঢেউ তার আদিগন্ত সবুজে মোড়ানো
উৎপ্রেক্ষার তো ছড়াছড়ি। তার বাক্য গঠনের সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে উৎপ্রেক্ষা-
* দুগ্ধবতী সকালের সজীবতা সবুজে মর্মর
* সুষম সামর্থে তার সমুত্তীর্ণ হয়ে হয়ে উঠেছিলো ভাষা
* চেতনায় ছিল তার নদী মোহনার অকৃত্রিম সুর।

অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দের সফল ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁর বহু কবিতা অসাধারণ রূপক। রূপকের ভেতর দিয়ে জীবনের চরম সত্যকে তুলে ধরেছেন কবি। বইটির কিছু পংক্তি আমাদেরকে ভাবতে শেখায় অন্যরকম ভাবনায়। যেমন- ‘সেই দেশে যেতে যেতে রূপকথা হয়ে যায় প্রতীক্ষার প্রহর’ বা ‘যেখানে জলের দুঃখ শস্যের স্বপ্ন একসাথে সংসার গড়ে’।

বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় যেন জলের অতলে ডুবে যাচ্ছি! সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। ‘কোথায় এখন ঘাটের বধু কোথায় ঘাটের গয়না / এখন আমার ঘরের দাওয়ায় ময়না কথা কয় না / শূন্য বাতাস কেঁদে ফিরে ঘুচে তার দুঃখ / কোন দানবের যাদুবলে হলো এমন রুক্ষ। /ভাটির দেশের জীয়নকাঠি নরসুন্দা নদী/ আজও তোমার ঢেউয়ের পানসি ভিড়তো এসে যদি / নিয়ন আলোয় জ্বলতো তোমার বুকের জহরত/ প্রাণ পেতো কি কাজল রেখার গোপন মহব্বত?’

কবির স্বভাব স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি। পরাধীনতা না মানার প্রত্যয়ে কবি তার চোখ জ্বালিয়ে রাখেন কোমল উত্তাপে। ‘পরাধীনতায় বাস করে যে / কিংবা কঠিন দাসের জীবন / তাহারও/ ইচ্ছেগুলো ভাঙতে পারে লোহার শিকল/ এবং বিশাল পাহাড়ও।’

কিছু কবিতার নাম শুনলেই আন্দাজ করা যায় কবিতাটি কত প্রাণপরিতোষ হবে। যেমন- ‘পলিমাটি মন’ ‘ভাতশালিকের দেশ’ ‘নিকলীর পূর্ণিমার পথ’ ‘মধ্যরাতের জঙ্গলবাড়ি’ ‘ভয়ের বীভৎস মুখ’ ‘চাষ দেয়া কবিতার জমি’ ‘ট্রাজেডির শস্যক্ষেত্র’ ইত্যাদি।

কাদামাটির ঘ্রাণ মিশ্রিত কবিতা নিয়ে ‘হাওর বাংলা’ বইটি যেন জলজ নিখাঁদ বাংলারই মূর্তপ্রতীক। ৭৭টি কবিতা সম্বলিত ৮৮ পৃষ্ঠার এ বইটির বাজার মূল্য মাত্র ২৫০ টাকা। শুদ্ধতম সাহিত্যচর্চাকারীদের কাছে বইটি পৌঁছে যাক, এই কামনা করি।

হাওর বাংলা : মহিবুর রহিম
প্রকাশক : বদরুল হায়দার ‘কবিতাচর্চা’
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
মূল্য : ২৫০ টাকা

Similar Posts

error: Content is protected !!