হাওরপাড়ের সংস্কৃতি
ধরন : গবেষণা (একটি মাঠ সমীক্ষা)
প্রকাশনী : ঘোড়াউত্রা প্রকাশন
আকার : ১৩ ফর্মা, ২০৮ পৃষ্ঠা
মলাট মূল্য : ৪০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান :
ঘোড়াউত্রা প্রকাশন, ৫০ (বেইজমেন্ট) কনকর্ড এম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫
নন্দন বইঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-বন্ধু লাইব্রেরী, সরারচর, বাজিতপুর
কিশোর বুক হাউজ, কিশোরগঞ্জ
সোনালী লাইব্রেরী, কিশোরগঞ্জ
সরাসরি লেখক শেখ মোবারক হোসাইন সাদীর মোবাইলে (০১৭১৪৩৭৯০৬৫) যোগাযোগ করেও বইটি সংগ্রহ করা যাবে।
হাওর কথাটি শুনলে মনে হয়, দুনিয়া একটা পানির সংসার- তার সাথে লাগোয়া জীবনের খুঁটিনাটি আছে, বেঁচেবর্তে থাকার বুদ্ধিফনম আছে, আছে হার-জিৎ আর ওঠানামা; অন্যদিকে সাগর কথাটি বললে মনে হয়, জলের অন্তহীন এক সাম্রাজ্য- এখানে লেনদেন নাই, পুরো পানির আয়োজনটি আশা-নিরাশার বাইরে- একতরফা। সাগর বুঝি একটা অলৌকিক ঘটনা- তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দূরত্ব ও বিস্ময়ের, মুখ উপরে তুলে আমরা যেন এক অসীমের দিকে তাকাই- আমরা ওখানে নিষ্ক্রিয় আর অধীনস্থ; কিন্তু হাওরের সঙ্গে আছে একটি দ্বিপাক্ষিক আত্মীয় সম্পর্কের বন্ধন, ফলে তার বাতাবরণটিও লৌকিক।
বহুদিন হাওরের পথে-ঘাটে, জলে-স্থলে, আদারে বাদাড়ে ঘুরে, শতশত মানুষের সঙ্গে ভায়েবশারি, গপশপ, আড্ডায়, আলাপে সংলাপে, পাঠে গবেষণায় রাতদিন খাটাখাটনি করে শেষ পর্যন্ত শেখ মোবারক হোসাইন সাদী তাঁর সাকল্য অভিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মধু একটি চাকে এনে সঞ্চয় করেছেন- এই চাকটির নাম “হাওরপাড়ের সংস্কৃতি”। হাওরপাড়ের মানুষের বাস্তবি, সুখ-দুঃখের বহুবর্ণিল অভিব্যক্তি শেখ মোবারক হোসাইন সাদী তাঁর এই সংকলন গ্রন্থে বিন্যস্ত করেছেন।
সংস্কৃতির, বিশেষ করে সামষ্টিক কৃত্যের একটি বড় প্রবণতা এই যে, তাঁরা দুঃখের কথাটিও আনন্দের সাথে বলে। মোহররমে কারবালার জারী, কিংবা দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জনে যে হাহাকার তার অন্তরাবর্তে তাই একটি আনন্দের গাঁথুনি দেখতে পাই। তার একটি কারণ- নিজেদের মর্সিয়াকে একটি পুণ্যকীর্তির সঙ্গে মিলানোর ঐকান্তিক লিপ্ততা, অন্য কারণ- এর ভিতর দিয়ে সামাজিকগণ তাদের কৌম সমাজের স্মৃতির সঙ্গে নিজেদের দ্রবীভূত করতে পারার সৌভাগ্যে উজ্জীবিত করা।
শেখ মোবারক হোসাইন সাদীর মাঠসমীক্ষা- “হাওরপাড়ের সংস্কৃতি” সংকলন গ্রন্থটির সবচেয়ে কীর্তিমান দিকটি হচ্ছে- পুরো বইয়ের কোথাও লেখক নিজে একটি শক্ত আসনে গদিনাসীন নন- তিনি নিজেকে সম্পূর্ণতই দশের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন; সাদী কাউকে জ্ঞান দিতে গ্রামের পর গ্রাম, হাওরের পর হাওরে মিশনারি করে বেড়াননি- তিনি কেবল অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের জীবন, কাজ, সংগ্রাম ও তাদের কল্পনা প্রতিভার বিস্তারটুকু ধরতে চেয়েছেন।
সাদী নিজে পরিবেশনা শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র হবার কারণে হয়তো একটি দিকে কিছুটা মাত্রাধিক ঝুঁকে পড়েছেন; তাঁর কাছে একটি জনপদের ব্রতাচার ও কৃত্যের যে দিকটি অভিনয়ানুগ ও দৃশ্যমান তা-ই প্রধানত সংস্কৃতি; কিন্তু সংস্কৃতির পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। এই সংকলনে নাচ, গান, নানা পরিবেশনা রীতিআঙ্গিক, খেলাধুলা, গীত ও গীতির আনুপুঙখিক বিবরণ এসেছে- কিন্তু সংস্কৃতির বাহিরানাটুকু তৈরি হতে যে ভিতরানার যাত্রা- তার হদীস আমরা তেমনভাবে পাইনি; দুর্যোগ দুঃসময় মোকাবেলার জন্য ভাটি মানুষের খোদাই সিন্নির খোঁজ পাই, কিন্তু একজন ভঙ্গুর মানুষ যে রাত্রির গভীর সঙ্গোপনে তাহাজ্জত বা বেতেরের নামাজ পড়ে তা আমরা খালি চোখে দেখি না, পূজারীদের দুর্গাপূজার মণ্ডপে নেচে নেচে আরতি দিতে দেখি, কিন্তু কেউ ভয়াল শ্মশান থেকে মৃতদেহের কন্ঠা চুরি করে নিভৃতে কালীর সাধন করে, তার কথা জানি না- সাদীও তার শত পরিশ্রমলব্ধ সংকলনে সেই অন্বেষাগুলো যুক্ত করেননি।
কিন্তু তার সংকল্প, মনোভাব আর ঝোঁক থেকে আমার এই স্থির বিশ্বাস ও প্রতীতি জন্মেছে- সাদী ভবিষ্যতে হাওরপাড়সহ সারা বাংলার ভিতর-বাহির আমাদের সামনে উপস্থাপন করবেন। কেননা পরিষ্কার বুঝতে পারছি- সাদী ভাটি-বাঙলার বিনয় ও দুঃসাহস, আগুন আর অশ্রু তাঁর অঙ্গে মেখেছেন- তার হাত ধরে ভাটির বোধি তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক- চন্দ্র সূর্য বান্ধা আছে নাওয়ের আগায়।