ব্যায়ামে কি ওজন কমে?

ওজন কমানোর জন্য বছরের পর বছর ধরে জগিং করছেন বা জিমে গিয়ে কঠোর সাধনা করছেন। কিন্তু লাভ তো হচ্ছেই না, বরং ওজন বেড়ে যাচ্ছে! ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম বা শারীরিক কসরত অত্যন্ত জরুরি বলেই তো বলা হচ্ছে। তাহলে ব্যায়ামে আপনার লাভ হচ্ছে না কেন? কারণ ব্যায়ামের পর বেশি ক্ষুধার্ত হচ্ছেন এবং তারপর বেশি বেশি খাবার গ্রহণ করেন-  বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাঙ্ক ফুড। ফল হচ্ছে হিতে বিপরীত। তবে ব্যায়ামের কোনো উপকার নেই, এ কথা বলা হচ্ছে না। এ নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন অবলম্বনে লিখেছেন  হাসান শরীফ
exercise-11
অনেক দিন ধরেই আপনি ব্যায়াম করছেন। জিমে আপনাকে নিয়ে ট্রেইনার হয়তো সার্কাসের প্রাণীর মতো মেতে থাকে কিংবা আপনি হয়তো প্রতিদিন কয়েক মাইল দৌড়াচ্ছেন। সেই সাথে প্রিয় অনেক খাবারও বর্জন করে চলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই আপনি আবিষ্কার করলেন, ‘আমি কেন এমনটা করছি? আমার ওজন তো কোনোকালেই খুব বেশি ছিল না। ব্যায়ামে ওজন কমে- তাই ব্যায়াম করছি যাতে যতটুকু বাড়তি বলে মনে হচ্ছিল তা হ্রাস পায়। কিন্তু এত দিন পরও সেই আগের ওজনেই রয়ে গেছি। তাহলে কি ব্যায়ামে কোনো উপকার নেই?’
এই প্রশ্নটি এখন অনেকেই করছেন। সারা বিশ্বে এখন স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে হেলথ ক্লাবগুলোর সদস্যসংখ্যা। আমেরিকায় ১৯৯৩ সালে হেলথ ক্লাবগুলোর সদস্যসংখ্যা ছিল ২৩ মিলিয়ন। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪৫ মিলিয়ন। তারা জিম মেম্বারশিপের জন্য বছরে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা হার্ট সার্ভে দেখতে পেয়েছে, মার্কিনিরা সবাই ব্যায়াম করছে বলে দাবি করে। ১৯৮০ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের মাত্র ৪৭ শতাংশ ব্যায়াম করে। আর ২০০০ সালে জানিয়েছে, তাদের ৫৭ শতাংশ ব্যায়াম করে।
অথচ আমেরিকায় স্থূলতার হার না কমে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ আমেরিকান এখন স্থূল এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাখ্যায় আরো সমসংখ্যক লোক অতিরিক্ত ওজন বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, তারা জিমে যায় বেশি সংখ্যায়, কিন্তু ব্যায়াম করে কম।
ব্যায়ামে ওজন কমায়, ধারণাটি কিন্তু তুলনামূলক নতুন। ১৯৬০-এর দশকেও চিকিৎসকরা বিশেষ করে কিছুটা বয়স্কদের কঠোর ব্যায়াম করতে নিরুৎসাহিত করতেন, কারণ এতে তাদের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু এখনকার চিকিৎসকরা বেশি বৃদ্ধদেরও ব্যায়াম করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তারা বলেন, ব্যায়াম করলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ অনেক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছরের স্থূলতা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অন্তত ওজন হ্রাসের ক্ষেত্রে ব্যায়ামের উপকারিতার কথাটি অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করা হয়েছে।
বিশিষ্ট ব্যায়াম বিশেষজ্ঞ ও লুসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডায়াবেটিস ও মেটাবলিজমের সভাপতি এরিক র‌্যাভুসিনের মতে, সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে ওজন হ্রাসের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে সাম্প্রতিক অনেক জরিপে দেখা গেছে, ব্যায়াম ওজন হ্রাস করে না।
এটা সত্য যে, ব্যায়ামে ক্যালরি ক্ষয় করে এবং ওজন কমানোর জন্য আপনাকে ক্যালরি ক্ষয় করতেই হবে। কিন্তু আসল সমস্যা হলো ব্যায়ামের আরেকটি প্রতিক্রিয়ায় : এতে আপনার ক্ষুধা বেড়ে যায়। আর এর ফলে আপনি বেশি খাবার গ্রহণ করেন এবং এতে করে আপনি এইমাত্র যে ক্যালরি ক্ষয় করে এলেন, তার চেয়ে বেশি ক্যালরি গ্রহণ করে সম্ভাব্য উপকার থেকে বঞ্চিত হলেন। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্যায়াম শুরুর পর আগের চেয়ে বেশি খাবার গ্রহণ করছেন। অনেকে নিজেকে পুরস্কৃত করার জন্যও বেশি খাবার গ্রহণ করেন। ফলে ব্যায়াম আপনার প্রয়োজনীয় ওজন হ্রাসে সহায়ক হচ্ছে না।
এসব বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখা উচিত। কারণ এখন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মানুষকে ব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করছে। ২০০৭ সালে আমেরিকান কলেজ অব স্পোর্টস মেডিসিন এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ব্যায়ামের নতুন নির্দেশিকা প্রকাশ করে জানায়, ‘ওজন কমানোর জন্য ৬০ থেকে ৯০ মিনিট শারীরিক কসরত জরুরি।’ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা বেশি বেশি খাবার গ্রহণ করছেন, তাদের জন্য এই ব্যায়ামে কোনো উপকার হচ্ছে না।
মাংসপেশি-মেদ সম্পর্ক নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ২০০১ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থূলতা গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্রামরত অবস্থায় এক পাউন্ড মাংসপেশি দিনে প্রায় ছয় ক্যালরি গ্রহণ করে। অন্য দিকে এক পাউন্ড মেদ গ্রহণ করে দুই ক্যালরি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যদি আপনি ১০ পাউন্ড মেদ ক্ষয় করতে সক্ষম হন, তবে আপনাকে এ জন্য বাড়তি ৪০ ক্যালরি গ্রহণ করলেই চলে। আর সেটা সম্ভব মাত্র এক চা-চামচ মাখনেই। এর চেয়ে বেশি যাই খাবেন, তাই আপনার ওজন বাড়িয়ে দেবে।
শারীরিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে, মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ক্যালরি সঞ্চয় করে রাখতে পারে না। কোনো কোনো প্রাণী অবশ্য পারে। যেমন ইঁদুর। ব্রাউন ফ্যাট নামে পরিচিত কালো রঙের টিস্যুগুলোর কারণে ইঁদুররা বাড়তি ক্যালরি ধারণ করে রাখতে পারে। ব্রাউন ফ্যাটই প্রয়োজনমতো বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুষ্টিকর উপাদানগুলোকে জ্বালানিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তারা বেশি খাদ্য গ্রহণ করলে ব্রাউন ফ্যাটের মাধ্যমে মেদ এড়াতে পারে। আর এ কারণেই গবেষণাগারে বেশি বেশি খাওয়ালেও অতিরিক্ত মোটা ইঁদুর দেখতে পাওয়া বিরল ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা শোচনীয়। মানুষের দেহেও ব্রাউন ফ্যাট রয়েছে। তবে তার পরিমাণ এত কম যে, অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা তার অস্তিত্ব ধরতে পেরেছেন। এটা না থাকার কারণেই দিনে সামান্য কিছু বেশি খাবার গ্রহণ করলেই মানুষের ওজন বেড়ে যায়। সাধারণভাবে আমরা যে খাবার গ্রহণ করি, আমাদের ততটুকুর প্রয়োজনই নেই। বাড়তিটুকুই মেদ হিসেবে জমা হয়, ওজন বাড়িয়ে দেয়। এ কারণেই বছরের পর বছর কঠোর ব্যায়াম করেও অনেকের ওজন না কমে বরং বেড়ে যায়।
অনেককেই ব্যায়ামের পর মিষ্টিজাতীয় খাবার ও নানা ধরনের ড্রিংকস গ্রহণ করতে দেখা যায়। কোমল পানীয়গুলোও বাড়তি ক্যালরির জোগান দেয়। এক গ্লাস সাধারণ পানির চেয়ে একই পরিমাণ কোমল পানিতে ক্যালরি থাকে অনেক বেশি।
তাই বলা যায়, আপনি যদি কঠোর ব্যায়ামের পর বেশি বেশি খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন, তবে আপনার উচিত হবে এসব পরিশ্রম না করে সোফায় বসে থাকা। এতেই আপনি বেশি উপকৃত হবেন।
অনেকেই মনে করেন, ওজন হ্রাস করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ। আমরা দু’টি কাজই একই সাথে করতে পারি। ব্যায়ামের পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণে পরিমিতবোধের পরিচয় দিতে পারি। ২০০০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ব্যায়াম করলে আমাদের মানসিক দৃঢ়তা কমে যায়। আপনি হয়তো আগে লাঞ্চে সবজিকেই প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু দিনে এক ঘণ্টা জগিং শুরু করার পর আপনি সালাদের বদলে ফাস্টফুড খাওয়া শুরু করলেন।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা দেখা যায়। অনেকে জিহ্বা সামলাতে পারে। তবে  বেশির ভাগই পারে না। খুবই কঠিন কাজ।

exercise
ব্যায়ামের পর ক্ষুধা বেড়ে যাওয়ায় ক্যালরিসমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণের প্রবণতার প্রতি লক্ষ রেখেই খেলার মাঠের কাছাকাছি ফাস্টফুডের দোকানের এত ছড়াছড়ি দেখা যায়। প্রায়ই দেখা যায়, কোনো শিশু পাঁচ মিনিট খেলাধুলা করে হয়তো ৫০ ক্যালরি ক্ষয় করল, কিন্তু সে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ৫০০ বা এমনকি ১০০০ ক্যালরি গ্রহণ করল।
২০০৮ সালে চিল্ড্রেনস হসপিটাল, বোস্টনের গটমেকার ও কেনড্রিন সনেভিল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অবেসিটিতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারা এতে বলেন, একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করা হবে, তা স্থূলতা হ্রাসে তত সহায়ক হবে। কিন্তু বিজ্ঞানীদ্বয় ১৮ মাস ৫৩৮ ছাত্রের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখতে পান, ব্যায়ামের পর ছাত্ররা সামান্য পরিমাণে নয়, অনেক বেশি খাবার গ্রহণ করছে। তারা ব্যায়ামে যতটুকু ক্ষয় করছে, তার চেয়েও ১০০ ক্যালরি পর্যন্ত বেশি গ্রহণ করছে।
ব্যায়ামে যদি ওজন কমানো না-ই যায়, তবে আমরা কী করব? ব্যায়াম কী আর করব না? ব্যায়াম কি কোনোই উপকারে আসে না? অবশ্যই আসে। ব্যায়াম অনেক উপকার করে থাকে। ব্যায়াম ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি, বিভিন্ন রোগ থেকে প্রতিরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি ব্যায়াম আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ও বোধশক্তি বাড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালের জুনে নিউরোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, যেসব প্রবীণ লোক সপ্তাহে অন্তত একবার ব্যায়াম করে, তাদের বোধশক্তি যারা করে না, তাদের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এর কয়েক সপ্তাহ আগে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক জরিপে দেখা যায়, পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত যেসব লোক সপ্তাহে চার দিন ব্যায়াম করে, তারা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ভালো থাকে।
তবে ব্যায়াম নিয়ে বর্তমানে যেসব বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর অবসান হওয়া উচিত। বর্তমানে ব্যায়ামের অর্থ হচ্ছে ঘাম ঝরানো, ক্ষুধা বাড়ানোর কঠোর অনুশীলন। অথচ আমরা আরো সহজভাবে লক্ষ্য হাসিল করতে পারি। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানাচ্ছে, ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে আমাদের অবকাশকালীন শারীরিক কার্যক্রম (গলফ খেলা, বাগান করা, হাঁটা ইত্যাদি) ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর ঠিক এই সময়েই জিমের আত্মপ্রকাশ ঘটে ব্যাঙের ছাতার মতো। আমরা কি জিমে গিয়ে দেহকে যন্ত্রণাকাতর করব নাকি স্বাভাবিক দৈহিক কার্যক্রম চালাব তা ঠিক করতে হবে।
শিশুদের দিকে দেখুন। ব্রিটেনের পেনিনসুলা মেডিক্যাল স্কুলের একদল গবেষক গত মে মাসে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত স্থূলতা সংক্রান্ত ইউরোপিয়ান কংগ্রেসে বিস্ময়কর কিছু তথ্য উপস্থাপন করেন। গবেষক দলটি প্লাইমাউথের তিনটি স্কুলের ৭ থেকে ১১ বছর বয়সী ২০৬ জন শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। প্রথম স্কুলটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি বেসরকারি একাডেমি এবং সেখানে সপ্তাহে ৯.২ ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমপূর্ণ শিক্ষা দেয়া হয়। অন্য দু’টি স্কুলের একটি ছিল গ্রামের এবং অপরটি শহরের সাধারণ স্কুল। এই দু’টি স্কুলে যথাক্রমে মাত্র ২.৪ ঘণ্টা ও ১.৭ ঘণ্টা করে সপ্তাহে পরিশ্রমপূর্ণ শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
শিশুরা ঠিক কতটুকু শারীরিক কসরত করছে, তার সঠিক চিত্র পাওয়ার জন্য গবেষক দলটি তাদের অ্যাক্টিগ্রাফস পড়তে দেন। এই হালকা কিন্তু আধুনিক যন্ত্রটির সাহায্যে শুধু শারীরিক নড়াচড়াই নয়, দেহ কতটুকু ব্যস্ত থাকল তার হিসাবও পাওয়া যায়। গবেষক দল ছাত্রদের সারা দিনের কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করেন। তারা দেখতে পান, তিনটি স্কুলের ছাত্ররা সারাদিনে গড়ে একই শারীরিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। দামি স্কুলটির ছাত্ররা বেলা ৩টার আগে অনেক বেশি শারীরিক পরিশ্রম করলেও সার্বিকভাবে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি কিছু করছে না। স্কুলে বেশি পরিশ্রম করার কারণে বাড়ি ফিরে তারা আর তেমন নড়াচড়া করে না। আর কিছু করার শক্তিও থাকে না তাদের। কিন্তু অন্য দু’টি স্কুলের ছাত্ররা কিন্তু বাড়ি ফিরে কেউ সাইকেল চালায়, কেউ দৌড়ায়।
ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা যায়, যেসব ছাত্র কিছু সময়ের জন্য দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে বল ধরে, সিঁড়ি ভেঙে ছোটাছুুটি করে, দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তারা কঠোর শারীরিক কসরতে ব্যস্ত ছাত্রদের মতোই স্বাস্থ্যবান।
তাহলে কি ব্যায়ামের দিকে ঠেলে দেয়ার কারণেই স্থূলতা সমস্যা বাড়ছে? কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর উত্তর হ্যাঁ। কারণ ব্যায়ামের ফলে শুধু দেহের মাংসপেশিরই ক্ষয় হয় না, সেই সাথে মস্তিষ্কের আত্মনিয়ন্ত্রণের ‘পেশি’ও শিথিল হয়ে পড়ে। প্রায়ই দেখা যায়, জিমে অনেকটা সময় কাটানোর পর অনেকেই অবসর সময়ে কিছু না কিছু খেয়েই চলেছে।
ব্যায়াম যারা করে, তারা অন্য কোনো দৈহিক পরিশ্রমপূর্ণ কার্যক্রমে অংশ নিতে চায় না। অল্প কোনো দূরত্ব তারা না হেঁটে গাড়ির অপেক্ষায় থাকে, সিঁড়ি না ভেঙে লিফটের আশ্রয় নেয়। সেই সাথে দোকানে গিয়ে এনার্জি ক্রয় তো আছেই।
আসলে সমস্যা ব্যায়ামে নয়, আসল সমস্যা হলো আমরা কিভাবে এটাকে সংজ্ঞায়িত করব তাই। অনেক স্থূলতা বিশেষজ্ঞ এখন বিশ্বাস করছেন, আধুনিক ধ্যান-ধারণা আবিষ্কৃত হওয়ার আগে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সার্বক্ষণিক ও স্বল্পপরিমাণে সার্বক্ষণিক যে শারীরিক কার্যক্রম চালাত সেটাই বর্তমানে জিমে গিয়ে কঠোর সাধনার চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, সারা দিন অলসভাবে বসে থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিট জিমে গিয়ে কঠোর অনুশীলনে লাভ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউরোবায়োলজিস্ট হ্যান্স-রুডলফ বারথোড বলেন, জিমে কঠোর ব্যায়াম করলে মাংসপেশিতে ব্যথার সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে আপনি নড়াচড়া করতে চাইবেন না বা পারবেন না। কিন্তু ক্যালরি পোড়াতে চাইলে মাংসপেশির নড়াচড়া চরম পর্যায়ে নেয়া যাবে না। সবচেয়ে ভালো হবে নড়াচড়াটা সারা দিনে বণ্টন করে দিতে পারলে।
মি. বারথোড নিজে তাই করেন। ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে তিনি তার প্রতিবেশীর বাড়িটির চার পাশে কয়েকবার চক্কর দেন। সম্ভব হলে লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করেন। তার মতে, অফিস থেকে বের হওয়ার সময় অনেকে কম্পিউটার চেয়ার থেকে উঠে লিফটে করে নিচে নামে। এখানেই আসল সমস্যা। আমরা জিমে গেলাম কি গেলাম না, সেটা সমস্যা নয়।
অবশ্য জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার উপকারিতার অনেক গল্পকাহিনী বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিনিয়তই শোনা যায়। তবে আপনি যদি গবেষণাপত্রগুলোর দিকে তাকান, তবে দেখতে পাবেন, সেখানে আপনাকে অন্য ধরনের উপদেশ দেয়া হচ্ছে। আপনাকে হাঁটতে, সিঁড়ি ভাঙতে বলা হচ্ছে।
তা ছাড়া কোনো কোনো রোগ প্রতিরোধের যে উপকারিতার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো নিয়েও ভাবা উচিত। এখন বিশেষ ধরনের ফিট থাকার চেয়ে বরং মোটামুটি মানের স্বাস্থ্য অনেক বেশি কাম্য বিবেচিত হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত মোটা লোকদের স্বাভাবিক ওজনে ফিরিয়ে আসতে ব্যায়াম তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করে না।
সব বৈজ্ঞানিক প্রমাণেই যখন বলা হচ্ছে, ব্যায়ামে ওজন হ্রাস পায় না, তবে এ সংক্রান্ত প্রচলিত বিশ্বাস গড়ে উঠল কেমন করে? মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭০ সালের আগে খুব কমসংখ্যক স্থূলতা গবেষকই ওজন হ্রাসের জন্য ব্যায়ামের কথা গুরুত্বসহকারে বলতেন। ১৯৯২ সালের দিকে বিল ক্লিনটন যখন তার জগিং আর ম্যাকডোনাল্ড অভ্যাসের কারণে বিখ্যাত হলেন, তখন আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে জানায়, সম্প্রতি স্থূলতার চিকিৎসার জন্য ব্যায়ামের পরামর্শ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে স্থূলতা চিকিৎসায় ব্যায়ামের অনিবার্য উপকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এতে সাধারণ শারীরিক কার্যক্রম হ্রাস পাওয়ার কথাও বলা হয়।
ইয়েলে কয়েক বছর ধরে কেলি ব্রাউনেল স্থূলতার চিকিৎসা করছেন। তার চিকিৎসার মূল পদ্ধতি হলো বেশি বেশি ব্যায়াম এবং কম কম খাবার। কিন্তু তবুও তিনি তেমন সাফল্য পাচ্ছেন না। তার মতে, মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর ওজন হ্রাস পাচ্ছে। আর এই ৫ শতাংশও যখন ব্যায়াম ছেড়ে দেয় তখন তাদের ওজন আবার বেড়ে যায়। তবে এখন তিনি বেশি বেশি ব্যায়ামের চেয়ে খাদ্য বিপণন ও পাবলিক পলিসির মধ্যে সমন্বয় করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, আপনি কত পরিশ্রম করলেন তার চেয়েও বড় হলো আপনি কতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করলেন, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য আপনার উচিত ব্যায়াম করা। তবে কঠোর ব্যায়াম করবেন না, তাহলে আপনার ওজন বেড়ে যাবে। ব্যায়াম করার পর একটু বেশি খাবার গ্রহণের লোভটি সামলাতেই হবে।

সংগ্রহ : অন্য এক দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!