প্রফেসর মুশিরুল হাসান ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ। তার বাবা মুহিবুল হাসানও ছিলেন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেন ১৯৬৯ সালে। পরে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ছিলেন দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার ভাইস চ্যান্সেলর। ২০১০ সালে ন্যাশনাল আরকাইভস অব ইন্ডিয়ার মহাপরিচালক করা হয় তাকে। তিনি পদ্মশ্রী।
ভারত বিভাগ নিয়ে মুশিরুল হাসানের কাজ উল্লেখ করার মতো। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তার লেখা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমান সমাজের সমস্যা, বামপন্থার ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে তার একটি একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে ভারতের একটি দৈনিকে। প্রফেসর মুশিরুল হাসানের সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: আমরা কি বলতে পারি ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং সেটাই এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলির সামনে একটা বড় বিপদ৷
মুশিরুল হাসান: আমি আপনার সঙ্গে একমত নই৷ আমি মনে করি ভারতের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক৷ ধর্মনিরপেক্ষ৷ নরেন্দ্র মোদী ও দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান সত্ত্বেও আমি এটাই মনে করি৷ দেখুন ভারত বিশাল দেশ৷ তা ছাড়া এ মুহূর্তে এ দেশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে৷ তার উপর ভিত্তি করে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না৷ আমার মনে হয় ২০১৪-র (লোকসভা) নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷
প্রশ্ন: কিন্ত্ত বাংলাদেশ যদি দেখি, সেখানে কিছু মানুষের ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে একটা মূলত শহুরে আন্দোলন তৈরি হয়েছে এবং যার প্রতিক্রিয়ায় গ্রামে ও মফস্বলে ইসলামি মৌলবাদীদের শক্তি এককাট্টা হচ্ছে৷ হিন্দু-বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হচ্ছে৷ পাকিস্তানে উগ্র ইসলামি শক্তির সমর্থন পেয়েছে নওয়াজ শরিফ সরকার৷ ভারতে নরেন্দ্র মোদী বি জে পি-র হাল ধরেছেন৷ সব মিলিয়ে আমরা কি একটা উদ্বেগজনক সাম্প্রদায়িক ভবিষ্যতের দিকে চলেছি?
মুশিরুল হাসান: এই যে ক’টি প্রবণতার উল্লেখ আপনি করলেন তার সব ক’টিই নিশ্চিত ভাবে অশুভ৷ দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদ, দক্ষিণপন্থী ইসলামি শক্তি বা শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণপন্থী বৌদ্ধদের উত্থান – এ সবই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়৷ কিন্ত্ত, দেখুন, আমাদের এই সব সমাজে সরকার পরিচালনার গুণগত মান উন্নত না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকেই আমি এই সব সমস্যার মূল হিসেবে দেখি৷ এবং এই ব্যর্থতার অঙ্গ অবশ্যই এই সব সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য৷ দরিদ্রের অবস্থার একেবারেই উন্নতি হয়নি৷ আর তা যখন হয় না, তখন তাদের হতাশা এই সব প্রবণতার রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়৷
প্রশ্ন: আপনি এই প্রবণতাগুলিকে মানুষের দারিদ্রের সঙ্গে যুক্ত করছেন?
মুশিরুল হাসান: এবং তার সঙ্গে সরকারি ব্যর্থতা৷
প্রশ্ন: কিন্ত্ত আপনার কি মনে হয় না এর ফলে বামপন্থী শক্তিগুলির একটা সার্বিক উত্থান হওয়া উচিত ছিল? কিন্ত্ত আমরা বামপন্থীদের পশ্চাদপসরণ দেখেছি৷
মুশিরুল হাসান: সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়৷আমি দুটো বিষয়কে জুড়তে চাইছি৷ প্রথমত, এই সরকার পরিচালনার ব্যর্থতা ও অধিকাংশ মানুষের দুর্দশা সত্ত্বেও মূলধারার বামপন্থীরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন, এবং তার ফলেই উগ্র বামপন্থার উত্থান৷
প্রশ্ন: আপনার কী মত?
মুশিরুল হাসান: আমি মনে করি তারা (মূলধারার বামেরা) বেশ কিছু ভুল করেছেন৷ সে কথা তারা স্বীকারও করেছেন৷ এর মধ্যে কৌশলগত ভুল আছে৷ এর মধ্যে আছে ভ্রান্ত ধারণা যার উপর ভিত্তি করে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ ভারতীয় বামপন্থীদের ক্ষেত্রে আমি বলব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যাকে বলা যায় বামপন্থী বিশ্ব কাঠামোর পতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানে বামপন্থা হয়তো জোরদার ভাবে বেঁচে থাকত যদি একটা আন্তর্জাতিক বামপন্থী আন্দোলন জীবিত থাকত৷
প্রশ্ন: দক্ষিণ আমেরিকায় তো আছে৷
মুশিরুল হাসান: হ্যাঁ ওখানে বামপন্থার পুনরুত্থান ঘটেছে৷ তবে আমি মনে করি ভারতে বামপন্থার ভাগ্য অন্য অনেক দলের সঙ্গে বা সমাজের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত৷ লাতিন আমেরিকায় কিন্ত্ত (বামপন্থীদের সঙ্গে অন্য দলের) প্রতিযোগিতার জায়গাটা বিশেষ ছিল না৷ তা ছাড়া সেখানে বামপন্থার উত্থানের একটা কারণ অবশ্যই মার্কিন নীতি৷
প্রশ্ন: আপনি বলছেন দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের প্রধান কারণ সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে সরকারের ব্যর্থতা এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিভিন্ন তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া৷ যেমন?
মুশিরুল হাসান: ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তির নানা দাবির মুখে কিছু কিছু বিষয়ে আত্মসমর্পণ করেছে৷ এমনকী বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা আলাপ আলোচনাও চালিয়েছে৷ যাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বলা যেতে পারে তাদের সঙ্গেও তারা (ধর্মনিরপেক্ষ দলেরা) যোগাযোগ রেখেছে৷ রাজনৈতিক দলগুলি মনে করেছে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা প্রয়োজন৷
প্রশ্ন: সেটা কী তাহলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার ইঙ্গিতবাহী?
মুশিরুল হাসান: না৷ তা আমি বলব না৷ এর অন্য অনেক জোরের জায়গা আছে৷ সার্বিক ভাবে এই সমাজ অসাম্প্রদায়িক, যদি ধর্মনিরপেক্ষ নাও হয়৷
প্রশ্ন: একটা বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি – ফতোয়া৷ আমার মনে পড়ছে ধরুন মহান আমির খুসরুর সেই লাইন: আমি প্রেমের কাফের, মুসলমানিতে আমার কোনো কাজ নেই৷ বা কবিদের কবি বলে পরিচিত মীর তকি মীর-এর সেই পংক্তির কথা: মন্দিরের দুয়ারে বসে তিলক কেটেছি, কবেই তো ছেড়েছি ইসলাম৷ তাদের বিরুদ্ধে, তাদের শুধরে দিতে ফতোয়া জারি হয়েছে এমন তো কখনও শুনিনি৷ ফতোয়ার ব্যাপারটা আসলে কী?
মুশিরুল হাসান: প্রথম কথা এই সব (ফতোয়ার খবর) এখন অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে৷ এবং সে সব খুব বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হয়৷ কে যে কী জারি করছে কার হয়ে, আমরা জানতে পারি না৷ মুসলমানদের সমালোচনা করার একটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ফতোয়া৷ আমি বলছি না ফতোয়া দেয়া হয় না৷ এর মধ্যে কিছু কিছু ফতোয়া জারি করা যে উচিত হয়নি তা-ও নয়৷ কিন্ত্ত আমি মনে করি এই বিষয়টাকে মুসলমানদের সমালোচনা করার জন্যে, তাদের খারাপভাবে দেখানোর জন্যে ব্যবহার করা হয়৷ আমাদের সমাজে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা আর এস এস-এর মতো সংগঠনও আছে৷ তারা কী প্রচার করেন এবং কার্যক্ষেত্রে কী করেন তা খেয়াল করুন৷ কিন্ত্ত ফতোয়ার মতো এমন কোনো বিভাগ নেই যা এক কথায় তাদের মৌলবাদ, তাদের গোঁড়ামি প্রকাশ করতে পারে৷ আছে কী? (হাসতে হাসতে) সে রকম একটা কিছু তৈরি করতে পারলে বেশ হয়৷ আমার মনে হয় প্রত্যেক সমাজেই আধ ডজন খানেক পাগল থাকে৷ এই একশো তিরিশ কোটির দেশে কিছু ছিটগ্রস্ত মানুষ আছেন, যারা ফতোয়ার কার্যকারিতায় বিশ্বাস করেন৷ আমি মনে করি না এদের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ এবং গোটা (মুসলমান) সম্প্রদায়কে এই দিয়ে বিচার করা উচিত নয়৷
প্রশ্ন: মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এর গুরুত্ব কতটা?
মুশিরুল হাসান: আমার মনে হয় না খুব একটা গুরুত্ব আছে৷ দেখুন, মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে এভাবে বাঁচে না৷ ভারতীয় সংবিধানের সব ধারা কি কেউ তার প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলেন? চলেন না৷ কিছু মানুষ কোনো স্থানীয় মোল্লার ফতোয়া মেনে চলতে পারেন৷ কিন্ত্ত বাগদাদ বা কায়রোতে জারি করা ফতোয়ার (এখানে) অধিকাংশ মানুষের কাছে কোনো মানেই হয় না৷ একেবারে ধর্মীয় বিষয়ে (ফতোয়া) হলে হয়তো কিছুটা মানে আছে৷ আবার এটাও ঠিক যে মুসলমান সমাজ বিভিন্ন স্তরে এত বিভক্ত, যেমন আপনি যদি শিয়া হন, আল আজহার-এর ফতোয়ার কোনো মানেই নেই৷ আপনি যদি হানাফি হন তাহলে কোম-এর ফতোয়ার কোনো মানেই নেই৷ বরেলভিরা আলাদা৷ দেওবন্দিরা আলাদা৷ এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো ভুললে চলবে না৷
প্রশ্ন: এই প্রসঙ্গে বলি, সালমান রুশদি নিজেই বলেছেন যে তাকে গত বছর এখানে বইমেলায় আসতে দেয়া হয়নি৷ এবং তার পরেই অনেকে এখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ তুলেছেন…
মুশিরুল হাসান: ঠিক সেই কথাই তো আমি বলছিলাম৷ মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের কিছু কিছু ধারণা আছে৷ এই ধারণাগুলোকে এবার আমাদের চ্যালেঞ্জ করা দরকার৷ কারণ ধারণাগুলো ভ্রান্ত৷ আপনি মনে করেন সালমান রুশদি ভারতে আসলে মুসলমানরা অপ্রসন্ন হবেন৷ চেষ্টা করে দেখুন৷ তাকে আসতে দিন৷ ঝুঁকিটা নিন৷ হয়তো দেখবেন কিছুই হয়নি৷ দশ জন বা কুড়ি জন বা একশো জনও বিক্ষোভ দেখালে, সেটাতে রাজনীতিকরা অভ্যস্ত৷ কিন্ত্ত এ থেকে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন সেটা ভুল৷
প্রশ্ন: মুসলমানদের প্রতি কি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়?
মুশিরুল হাসান: অবশ্যই করা হয়৷ কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত বড়ো বড়ো এলাকাগুলির দিকে একবার তাকান৷ এভাবে কি মানুষ বাস করতে পারে? পৃথিবীর কোথাও করে? তাদের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা হয়েছে? মোটেই হয় নি৷ কারণ তারা মুসলমান৷ এবং গরিব মুসলমান৷ বাস্তব এটাই যে মুসলমান এলাকায় নাগরিক পরিষেবা প্রায় নেই বললেই চলে৷ একই শ্রেণির মুসলমান ও হিন্দুরা যে ভাবে বসবাস করেন তার মধ্যে তুলনা করুন৷ তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন৷ বহু শহরেই এটা আমি দেখেছি৷ এ নিয়ে আমি পড়াশুনা করেছি৷ লিখেওছি৷ তবে, কলকাতা নিয়ে এ রকম কথা আগে বলিনি৷
প্রশ্ন: পশ্চিমবেঙ্গর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইমামদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছেন৷ সরকারের এই সিদ্ধান্তে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মুশিরুল হাসান: এ সব রাজনৈতিক সুবিধাবাদী পদক্ষেপ৷ এতে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনো উপকার হবে না৷ শুধু ইমামদের জন্য ভাতা কেন? মুসলমান মহিলাদের জন্য নয় কেন? রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের তো অনেক বেশি সাহায্য দরকার৷ যদি সত্যি কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে হয় তা হলে তা দেওয়া উচিত মুসলমান মেয়েদের৷ তাদের শিক্ষার জন্য৷ সে কাজটা করুন৷ ইমামদের ভাতা দেয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়ার সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না৷
প্রশ্ন: গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক সাফল্য এবং তার ভিত্তিতেই জাতীয় স্তরে তার উত্থান৷ এ বিষয়টাকে আপনি কী চোখে দেখছেন?
মুশিরুল হাসান: দেখুন, এ দেশের কর্পোরেট দুনিয়া বরাবরই প্রতিক্রিয়াশীল৷ এবং অত্যন্ত গোঁড়া৷ এবং বলতেই পারি তারা অত্যন্ত মুসলমানবিরোধী৷ বড়ো বড়ো কর্পোরেটগুলিতে মুসলমানদের সংখ্যা দেখুন৷ প্রায় নেই বললেই চলে৷ কাজেই কর্পোরেট সেক্টর মোদীকে বেশ পছন্দ করে৷ সংবাদমাধ্যমও সেটাই করছে৷ অনেক কিছু ঘটছে তার কারণ, সংবাদমাধ্যমের উপর কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাব৷ কাজেই যে মূল কথাটা আমি বলতে চাই তা হলো সংবাদমাধ্যম আর কর্পোরেট সেক্টরের একটা গাঁটছড়া, যেটা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এই দুইয়ের মতাদর্শগত অবস্থানের একটা মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে৷
প্রশ্ন: আপনার মতে নরেন্দ্র মোদীর মতাদর্শগত অবস্থানটা কী?
মুশিরুল হাসান: আমি নরেন্দ্র মোদীকে আধা ফ্যাসিস্ট মনে করি৷ বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার পর নরেন্দ্র মোদী যে সব বক্তব্য রেখেছেন আমার এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করেছে৷ আপনি যদি তার বক্তব্য, তার কাজের ধরন, তার দম্ভ, তার ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মূল্যবোধগুলি অস্বীকার করার প্রবণতা, ভালো করে দেখেন, সেগুলো পর্যালোচনা করেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন তার মতাদর্শগত চিন্তার মধ্যে একটা আধা ফ্যাসিবাদ রয়েছে৷ কাজেই আমি তার কাছ থেকে খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ কোনো বিশ্ববীক্ষণ আশাও করি না৷ দেখুন ইউরোপে কী হচ্ছে- উগ্র দক্ষিণপন্থা ফিরে আসছে৷ সেই প্রবণতা এদেশেও দেখা যাচ্ছে৷ আমি আশা করি, মানুষ এই বিভেদমূলক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করবেন৷ আশা করি, ‘মোদী ফেনোমেনা’ বলে যেটা চালানো হচ্ছে তা প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্তি ও দায়বদ্ধতা রাজনৈতিক দলগুলিরও রয়েছে৷ আমি মনে করি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সমাজে সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল৷ সে সময় সংবাদমাধ্যম সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে সাহায্য করেছিল৷ কিন্ত্ত এখন তা ক্রমাগত বিভেদ সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছে৷ আপনি যদি সংবাদমাধ্যমের অতীত ও বর্তমান ভূমিকা তুলনা করে দেখেন, তা হলেই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন৷
প্রশ্ন: রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আসি, এক দিকে ইউপিএ সরকার, যার বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ৷ অন্য দিকে বিজেপি যার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ৷ আর এক দিকে বেশ কিছু ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দল যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই চরম দুর্নীতির অভিযোগ৷ ভারতীয় ভোটারদের সামনে বিকল্পটা কী?
মুশিরুল হাসান: যাই বলুন না কেন, স্থানীয় দলগুলির নেতারা নিজের নিজের এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ জাত-পাত ও স্থানীয় রাজনীতির উপর ভিত্তি করা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিকল্প কী হতে পারে সেটা আপনি বা আমি ঠিক করব না৷ সে বিকল্প খুব সোজাসাপটাও হবে না৷ এই জোট রাজনীতির যুগে বিকল্পের মধ্যে বৈচিত্র প্রতিফলিত হতে বাধ্য৷ দেখুন নীতীশ কুমারের সরকারের সঙ্গে কিন্ত্ত বি জে পি-র বহু দিন একটা জোট ছিল৷ মুসলমানরা সেটাকে খুব একটা খারাপ চোখে নেয়নি৷ আশা করি, নির্বাচন এবারে মোদীর সব আশা চিরকালের মতো শেষ করে দেবে৷
প্রশ্ন: মূলধারার বামপন্থীদের অবস্থা খারাপ কিন্ত্ত আমরা দেখছি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের একটা বড়ো জায়গা জুড়ে মাওবাদী উগ্র বামপন্থীরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে৷ আপনার প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান: দেখুন, এ সবই বৈষম্যজনিত ক্ষোভের প্রকাশ৷ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা কোনো কাজের কথা নয়৷ রাষ্ট্র একটা বাস্তব৷ সেই বাস্তবকে মেনে নিতে শিখতে হবে৷ রাষ্ট্রের সঙ্গে দরাদরি করতে হবে৷ নিজেদের অনুগামীদের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলার এর থেকে ভালো আর কোনো পদ্ধতি নেই৷
প্রশ্ন: একটা অভিযোগ প্রায়ই ওঠে৷ মুসলমানরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় কাজ করতে পারেন না৷ অনেকের মতে, তত্ত্বে যাই বলা থাক না কেন, দু-একটি রাষ্ট্র ছাড়া বাস্তবেও এটাই দেখা গিয়েছে৷ আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
মুশিরুল হাসান: আমার প্রতিক্রিয়া হবে একটি পাল্টা প্রশ্ন- মুসলমানদের কি কখনও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কাজ করতে দেওয়া হয়েছে? ঔপনিবেশিক সরকার তো আর গণতন্ত্র দিতে পারে না৷ ১৯৫০-এর দশক অবধি বহু মুসলমান রাষ্ট্রই ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ছিল৷ কাজেই আমরা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের কথা বলছি তাই নয় কি? মাত্র ছয় দশকের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এত বড়ো একটা কথা বলা হচ্ছে৷ মনে রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক শাসন ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধরনও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ছিল৷ ইসলাম ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না, এ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা৷ মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র কাজ করে, ইন্দোনেশিয়ায় করে, বাংলাদেশে করে৷ ইরানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ কিন্ত্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষতি করেছে৷ মিশরে গামাল আবদেল নাসের গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানেও সমস্যার সৃষ্টি করেছে৷ ঐতিহাসিক কারণেই আরব দেশগুলিকে এর মধ্যে ধরছি না৷ কারণ, সেগুলি তৈরি হয়েছে আদিবাসী সমাজ থেকে অথবা রাজতন্ত্র থেকে৷ এখন আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আগলে রেখেছে৷ সৌদি আরবে গণতন্ত্রের কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে৷ কাজেই আমরা এই প্রশ্নগুলি কেন তুলি না? কেবল ভুল প্রশ্নগুলি তুলি৷ প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিক সমাজ সৌদি আরব বা কুয়েতের মতো দেশকে কখনও গণতান্ত্রিক হতে দেবে কি না৷ যতক্ষণ পর্যন্ত এই সব রাজ্যে তেল আছে, ততক্ষণ অন্তত নয়৷