আত্মহত্যা এক প্রকার অস্বাভাবিক মৃত্যু, যা কারো কাম্য নয়। পৃথিবীর গতিময়তা ও অতি আধুনিকতার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। কারণ যাই হোক, পৃথিবীকে যারা আর বাসযোগ্য মনে করছে না, পৃথিবীর মানুষগুলোকে যারা আর বিশ্বাস করতে পারছে না, যারা নিজেকে অবহেলিত অপাঙ্ক্তেয় মনে করছে, অনুশোচনা আত্মগ্লানিকে যার জীবন ভরে গেছে, যাকে কেউ ভালোবাসে না বলে বিশ্বাস জন্মেছে ও সর্বোপরি যে তার অবস্থানটা পৃথিবীতে আর আগের মতো খুঁজে পাচ্ছে না সেই আত্মহননের মতো নিষ্ঠুর পথ নিজের জন্য বেছে নেয়।
এই একবিংশ শতাব্দীতে ইতোমধ্যেই পাঁচ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫০ লাখ লোক আত্মহত্যা করেছে। প্রতি বছরই গড়ে ১০ লাখের মতো লোক বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যা করছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও পরহত্যার চেয়ে বেশি লোক মারা যায় আত্মহত্যা করে। পৃথিবীতে আত্মহত্যার গড় লাখে ১৪.৫ জন হলেও বাংলাদেশে এ হার লাখে ৮-১০ জন। এসব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট। একজন মানুষ যিনি অফিস-আদালত করছেন, ঘর-সংসার করছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, বাজারঘাটে যাচ্ছেন হঠাৎ করেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটালে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারসহ পরিচিত মহলে বিষয়টা আলোচিত হয় এবং পরিবারে এক ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে।
স্ট্রোকের রোগী দীর্ঘ দিন বিছানায় শুয়ে থেকে এক সময় আট-দশ বছর পর মৃত্যুবরণ করলে আত্মীয়দের মেনে নেয়া যেমন সহজ আত্মহত্যার মৃত্যুকে মেনে নেয়া কঠিন। তাই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যা সম্পর্কে আমরা খুব জানি। আর এ ব্যাপারেও সচেতনতার অভাব রয়েছে যথেষ্ট। আমাদের দেশে মহিলারা বিশেষ করে অশিক্ষিত গৃহিণীরা বেশি আত্মহত্যা করেন অথচ পাশ্চাত্য দেশে পুরুষেরা আত্মহত্যা করেন বেশি। ১১-২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ৭৪.৬১ শতাংশ পারিবারিক কলহ বিবাদ, বৈবাহিক সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক রোগ, প্রেমে বিফলতা, যৌতুকের চাপ, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব, অবৈধ যৌনকর্ম, অবৈধ সন্তান ধারণ, সঠিক শিক্ষা ও সামাজিক ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবই আমাদের দেশে চিহ্নিত আত্মহত্যার কারণ। মানসিক রোগী ও নেশাকারীরা মিলে ৯০ শতাংশ আত্মহত্যা করে। বাকি ১০ শতাংশ করে অন্যরা। যে কারণগুলো উল্লেখ করলাম ড্রাগ সেবনকারী ও মানসিক রোগীদের জন্য ওই সব সমস্যা সৃষ্টি করা কোনো ব্যাপারই নয়।
মানসিক রোগীদের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে বিষণ্ন রোগীরা (৪.২ শতাংশ), যাদের পারসোনালিটি প্রবলেম আছে তারা করে ৭.৭ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়া ২.৮ শতাংশ । শারীরিক রোগীদের মধ্যে মৃগীরোগীরা (৩.৮ শতাংশ) বেশি আত্মহত্যা করে। তার পরই আছে গ্যাস্ট্রিক রোগীদের অবস্থান (২.৯ শতাংশ)। প্রস্রাবে সমস্যা, যৌন সমস্যা, কোমরে ব্যথা ও মাথাব্যথার কারণেও আমাদের দেশে আত্মহত্যা করছে লোকজন। আমাদের দেশে ঝিনাইদহে আত্মহত্যার হার খুব বেশি। লাখে ২৯-৩৩ জন। এত বেশি কেন বিষয়টা অপরিষ্কার। সম্ভবত সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান অস্থিরতা, চোরকারবারিদের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সন্ত্রাসী তৎপরতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নিষিদ্ধ কিছু সন্ত্রাসী সংগঠনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতি নির্যাতন-আত্মহত্যার উঁচুহারের কারণ হবে।
হয়তো ঝিনাইদহের আত্মহত্যার রিপোর্টিং বরাবরই ভালো ছিল। আর বলা চলে সোস্যাল ইমিটেশনের কথা। আত্মহত্যাকারীদের আত্মহনন থেকে অন্যরা এ সহজ কাজটাতে উৎসাহিত হয়। পাশ্চাত্য দেশে গুলি করে আত্মহত্যা করার হার বেশি হলেও আমাদের দেশে কীটনাশক ওষুধসহ অন্যান্য বিষপানে আত্মহত্যার হার খুব বেশি (৫৮.৪৬ শতাংশ)। এ ছাড়া গলায় ফাঁস দিয়ে (৪০.৯০ শতাংশ) এ দেশে আত্মহত্যা করে অনেক লোক। বাকিরা গলা কেটে। উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে বা ট্রেন-বাসের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
অনেকেই গুলি করে বা নদীতে ঝাঁপ দিয়েও আত্মহত্যা করে। বিষপানের মধ্যে ধুতুরা, মদ, ঘুমের বড়ি, অন্যান্য সেব্য ওষুধও রয়েছে। কীটনাশক হাতের কাছে গ্রামগঞ্জ ও শহরে খুব সহজেই পাওয়া যায় বলে এ পথই বেশির ভাগ লোক বেছে নেয়। আত্মহত্যা পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত উভয় প্রকারেরই হতে পারে। যারা পরিকল্পিতভাবে সুইসাইড করে তারাও অনেক সময় বিষয়টা গোপন রাখে। অপরিকল্পিত সুইসাইড যারা করে তারা রাগের মাথায় হঠাৎ করে এ কাজ করে, যে ব্যাপারে ১০ মিনিট আগেও সে নিজেই জানত না। এটাকে ইমপালসিভ সুইসাইড বলে। যারা আত্মহত্যা সফলভাবে করে ফেলেছে আত্মহত্যা করার জন্য চেষ্টা চালায় ১০-২০ গুণ বেশি লোক। যেকোনো কারণেই হোক বাকিরা সফল হয় না। অনেকে আত্মহত্যার উদ্দেশে গলায় ফাঁস দিতে গিয়ে যেন কেউ দেখে ফেলার কারণে বেঁচে যায়, তদ্রূপ কেউ কেউ বাবা-মায়ের কাছ থেকে দাবি আদায়ের জন্য অভিমানী মেজাজে ঘুমের বড়ি খেয়ে সত্যি সত্যি মরে যায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘটনা ঘটে যায়, দাবি আদায় আর হয় না। আত্মহত্যার তীব্র নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে চেনার কিছু উপায় আছে। এরা তার ইচ্ছাটা অন্যকে জানায়। সুইসাইড নোট লেখে, সম্পত্তি অন্যকে ‘উইল’ করে দেয়, অসমাপ্ত কাজ দ্রুত সমাপ্ত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। সামান্য ব্যাপারে ঝগড়া করে, রাগ করে, নিজের হাত-পা কাটে ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। অতি গোপনীয়তা বজায় রেখে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, অপেক্ষাকৃত গুরুতর মাধ্যম (গুলি করে) ব্যবহার করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।
আত্মহত্যা হোক কি না হোক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে প্রমাণ হলেই এটা আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আত্মহত্যা অগ্রহণযোগ্য। যদিও অন্যান্য ধর্মে এ ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে এবং কোনো কোনো ধর্মে এটা অনুমোদিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিনে আত্মহত্যা যে ইসলামে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত এ কথাটা খুব স্পষ্টভাবেই এসেছে। এ ক্ষেত্রে যারা মানসিক রোগী তাদের কথা অবশ্যই ভিন্ন। পরকালের শাস্তির কথা চিন্তা করেও ইসলাম ধর্ম অনুসারীরা কম আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারীর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এক ধরনের অপরাধপ্রবণতা কাজ করে অনাবশ্যকভাবে। সামাজিক কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হন পরিবারের সদস্যরা। আত্মহত্যা প্রতিকার বা প্রতিরোধের উপায় কী? আত্মহত্যাকে সমাজ থেকে গুটিবসন্তের মতো উপড়ে ফেলা যাবে না, যেহেতু এর কোনো ভ্যাকসিন নেই। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হয়তো আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে তা হচ্ছে : আত্মহত্যার মাধ্যমগুলোর প্রতি চোখ রাখা। যেহেতু আমাদের দেশে বিষপানে আত্মহত্যা করে বেশি লোক, তাই এসব উপকরণ দুষ্প্রাপ্য করতে হবে। বিনা প্রেসক্রিপসনে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও নাটক সিনেমার মাধ্যমে আত্মহত্যার ব্যাপারে লোকদেরকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে বিষণ্নতা ও ড্রাগসেবীদের ব্যাপারে আলোকপাত করতে হবে। তবে মিডিয়াকে অবশ্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন একই রিপোর্ট বারবার প্রচার না হয়। এটা হিতে বিপরীত হতে পারে। মানসিক ও শারীরিক রোগীদের সময়মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। রোগী নিজের বা আত্মীয়-স্বজনেরা উদাসীনতা অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে পরিহার করতে হবে। যারা আত্মহত্যার কথা বলে তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জরুরি বিভাগগুলোতে আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের জরুরি চিকিৎসা দেয়ার বন্দোবস্তু থাকতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থা গোষ্ঠী প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করবে। পারিবারিক কলহ-বিবাদ মেটানো বা কমানোর জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। এটা এক দিনে হয় না। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন। আত্মহত্যা কমানোর জন্য একটা জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা এখনই প্রয়োজন। তাহলে অনেক কিছুই খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। যে কারণে সমাজ বা পরিবারে কলহ হানাহানি তা কমিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে গোষ্ঠীস্বার্থকে। সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতার উদাহরণ সৃষ্টি করে আত্মহত্যার ইচ্ছাপোষণকারীকে ভালোবাসতে তাকে তার অবস্থানে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন সবার মানসিক গড়ন এক নয়। তাই রাগ, ক্ষোভ, আবেগও ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন।
এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে বন্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, শিক্ষার হার বাড়ানো, বেকারত্ব কমানো, নেসার উপকরণ দুষ্প্রাপ্য করা, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে অটুট রাখার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে জাপান অর্থনৈতিকভাবে একটা সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আত্মহত্যার হার বাংলাদেশের তিন গুণ। ধর্ম যেহেতু সন্তানের অধিকার, পিতামাতার অধিকার, আত্মীয়তার বন্ধন, প্রতিবেশীর অধিকার ও অন্যের অগ্রাধিকারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের বলে দেয়, তদ্রুপ অর্থনৈতিক বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের ব্যবস্থা করে। ধর্মীয় অনুশাসনই আমাদের ধৈর্যশীল, অনুগত, দরদি, সহনশীল ও ত্যাগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সুতরাং ইসলামকে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে পালন করতে পারলেও আত্মহত্যার হার খুব দ্রুতই কমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আত্মহত্যার ইচ্ছাপোষণকারী ব্যক্তিকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা না করে তাকে ভালোবাসতে পারলে সে মনে করবে পৃথিবী আর যন্ত্রণার স্থান নয়, এটা আনন্দের স্থান- অতএব বেঁচে থাকাটা খুবই দরকার।
সুত্র – দৈনিক নয়া দিগন্ত