এ্যাড. তৌহিদা আক্তার নাজনীন ।।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেছি ৯৬ ব্যাচে, হল ছেড়েছিলাম ৯৮ এ, রেজাল্ট বের হয়েছে ২০০০ সালে। সেই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার বিচ্ছেদ ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০০১ সাল থেকেই ঢাকার বাইরে কেটেছে স্বামীর কর্মস্থল ঘুরে ঘুরে। কখনো লালমনিরহাট, ঠাকুরগাও, কখনো রাজবাড়ী, ফরিদপুর কখনো ভোলা, মুন্সিগঞ্জ। অবশেষে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন ২০১২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিচ্ছেদ চাইনি কখনো। তাই ঢাকা ছাড়ার সময়ই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ঢাকায় ফিরেই এম.ফিল-এ ভর্তি হয়ে যাবো। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভর্তিও হয়ে গেলাম। বিষয় : ভাটি অঞ্চলের গানঃ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যালোচনা। প্রথম পর্ব শেষ করেছি, এখন বাকি শুধু লেখালেখির কাজটুকু। আর এই লিখতে গিয়েই খেয়াল করলাম গভীরভাবে নারীর আকুতি মাখা গানগুলো। আগে মাঝে মাঝে পরিচিত ও বহুল প্রচারিত গানগুলো শুনলেও এতোটা উপলব্ধি করিনি যতটা এখন উপলব্ধি হচ্ছে লিখতে গিয়ে। কী গভীর মমতা ও বাস্তবতার নিরিখে লেখা হয়েছে গানগুলো। ভাটিয়ালী, লোক ভাওয়াইয়া, লালন, রবীন্দ্র, নজরুল ও আধুনিক অনেক গানে নারীর আকুতির বাস্তবরূপ আমরা পর্যবেক্ষণ করি। বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে এর প্রতিফলন দেখতে পাই। আজও এরকম কিছু গানে নারীর আকুতি নিয়ে একটা পর্যালোচনা করতে চাই। যেহেতু আমি ভাটি অঞ্চলের কন্যা। তাই প্রথমে ভাটির গানে নারীর আকুতিগুলো তুলে ধরবো-
ভাটিয়ালী গানের রচয়িতা প্রবাদ পুরুষ শাহ আব্দুল করিম, তার বিভিন্ন গানে নারীর প্রাণের আকুতি তুলে ধরেছেন। এই বাংলায় যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন কতশত নামী গুণী বাউল সাধক, যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লালনশাহ, হাসনরাজা, অন্ধ গোপাল, রাধারমন, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, শীতলং শাহ, শেখ বানু, সৈয়দ শাহ নূর, সরদ বাউলসহ আরো নাম না জানা বহু জন। তাদের মধ্যে অন্যতম শাহ আব্দুল করিম। তার গানে নারীর প্রাণের আকুতি শুনে মুগ্ধ বনে যেতে হয়ঃ
আইলায় না, আইলায়নারে বন্ধু
করলায়রে দেওয়ানা।
সুখ বসন্ত সুখের কালে বন্ধু
শান্তি তো দিলায় নারে
বন্ধু আইলায় নারে।
প্রাণ বন্ধুর জন্য এই আকুতি বিদগ্ধ হৃদয় মাত্রই জানে। প্রাণের আকুতি মেশানো আকুল করা গানগুলো অমর হয়ে থাকুক সকল বিরহী হৃদয়ে। শাহ আব্দুল করিম অন্য একটি গানে বলেছেন-
সখি, কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণ নাথ আসিতে পারে।
প্রাণ বন্ধুর জন্য এই যে অপেক্ষা-প্রতিক্ষা এর অদ্ভুত প্রতিফলন দেখা যায় এই গানে। প্রতিক্ষার প্রহর কাটানো কত যে কঠিন।
আমরা যদি আরো একটু আগে ফিরে যাই তাহলে দেখবো বিভিন্ন প্রকার গান যেমন যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, মেয়েলীগান, বারো মাসী গানেও আমরা নারীর প্রণের আকুল আকুতি উপলব্ধি করতে পারি। শাহ আব্দুল করিমের আরো একটি গান আছে-
বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে, কী যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে।
এসব গানে কিন্তু প্রেমিক পুরুষেরও প্রেমের অনুভূতি প্রাকাশ পায়। অদ্ভুত সুন্দর এসব গানের আকুতি। ভাটির প্রবাদ পুরুষখ্যাত অন্যতম আরো একজন হলেন-
উকিল সুমী। তার গানের কথা ও সুর নারী হৃদয়কে আরো বিমোহিত করে-
আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে
পূবালী বাতাসে, বাদাম দেইখা
চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসে রে।
দীর্ঘদিন বাবার বাড়ীতে যেতে না পারার কষ্ট ফুটে উঠেছে এই গানে, তাঁর এই গানের মতো অন্য আরেকটি গান আছে, যার সুরকার ও গীতিকার ভাটির অন্যতম আরেক পুরুষ-
শচীন দেব বর্মন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত একটি গান হল-
কে যাস রে, ভাটির গান গাইয়া
আমার ভাই ধন রে কইও নাইওর নিতো আইয়া।
নারীর এই চিরায়ত হাহাকার, বাবার বাড়িতে নাইওর যাওয়ার এই ব্যকুলতা, পুরুষ শাসিত সমাজের অন্যতম একটি চিত্র এই গানে প্রতিয়মান। বাড়ির বৌ এর প্রতিক্ষার প্রহর শেষ হয়ে যায় তবুও তার ভাই নাইওর নিতে আসে না।
এখন যদি উত্তর বঙ্গেঁর ভাওয়াইয়া গানের দিকে তাকাই তাহলেও নারীর প্রাণের হাহাকার আমরা দেখতে পাবো। ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে অন্যতম একটি হলঃ
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কতরব আমি পথের দিকে চাইয়া রে রে।’
আরো একটি বিখ্যাত গান, যা সবার মুখে মুখে ফেরে-
‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাও রে।’
বঞ্চিত নারী হৃদয়ের হাহাকার পূর্ণ এসব গান কালজয়ী। ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়ার মতো অসংখ্য আধুনিক গানে মিলনের চেয়ে বিরহ-বিচ্ছেদের গান বেশী যা কি-না নারী হৃদয়ের হাহাকার পূর্ণ, না পাওয়ার বেদনা, বঞ্চিতের আকুতি।
‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগেনা
এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো।’-প্রবঞ্চনার স্বীকার নারী হৃদয়ের ব্যাকুল অনুভূতি ভরা গানটি।
আরো আছে-
“আমার ঘুম আসে নারে, একা ঘরে শুইলে
তোমরা নি দেখছো আমার শ্যামগোকুলে।”
এই ধাঁচের আরেকটি গান, যার সুরকার ও গীতিকার ভোলা জেলার দৌলতখানের সাধক পুরুষ- বাদল প্রসাদ ঘোষ, তিনি লিখেছেন-
ও আমার কালিয়া বন্ধুরে
তুমি আইবা আইবা বলে
আশায় আশায় দিন কাটেনা
কেমনে মানাই অবুঝ মনটারে। রাধা, কৃষ্ণ প্রেমে যখন মত্ত কখন শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদ তাকে পাগল করে দেয়, আশায় আমার তার দিন কাটেনা। বিনোদিনী রাধার প্রেম বিরহের প্রতিচ্ছবি যে, এই গানটি। কালজয়ী এই গানটি দক্ষিনাঞ্চলে খুব প্রচলিত একটি অন্যতম গান।
তিনি আমার সংগীত গুরুও বটে। আকুল করা তাঁর এই গান একটি অমর সৃষ্টি। আধুনিক গীতিকার মনিরুজ্জান মনির এর এই ধাঁচের আরেকটি গান আছে-
জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি
কোথা তুমি থাকরে
দাও না দেখা বন্ধু আমারে।
প্রাণে প্রেমের দোলা দিয়ে, নিরুদ্দেশে থাকা প্রেমিক পুরুষের জন্য নারীর হাহাকার স্পষ্টত এ গানে প্রতিয়মান। মহুয়া-মালুয়া, চন্দ্রাবতীর দেশ, এই বাংলাদেশে গানের প্রাচুর্য্যরে মাঝে মননিবেশ করতে চাইলে এসব গানের মর্ম উপলব্ধি করতে হবে আগে।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের ভান্ডারে এখনো প্রবেশই করতে ফুরসত পাইনি। এই অফুরন্ত ও অপূর্ব গানের ভান্ডার থেকে নারীর বিরহী হৃদয়ের কিছু আকুতি মাখা গান তুলে ধরছি-
* রোদন-ভর এ বসন্ত, সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে মোর বিরহ বেদনা রাঙ্গালো কিংশুক রক্তিম রাগে।
* বসন্ত সব সময় সুখের হয় বলেই আমরা জানি, কিন্তু প্রেমিক হৃদয়ে বসন্তেও রোদন হয়ে আসে। এমন আরো অসংখ্য গানের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর গানের তালিকা বিশাল-
* সখী, ভবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা’ ভালোবাসা
সখী ভালবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলি যাতনাময়।
আরো এমন ধাঁচের/আঙ্গিকের গান-
* না সজনী, না, আমি জানি জানি, সে আসিবেনা
এমনি কাঁদিয়ে পোহাইবে কামিনী,
বাসনা তবু পুরিবে না।
* যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে মোর ঘরে।
* সহে না যাতনা, দিবস গনিয়া গনিয়া
বিরলে, নিশিদিন বসে আছি
শুধু পথ পানে চেয়ে।
নজরুল গীতিতে নারীর বিরহী প্রাণের প্রতিচ্ছবিও স্পষ্টতই আমরা উপরব্ধি করি।
* শাওনও রাতে যদি, স্মরনে আসে মোরে
বাহিরে ঝড়ও বহে নয়নে বারী ঝরে।
* হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়াই ঝড়াফুল একেলা আমি।
* পথহারা পাখী কেঁদে ঘোরে একা
আমার জীবনে শুধু আধারের লেখা।
* শূণ্য এ বুকে পাখী মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়
তোরে না হেরিয়া সাকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।
* আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়।
মোছ আখি দুয়ার খোলো, দাও বিদায়।
আরো অনেক অনেক গান আছে, যেসব গানের বাণী ও গাথুনী অত্যন্ত গভীর, যা সমাজের বিভিন্ন ঘটনারই প্রতিফলন। নারী হৃদয়ের চিন্তা, চেতনা, প্রেম ও বিরহপূর্ণ এসব গান তাই কালজয়ী। মৌলিক এ গানগুলো যেন বর্তমান যন্ত্রের দাপটের ভিড়ে হারিয়ে না যায়। গানের তাল, সুর ও লয় ঠিক থাকলে ভাবাবেগও ঠিক থাকবে। বর্তমানে যন্ত্রের এত নির্ভরশীলতা বেড়েছে যেন, গানের কাথাও ঠিক মত শোনা যায় না, শোনা যায় শুধু যন্ত্রের আওয়াজ। অনেক বিদেশী সঙ্গিতজ্ঞ এখনো ভালোবাসে বাংলার এই কালজয়ী গানগুলো, তারাও গাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে এসব গানের উপর গবেষণাও করতে আসেন বাংলাদেশে।
লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, ঢাকা।