কারার মাহমুদুল হাসান ।।
১. ‘বাংলাদেশ ব্যাংক হবে বিশ্বের রোল মডেল’ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ গভর্নরের পুরস্কার পাওয়ায় গত বছর ১৫ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি এ বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রযুক্তিতে অনেক বেশি অগ্রগামী এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে যেভাবে আর্থিক সেবা দেয়া হচ্ছে তাতে বিশ্ববাসী অবাক হয়েছে। ওই বক্তৃতাকক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকেরা শতাধিক উচ্চ ও মধ্যমপর্যায়ের কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে গভর্নরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান মর্মে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সূত্রে জানা যায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সাময়িকী ‘দি ইমার্জিং মার্কেটস’ থেকেই নাকি ড. আতিউর এ পুরস্কারটি লাভ করেছেন। আরো বড় বিষয় হলো এ গৌরবদীপ্ত পুরস্কারটি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- দেশের পরিশ্রমী ও উদ্যমী উদ্যোক্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করেছেন মর্মে ঘোষণা দেন।
২. এর সপ্তাহ পাঁচেক পর ২২/১১/১৫ তারিখে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টস ভবনে বার্ষিক ব্যাংক সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতার কারণে কিছু অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সুপারভিশন কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক করপোরেট সুশাসন এবং পর্ষদের জবাবদিহিতা ও দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধানের ওপর জোর দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী করা হয়েছে।
এর আগে ২৩/০৭/২০১৫ তারিখে মুদ্রানীতি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করার সময় ড. আতিউর বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব আমাদের পুরো অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই গত কয়েক বছর এই খাত কঠোর পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং প্রত্যেক ব্যাংকের ওপর নজরদারি করার জন্য আলাদা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্তসহ একাধিক ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির বাইরে এখন কোনো ঘটনাই ঘটতে পারে না। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো, উদ্বৃত্ত অর্থ কিভাবে ব্যবহার করা হবে। কারণ রিজার্ভ, তারল্য, রেমিট্যান্স, রফতানি তহবিলসহ সব খাতেই এখন আমাদের উদ্বৃত্ত রয়েছে।
৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২২/০৬/১৫ তারিখে সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘রক্ষণশীলতামুক্ত সহজিয়া চরিত্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়তে চাই। গ্রাহকবান্ধব সুসম্পর্কিত ডিজিটাল ব্যাংকিং আমরা গড়ে তুলেছি। প্রান্তিক কৃষকও ঘরে বসে এখন ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছেন।’ এ রকম প্রযুক্তিনির্ভর ‘মানবিক ব্যাংক’ গড়ার কাজে মনোযোগ দিচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের ধারা অক্ষুণ্ন রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, দারিদ্র্য লাঘব, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক নতুন ধারা চালু করেছে। সমগ্র আর্থিক খাতকে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবিক চেহারা দিয়েছে। যা হোক নতুন ধারা প্রবর্তনে গভর্নর ড. আতিউরের নেতৃত্বে অনেক কিছুই হয়েছে মর্মে তার বয়ান থেকে জানা যায় ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অর্পিত মূল দায়িত্ব পালনে তার মনোযোগ প্রদানের বিষয় তার চলনে-বলনে খুব একটা প্রকাশ পেতে দেখা যায়নি।
৪. প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার অফিসকক্ষে এক পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংকিং’ খাতকে ডিজিটাইলাজড করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সারা বিশ্বে আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। বর্তমানে দুই কোটি ৬০ লাখ মোবাইল অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন ৪০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। এ হার প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া কাগজবিহীন ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য সব ব্যাংকই পদক্ষেপ নিয়েছে। আগের চেয়ে ব্যাংকে কাগজের ব্যবহার অনেক কমেছে। অনলাইনের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে অনেক বেশি।
৫. ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘জুন-২০১৫ সালের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসিইউ ও সার্ক’ গভর্নরদের বৈঠক হয়েছে, সেখানে এসিইউর (আকু) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। এটি বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। সার্ক রাষ্ট্রগুলোর গভর্নররা বাংলাদেশ ব্যাংক ভিজিট করেছেন। তারা আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক মুদ্রানীতি ও ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে আমরা নেতৃত্ব দিচ্ছি। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. রঘুরাম রাজন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অগ্রগতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন। তাদের দেশে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।
৬. গত ৭/০২/২০১৫ তারিখে লন্ডনের হাউজ অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতে ঋণসহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কৃতিত্বস্বরূপ তাকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সেরা গভর্নর হিসেবে সম্মাননা দেয়া হয়। এটি প্রদান করে যুক্তরাজ্যের ‘দ্য ব্যাংকার’ নামে একটি সাময়িকী। অনুষ্ঠানে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সমালোচনা করে গভর্নর ড. আতিউর বলেন, মন্দা ঠেকাতে এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোয়ান্টিটেটিভ ইজিইংয়ের (স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান) মতো ভুল পন্থা বেছে নিয়েছে। এতে বাজারে তারল্য বাড়ার কারণে ধনীদের সম্পদের মূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের কোনো লাভ হবে না। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের এক সাংবাদিক হলর্মাক কেলেঙ্কারির বিষয়ে উল্লেখ করলে আতিউর বলেন, এতে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
৭. গত ০৬/১২/১৪ তারিখে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে ড. আতিউর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের একটি করে ব্যাংক হিসাব থাকবে, সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেটা প্রচলিত ব্যাংক অথবা মোবাইল ব্যাংকিং বা স্কুল ব্যাংকিংয়ের মতো অপ্রচলিত ব্যাংক হোক। আতিউর রহমান বলেন, ২০০৯ সালে প্রচলিত ব্যাংক হিসাব ছিল তিন কোটি ৭৬ লাখ। অপ্রচলিত ব্যাংক হিসাব ছিল না। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক হিসাব প্রায় পাঁচ কোটি। এর সাথে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় খোলা ১০ টাকার এক কোটি ৪০ লাখ ব্যাংক হিসাব এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের আওতায় খোলা দুই কোটি ব্যাংক হিসাব যোগ করলে হিসাবের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে আট কোটি, এ মন্তব্য আতিউরের।
৮. অভূতপূর্ব ব্যাংক হিসাব সম্পর্কিত উচ্ছ্বাসসমৃদ্ধ এই বয়ান দেয়ার ঠিক চার দিন আগে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে যে ধান্দাবাজি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, চুরিচামারি, প্রতারণা ইত্যাদি চলছে সে বিষয়ে ব্যাংকের ৮০ ভাগ মর্টগেজই ভুয়া শিরোনামে ঢাকার এক বহুল পঠিত পত্রিকায় ০২/১২/১৪ তারিখে একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এতে বলা হয়, ব্যাংক কর্মকর্তারা এসব বিষয় ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ অনুমোদন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ব্যাংকগুলো বলছে, তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় অনেক সময় সরেজমিন পরিদর্শন করতে পারছেন না। ফলে প্রতারক চক্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নামীদামি ব্যাংকও। সরকারি- বেসরকারি নতুন-পুরান সব ধরনের ব্যাংকেই এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা সম্প্রতি বেড়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আরো কঠোর হওয়া দরকার ছিল।
৯. দেশের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড বিনাশী’ কিছু ঘটনার বিবরণ যেমন- ভুয়া এলসিতে ব্যাংকশূন্য : জাল কাগজপত্র ও সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট’ শিরোনামে একটি খবর ঢাকার পত্রিকায় (২০/০৯/১৪) প্রকাশিত হয়। খবরটিতে বলা হয়, ব্যাক টু ব্যাক ভুয়া এলসি (ঋণপত্র) খুলে এবং জাল কাগজপত্র মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে একটি চক্র। ফলে শূন্য হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক। শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাত থেকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
১০. এ ছাড়া, মর্টগেজ হিসেবে দেখানো পণ্য বা জমির ভুয়া দলিল দিয়ে এলসি খুলছে চক্রটি। মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এলসির কাগজপত্র তৈরি করে অন্য ব্যাংকে তা বিক্রি করে তুলে নিচ্ছে টাকা। এসব ঘটনায় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও নাকি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মন্তব্য : একটি চক্র সুকৌশলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে নিজেরাই আমদানিকারক ও রফতানিকারক সেজে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে। এ ছাড়া ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে তা ব্যাংকে মর্টগেজ দিয়ে ঋণের জন্য আবেদন করছে। পরে জাল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এসব কাগজপত্র। জানা গেছে, সম্প্রতি তৈরী পোশাক খাত ও জাহাজভাঙা শিল্পের প্রয়োজনীয় মালামাল আমদানির জন্য খোলা বিপুল ব্যাক টু ব্যাক এলসি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। সঙ্ঘবদ্ধ এ চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণও অনুমোদন করিয়ে তা আত্মসাৎ করছে। এসব বিষয়ে ড. আতিউরের গৃহীত ও দৃশ্যমান কোনো কার্যকর পদক্ষেপ সম্পর্কে দেশবাসী খুবই কম অবহিত।
১১. গত ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ঠিকানা’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আতিউর রহমান বললেন,‘বাংলাদেশ এখন সব কিছুতেই উপমহাদেশে শীর্ষে’। তিনি বলেন, ‘কিছু ভালো খবর আছে, তা নিয়ে আমাদের বাঁচতে ইচ্ছা করে। যেমন- ধরা যাক চালের কথা। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ অসম্ভব ভালো করেছে। সারা বিশ্ব বলছে, বাংলাদেশ একটি মডেল। অথচ এ কথাটা অকপটে স্বীকার করার মতো ঔদার্য আমাদের অনেকের নেই। ওই দিকে ‘আবার গরিব কৃষকের পোলারা’ পাঠাচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এভাবেই বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে নীরব বিপ্লব চলছে। তার এসব রাজনৈতিক কথাবার্তায় ইঙ্গিতই দিয়ে যাচ্ছিল যে, তিনি সম্ভবত বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিতের পদে নিযুক্তি পেয়েও যেতে পারেন।
১২. আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ আয়োজিত মধ্যাহ্ন ভোজসভায় (২৮/০৫/১৪) আতিউর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে’ এমন ধারণার সাথে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, যেসব ‘সূচক’ দিয়ে টাকা পাচারের প্রবণতা বোঝা যায়, সেসব সূচকে এর প্রতিফলন সীমিত। আতিউর আরো বলেন, যেভাবে কালো অর্থনীতি ও কালো টাকার কথা বলা হয় বাস্তবে বিষয়টি হয়তো পুরোপুরি সে রকম নয়। বরং একে অনানুষ্ঠানিক বা ‘ধূসর অর্থনীতি’ বলা অধিক যুক্তিসঙ্গত। আর কালো টাকার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় সীমিত।
১৩. উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার ঠিক চার বছরের মাথায় এক বনেদি পত্রিকায় (জিএফআইকে উদ্ধৃত করা) প্রকাশিত (০৫/০৫/১৩) খবরে বলা হয়, দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ১৮০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ বিদেশী ঋণ ও অনুদান হিসেবে ১২০ কোটি ডলার পেয়ে থাকে। এ তথ্য ঢাকার জাতীয় প্রেস কাবে ‘কালো টাকার রাজনৈতিক অর্থনীতি : অপ্রর্দশিত অর্থনীতিতে বাজেট ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ’ বিষয়ে ইকুইবিটিবিডি আয়োজিত সেমিনারে প্রকাশ করা হয়।
১৪. কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান কাজের মধ্যে মনিটারি পলিসি ফাংশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ প্রবৃদ্ধি কত হবে, মূল্যস্ফীতি হার কত হবে, মূল্যস্ফীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ানো যায় তার একটা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকে মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে। এর সাথে আছে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ। রিজার্ভ ম্যানেজমেন্ট, রেমিট্যান্স কিভাবে আসবে, টাকা ছাপানো- এগুলো মনিটরি পলিসি ফাংশনের আরকটি অংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব দুটো, রেগুলেশন ও মনিটারি পলিসি ফাংশন। তবে অন্য অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল মনিটরি পলিসি ফাংশন করে থাকে। সে হিসেবে আমাদের এখানে দায়িত্বটা একটু বেশি। এ প্রসঙ্গে সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে কোর ব্যাংকিংয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সুপারভিশন, মনিটরিং অডিট, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে।
১৫. কিন্তু বাস্তবে দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল, সাত বছর দায়িত্ব পালনকালে গভর্নর ড. আতিউর বিভিন্ন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা, বিদেশী ম্যাগাজিন বা গ্রুপ থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি, ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে অ্যাওয়ার্ড, নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ইন্দিরা গান্ধী স্মারক পুরস্কার, শেলটেক অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপংকর গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। এ কাজে- সে কাজে এবং প্রায়ই বাংলাদেশ ব্যাংকবহির্ভূত অকাজে ১৯৫ দিন (কিছুকাল আগে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার সারসংক্ষেপে ড. আতিউর ইতঃপূর্বে ১১ মাসে (২০১৫) ১১ বার বিদেশ সফর করেছেন মর্মে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে জানা যায়) সফর করার কাহিনী পত্রপত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। মূলকথা হলো, পরিবেশ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার নতুন ধারা চালু করা, সহজিয়া চরিত্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, প্রযুক্তিনির্ভর মানবিক ব্যাংক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংক, গ্রিন ব্যাংকিং ইত্যাদি ‘মেডেল ও পুরস্কারবান্ধব’ অভূতপূর্ব কাজকামে বেশি মনোযোগ ও সময় দেয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোর ব্যাংকিংয়ে মনোযোগ দিতে সময় তিনি পাননি সম্ভবত। এজন্য রিজার্ভ জালিয়াতির দায়দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ‘তৃপ্তি’ সহকারে বীরের বেশ (?) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। সবই নিয়তির খেলা।
লেখক : সাবেক সচিব এবং প্রেসিডেন্ট, চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিসটিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট বাংলাদেশ কাউন্সিল।
E-mail : karar.hassan@gmail.com
সূত্র : নয়া দিগন্ত, ৩ মে ২০১৬