ছয় মাসেও গ্রেফতার হয়নি মৌ হত্যার মূল আসামি

nikli kishore mou

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি ।।
ছয় মাস পার হয়ে গেলেও কিশোরগঞ্জের স্কুলশিক্ষক আতিয়া জাহান মৌ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও এখনও এ মামলার মূল আসামিরা গ্রেফতার হয়নি। সন্দেহভাজন যে দু’জন গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারাও জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। মৌয়ের স্বজনদের অভিযোগ, প্রভাবশালী মহলের চাপে মামলাটি ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আসামিদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের হুমকিও পাচ্ছেন তারা।

মৌয়ের মা রওশন আরা কবিতা অভিযোগ করেন, শুরু থেকেই মৌ হত্যাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেছে একটি মহল। বর্তমানে ওই ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে মহলটি ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তাই তিনি মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

জানা গেছে, মামলাটিতে পুলিশের হাত ঘুরে বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডির কাছে রয়েছে। তারাই ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছেন।
nikli kishore mou
তাদের তদন্ত, লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন, ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার এক আসামির আদালতে দেয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করে এটিকে হত্যাকাণ্ডই মনে করছে সিআইডি। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সিআইডির হাতে না পৌঁছলেও, তারা নিশ্চিত হয়েছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণ ও হত্যার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে মৌয়ের স্বজন ও এলাকাবাসী একের পর এক মানববন্ধন, মৌন মিছিল, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করে ঘটিনাটি ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। গত বুধবার জেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে সংবাদ সম্মেলন করে মৌয়ের মা রওশন আরা কবিতা কিশোরগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগ করেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, বাসার একটি ফ্ল্যাটে ভাংচুর করে মৌকে হত্যা করে খুনিরা তার লাশ তালাবদ্ধ করে মৌয়ের সেলফোনসহ ঘরের চাবিও নিয়ে যায়। অথচ ওসি সাহেব এজাহারে এসব উল্লেখ করতে দেননি। পরবর্তীতে ওসি সাহেব ঘটনাস্থলে হত্যাকাণ্ডের সব আলামত নষ্ট করে ফেলেন। তাছাড়া যে চিকিৎসকরা মৌয়ের ময়নাতদন্ত করেছেন, তাদের একজন মামলার আসামি রিফাতের খালাতো ভাই। কাজেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনার প্রতিফলন থাকবে না অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেদিন ওই চিকিৎসকের কোনো ডিউটি ছিল না। তিনি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লাশের ময়নাতদন্ত দলে নিজেকে যুক্ত করেন।

সিআইডির কিশোরগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. শহিদুল ইসলাম খান বলেন, মৌকে হত্যার আগে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল এটা নিশ্চিত হয়েছি আমরা। এ মামলার অন্যতম আসামি মৌয়ের কথিত প্রেমিককে গ্রেফতার ও তার জবানবন্দির পর পুরো বিষয়টি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। এখন মূল আসাসি রাজিব ও টিটুকে ধরতে পারলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে আমাদের কাছে। এ সময় তিনি আরো বলেন, ঘটনার কিছু আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মামলাটি নিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। এখন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি আমরা।

লাশের ময়নাতদন্তকারী জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. নাদিউল হক নির্ঝরের (আসামি রিফাতের আত্মীয়) সঙ্গে কথা হলে তিনি রিফাতের আত্মীয় স্বীকার করে বলেন, আমি ময়নাতদন্ত দলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্ত হয়নি। আমাকে রাখা হয়েছে বলেই সদস্য ছিলাম মাত্র। ময়নাতদন্তে নেতৃত্বে দিয়েছেন আরেকজন।

লাশের মূল ময়নাতদন্তকারী ডা. অতীশ দাস রাজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মৌয়ের ঠিক কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, তা বলতে অস্বীকার করেন।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মো. খলিলুর রহমান গত ৭ নভেম্বর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন, এতে তিনি হত্যা ও ধর্ষণের আলামতসহ পর্যবেক্ষণমূলক মতামত দেন। সিআইডিতে হস্তান্তরের আগে কিশোরগঞ্জ থানায় যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল, তার তদন্ত কর্মকর্তাও ছিলেন তিনি। তবে এর কিছুদিন পরেই অজ্ঞাত কারণে বদলি করে পাঠানো হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানায়।

এ বিষয়ে তার সঙ্গে বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, মৌয়ের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখমসহ ধর্ষণজনিত বেশ কিছু আলামত পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলোর বিষয়েই ময়নাতদন্তে মতামত চাওয়া হয়েছিল। এর কিছুদিন পর আমি বদলি হয়ে যাই।

জানা গেছে, গত বছরের ৬ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার নিজেদের বাসার দ্বিতীয় তলায় খুন হন স্কুলশিক্ষক আতিয়া জাহান মৌ(২২)। ওই দিন বাসায় মৌ ছাড়া পরিবারের অন্য কেউ উপস্থিত ছিল না। ঘাতকরা হত্যার পর লাশ ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। মৌ যে কক্ষে থাকতেন, সেটিসহ পাশের একটি কক্ষের সব আসবাবপত্র ছড়ানো ছিটানো ছিল। তার মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়নি। ঘরের সব চেয়ার টেবিল নিচেই ছিল। তাছাড়া মৌয়ের কক্ষটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। পরে তালা ভেঙে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে থাকা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় ৭ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় মৌয়ের মা রওশন আরা কবিতা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারি মাসে মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার এফআইআরভুক্ত আসামি মৌয়ের কথিত প্রেমিক ইউসুফ হায়দার রিফাতকে (৩০) গ্রেফতার করে সিআইডি। সে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে এ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে রিফাতের আরেক সহযোগী অসীম দেবকে (৩০) আটক করা হয়। বর্তমানে এরা দু’জনই জামিনে রয়েছেন। এ মামলায় প্রেমিক রিফাত ছাড়াও জেলা শহরের বত্রিশ এলাকার আবদুল করিমের ছেলে রাজিব (২৪), ইসলাম উদ্দিনের ছেলে টিটু (২৫) ও ঝুমুর (৩৭) নামে এক নারীর নাম উল্লেখসহ আরো অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

স্কুলশিক্ষক আতিয়া জাহান মৌয়ের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদীঘি গ্রামে। তিনি সৌদি প্রবাসী কামাল হোসেনের মেয়ে। প্রায় দু’বছর আগে মৌ গোপদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তবে তিনি বসবাস করতেন তাদের কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার নিজেদের দোতলা বাসায়।

Similar Posts

error: Content is protected !!