কারণে অকারণে মনে পড়ে তোমায়!

shaila shoma nikli

“মধুর আমার হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে”

মাঝে মাঝে ভাবি বেঁচে থাকলে তোমার বয়স কত হতো? চল্লিশের ঘরে নিশ্চয়ই। সামনের কিছু চুল হয়তোবা সাদা রংয়ের ছোঁয়া লাগতো। খালি চোখে কোন কিছু সেলাই করতে পারতে না। চশমা লাগতো। জর্দা দিয়ে পান খেতে। পানের আভায় ঠোঁট দুটি লাল হয়ে যেত। আটপৌরে শাড়ি পরলেও তাতে নিপুণতার ছাপ থাকতো। শুনেছি শাড়ি পরাতে তোমার বেশ নিপুণতা ছিল। সুখী মা যে কেউ দেখলেই বলে দিতে পারতো। এ রকম স্বপ্নের কথা আমি বহুবার ভেবেছি। যখন সন্ধ্যা আকাশে অনেক তারার মেলা, বিদ্যুতের আলো নেই, জোনাকি পোকারাও কেমন তারার সাথে মিতালী করে গুনগুন করে মন ভাঙা গান গায়। মাঝে মাঝে ভাবি মাছের পোনার মতো স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে কেন তোমার অবয়বটা চোখের সামনে ভেসে উঠে না।

shaila shoma nikli
যখন পুরো পৃথিবীই আমার ছিলো

আমার বাচ্চাটার সাথে লুকোচুরি খেলা খেলতে তুমি। এ ঘর থেকে ও ঘরে আমার আরাধ্যের পায়ের শব্দ সমস্ত বাড়িটা শব্দময় হয়ে উঠতো। আর সপ্তবর্ণে লুকিয়ে যেতে তুমি। যেমন করে লুকিয়ে গেলে সবার আড়ালে। আমার ছেলেটা তোমাকে না পেয়ে কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে যায়। ও কি আর বোঝে পৃথিবীর জন্ম-মৃত্যুর রহস্য!

আমার ছেলেটা আমাকে না দেখলে যেমন কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। আমিও তো বোধহয় তোমাকে না দেখলে তাই করতাম। অবশেষে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার দায়িত্ব নিল আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি, চারপাশের প্রকৃতি। সকালের সোনালি রোদ্দুর, দুপুরে বৃষ্টির পর আকাশে রংধনুর খেলা, বিকেলের মায়াবী আলো, খেয়া পারাপারের ঘাট, লঞ্চের ভেঁপু, নদীর জোয়ার-ভাটার খেলা আরো কত কি। ধীরে ধীরে বোঝা শুরু করলাম প্রকৃতিরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে, শরৎ, হেমন্ত শীত আর সবশেষে বসন্ত। প্রকৃতিকে আবিষ্কার করার পাশাপাশি ততদিনে এইটুকুও আবিষ্কার করে ফেলেছি “মা” শব্দটি আমার অভিধানে নেই। মা ছাড়া পৃথিবীটা আমার কাছে অচেনা একটা দ্বীপের মতো মনে হয়। জীবনের প্রথম ধাপেই মাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কঠিন সূত্র রপ্ত করে ফেললাম। বহুদিন আগে দেখা কোনো স্বপ্নের মতো মনে পড়ে, স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে, স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল উথাল-পাথাল করছে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, সুমা তুমি যেখানেই থাকো, প্যান্ডেলে চলে আসো। সেখানে তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

এমন অনেক দিনই তো গেছে তোমার প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। সন্ধ্যা আলো জ্বালানোর সাথে সাথে আমাকে পড়ার টেবিলে খোঁজা, পরীক্ষার আগের রাতে মগভর্তি চায়ের কাপ কিংবা একগ্লাস দুধ গরমের জন্য তোমার রাত জেগে থাকা। জ্বর হলে সারারাত শিয়রের পাশে বসে থাকা। এ কাজে তুমি নিদ্রাহীন আর ক্লান্তিহীন। সব কাজ কেমন হাসিমুখে করে যাচ্ছ বিরামহীনভাবে।

রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথের মতো অকারণে মাকে মনে পড়ে আমার। সকলের ঘুম ভাঙ্গার প্রহরে, মধ্যদুপুরের নির্জনতায়, বিকেলের আলসেমিতে, কিংবা রাতের নির্জনতায়। আলমারিতে খুব যত্ন করে তুলে রাখা শাড়িতে কেমন মা মা গন্ধ জড়িয়ে আছে। মনের সব প্রকোষ্ঠের দরজা-জানালায় খোলা রাখি কখন তুমি চলে আসো আমার অবচেতন ও চেতনাতে মনের মাঝখানে। আমি ঠাঁই বাড়িয়ে আছি মনের প্রকোষ্ঠে কান পেতে তোমার পদধ্বনি শোনার জন্য। আমার জীবনের বর্ণমালায় “ম” বর্ণকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বেড়াই। কারণে অকারণে মনে পড়ে তোমায়!

শাইলা পারভীন সুমা

Shailashoma@gmail.com

Similar Posts

error: Content is protected !!