মো: আল আমিন, কিশোরগঞ্জ ।।
ভোটকক্ষের ভেতর-বাইরে আওয়ামীলীগ কর্মী-সমর্থকদের সশস্ত্র মহড়া, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে সিলমারা ও ব্যালট ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার ৭ মে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ৬টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
সকাল ১০টা। ছয়সূতি ইউনিয়নের কলাকূপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের মাঠে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে লম্বা লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ১০/১২ জন যুবক ভোটারদের লাইনের সামনে দাঁড়ানো। তারা ঠেলে ঠেলে ভোটারদের পেছনের দিকে নিয়ে আসছেন। ভোটারদের হইচই চেঁচামেচি। সামনে এগিয়ে দেখা গেল আরো কিছু যুবক। ভোট কক্ষের প্রবেশপথে লাঠি ক্রস আকৃতি করে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। এদের সবার বুকেই নৌকা মার্কার ব্যাজ লাগানো। এর মধ্যে কেন্দ্রের ২ নম্বর কক্ষে এ প্রতিবেদকসহ জাতীয় দৈনিকের কয়েকজন সাংবাদিক প্রবেশ করতেই কক্ষে দায়িত্বরত রুবেল মিয়া নামের বিএনপি প্রার্থীর এক নির্বাচনী এজেন্ট কান্নাকাটি করে বলতে থাকেন, ‘ভাই ধানের শীষের কোনো ভোটারকেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ভেতরে শুধু আওয়ামীলীগের লোকদেরই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে।’ ভোট কক্ষের ভেতরে কয়েকজন যুবক-যুবতীকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এরা ভোটারদের কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মেরে বাক্সে ভরছেন। আমরা কিছুই বলতে পারছি না।’ এ সময় এক যুবক এসে সাংবাদিকদের সামনেই তাকে (বিএনপির এজেন্টকে) শাসাতে থাকেন এবং কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।
নাম কি আপনার? এভাবে তাকে বেরিয়ে যেতে বলছেন কেনো? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থী মীর মো: মিছবাহুল ইসলামের ছেলে। এটা আমাদের নিজেদের কেন্দ্র। এখানে আমাদের কিছু প্রভাব তো থাকবেই।’
পাশের আরেক পুরুষ কক্ষে গিয়ে দেখা গেল নৌকার ব্যাজ লাগানো কয়েকজন যুবক গোপন বুথের সামনে দাঁড়ানো। এ কক্ষে প্রায় ২০ মিনিটের মতো অবস্থান করে দেখা গেল, বাইরে থেকে যে ভোটারই আসছেন তাদের সাথে গোপন কক্ষে গিয়ে কোথায় ভোট দেয়া হচ্ছে তা তারা দেখছেন। এ সময় ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের প্রতি এক যুবক তেড়ে আসেন। পরে জানা গেল এ যুবক আওয়ামীলীগ প্রার্থী মিছবাহুলের ভাইস্তা। নাম নজরুল ইসলাম।
একই কেন্দ্রের এক মহিলা ভোটকক্ষে গিয়ে দেখা গেল এক তরুণী মহিলা ভোটারদের কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে একের পর এক নৌকায় সিল মারছেন। ছবি তুলতে গেলেই তরুণী ক্ষেপে যান। এ সময় বাইরে থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তরুণীকে ধমকিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেন। পুলিশ কমকর্তা জানালেন, এ তরুণীর নাম পপি আক্তার। সেও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর ভাস্তি। ভোট শুরু হওয়ার পর থেকেই এ কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর বাড়ির লোকজন খুব ‘ডিস্টার্ব’ করছে বলেও তিনি জানান। এ সময় কেন্দ্রটি পরিদর্শনে এসে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: মশিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এর আগেও তিনি একবার এসে এই কেন্দ্র থেকে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর ছেলেকে বের করে দিয়ে গেছেন।
কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো: কবির হোসেন বলেন, বারবার বলার পরেও তারা কেন্দ্র থেকে যাচ্ছেন না। কবির হোসেন জানান, এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৫৩৪। কেন্দ্রে পরিদর্শন শেষে বাইরে এলে দেখা হয় বিএনপি প্রার্থী মো: আক্তারজ্জামান ভূঁইয়ার সাথে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট আসলে দখলবাজি একটু বন্ধ হয়, গেলেই আবার দখল শুরু হয়।’
পরে জানা গেছে, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এ কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ব্যালট পেপারের ৫টি বই ছিনিয়ে নিয়ে যায় আওয়ামীলীগ প্রার্থীর সমর্থকরা। এ অবস্থায় বেলা পৌনে একটার দিকে কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। কেন্দ্র লায়ন মুজিব-মুনা গার্লস স্কুল। কেন্দ্রের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই জানা গেল, এই কেন্দ্র দখল হয়ে গেছে। আওয়ামীলীগের লোকজন কেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ করে প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে ব্যালট বই নিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মারছে। সাধারণ ভোটারেরা স্কুলের ফটকের বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। কেউ কেউ আতঙ্কে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ফরিদের মা (৫০) নামের এক ভোটার হন্তদন্ত হয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসে বলেন, ‘গজব কইরালতাছে। নিজেরা নিজেরা সব ভোট মাইরালতাছে। জীবনেও এই রহম দেখছি না। আর কুনুদিন ভোট দিতে আইতাম না।’ হারুন অর রশিদ নামের এক ভোটার এ প্রতিবেদককে জানান, আধা ঘণ্টা আগে এ স্কুলের মাঠ থেকে সব ভোটারদের জোর করে বের করে দিয়ে মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেয় আওয়ামীলীগের লোকজন। এর মধ্যে কিছু মহিলা ভোটার ভেতরে আটকা পড়ে। আধঘণ্টারও বেশি সময় কেন্দ্রটিতে একই অবস্থা চলার পর বেলা ১১টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মশিউর রহমান কেন্দ্রটিতে এসে মূল ফটক খোলানোর ব্যবস্থা করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতির খবরে দখলদার যুবকেরা পালিয়ে যায়। এ সময় প্রিজাইডিং অফিসার শহীদুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রটিতে ১ হাজার ৬২৮টি ভোট রয়েছে। কেন্দ্রটির মূল ফটক আটকে দিলেও সরকার সমর্থকদের হুমকির মুখে তারা ছিলেন একেবারেই অসহায়।
বেলা ১২টায় একই ইউনিয়নের হাজারীনগর সিএলই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গিয়ে পৌঁছতেই সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কয়েক ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। তাদের মধ্যে বিল্লাল মিয়া ও নূরুল ইসলাম বিএনপি প্রার্থী মো: আক্তারজ্জামান ভূঁইয়ার এবং গোলাপ হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো: আনিসুজ্জামান জসিম (আনারস)-এর এ কেন্দ্রের এজেন্ট। তারা অভিযোগ করেন, ভোট শুরু হতে না হতেই তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে নৌকার সমর্থকেরা। এভাবে কেন্দ্র দখলে নিয়ে জালভোটসহ ভোটারদের কাছ থেকে তারা প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট আদায় করছে। এ সময় গোলাম মোস্তফা নামের এক ভোটার অভিযোগ করেন, তিনি ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপার নেয়ার পর তার হাত থেকে চেয়ারম্যান পদের ব্যালট ছিনিয়ে নেয় খোকন ও জুনাইদ নামে নৌকার দুই সমর্থক।
সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলা হচ্ছে শুনে জুনাইদ এসেই সাংবাদিকদের সামনেই গোলাম মোস্তফাকে মারধর শুরু করে। এ সময় জুনাইদ সাংবাদিকদের নোটপ্যাড ধরে টানাটানিও করে। পরে জানা গেছে, জুনাইদ এ ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলামের ছেলে। কেন্দ্রের ভেতরে গিয়েও একই অবস্থা দেখা যায়। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের টেবিলে প্রকাশ্যে ১০/১২জন এক সাথে নৌকায় সিল মারছে। এ ব্যাপারে একটি বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার সুব্রত ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে থাকা এক নারী পোলিং অফিসারও নিজেদের অপারগতার কথা জানান। কেন্দ্রটির সাতটি বুথের প্রতিটিতেই প্রকাশ্যে নৌকায় গণহারে সিল মারার দৃশ্য দেখা গেছে। (এ দৃশ্যের ছবি নিউজের সাথে সংযুক্ত আছে)। এ কেন্দ্রের ভেতরে অবস্থানকারীদের কারো কাছে পোলিং এজেন্ট হিসেবে কোনো পরিচয়পত্রও ছিল না। প্রিজাইডিং অফিসার কামাল হোসেন ভূঞা জানান, পোলিং এজেন্ট যারা তাদের প্রত্যেককেই পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৭০১ জন।
এ ছাড়া সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হতে না হতেই রামদী ইউনিয়নের খলাখাড়া কোনাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আবদুল বারী সিদ্দিকের কাছ থেকে জোর করে ব্যালট পেপারের ৫টি বই ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় সিল মারতে থাকে এ ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ প্রার্থী আলাল উদ্দিনের লোকজন। এ সময় বিএনপি প্রার্থী মো: ইসমাইল হোসেন খানের সমর্থকরা তাদের বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষে পাঁচজনের মতো আহত হয়। এর জের ধরে প্রথমে সাময়িকভাবে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ একেবারেই স্থগিত করে দেয়া হয়।
শনিবার অনুষ্ঠিত কুলিয়ারচর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ৬ জন ও বিএনপির ৬ জনসহ মোট ৩৩ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে, ২১৫ জন প্রার্থী সাধারণ সদস্য পদে এবং ৬৮ জন প্রার্থী সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
কুলিয়ারচরে ২টি আ’লীগ, ২টি স্বতন্ত্র, ২টি স্থগিত