কবির হোসেন ।।
আজ বিশ্ব মা দিবস। আদরিনী, সোহাগিনী, মমতাময়ী জন্মদাত্রী মায়ের জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন আছে কি? রাত-দিন সর্বদাই মায়ের স্নেহ, মায়া, মমতার ছোঁয়া ঘড়ির কাটার মতো মনের গহীনে টিক টিক করে বাজে। যারা দিবসটি সম্পর্কে অবগত সবাই কম-বেশি মাকে নিয়ে লিখছেন কিংবা পোস্ট দিচ্ছেন। আমি একজন হতভাগ্য ও অনুভূতিহীন। আবছা আবছা মনে আছে “মা” সরিষার তৈল গায়ে মেখে গোসল করাতেন যাতে ঠাণ্ডা না লাগে। কপালে কিংবা কানের নিচে পাতিলের গাঢ় কালিটা এনে লাগাতেন নজর যেন না লাগে। মাথায় তেল দিয়ে পাশ দিয়ে সিঁথি এঁকে দিতেন। কাপড়ে যাতে ধুলো-বালি না লাগে সতর্ক করতেন।
আজ থেকে ৬০/৬৫ বছর আগে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের স্কুলে যাওয়ার রেকর্ড খুবই কম। আমার মায়ের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি দুই কি তিনজন শিক্ষার্থী ছিলেন নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তার মধ্যে আমার “মা” একজন। সে থেকেই “মা” শিক্ষানুরাগী ছিলেন। সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি ছিলেন সাবধানী। আর বাবা স্কুলশিক্ষক হওয়ার সুবাদে অসংখ্য শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর কারিগর।
আমরা চার ভাইবোন। আমার ছোট মামুন, রীপা, নাছিমা। নাছিমা সবার ছোট। তখন ওর বয়স ২ বছরের মতো হবে। “মা” মশা কামড়াবে বলে মশারি টানিয়ে হারিকেনের আলো দিয়ে আমাদের নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন বিড়ালের কর্কশ চিৎকারে আমার ছোট বোন দু’টো ভীষণ ভয় পেয়েছিল। মা’র প্রাণান্তকর চেষ্টা সন্তানদের ভয়মুক্ত করার। “মা” শারিরীকভাবে নিরোগ ও প্রাণোচ্ছল ছিলেন। অসম্ভব গুণী একজন মহিলা ছিলেন তিনি। হঠাৎ করে অসুস্থ! স্বজনেরা মাথায় পানি দিচ্ছে। উত্তর দিকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন আমার মা। এখনো আমার গর্ভধারিনী, অভিমানী মায়ের চাঁদের মতো মুখচ্ছবিটি আমার মানসপটে আবছা আবছা মনে আছে। আমি মায়ের শিয়রে বসা। মায়ের অসুখের প্রকোপ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমাদের এলাকায় তখনকার সময়ে ভালো গ্রাম্য ডাক্তার ছিলেন সৈয়দ মোঃ সাদুল্লাহ সাহেব। তিনি এসে প্রাণান্তকর চেষ্টা করলেন। স্যালাইন পোশ করা যাচ্ছে না। তিনি মুখ দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন। হঠাৎ “মা” আমাকে বললেন, বাবা আমার মাথায় পানি দাও। আমি দিলাম। পিনপতন নিস্তব্ধতা ভেদ করে স্বজনদের মর্মবিদারী চিৎকার। আমি মাত্র ১০/১১ বছরের ছোট্ট কিশোর। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হলো।
সময় অনেক গড়িয়ে যাওয়ার পর দেখলাম “মা” আমার সাদা কাপড়ে মোড়ানো। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি কি হচ্ছে। এতটুকু অবুঝ বালকের পক্ষে কতটুকুনই বোঝা সম্ভব! তখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রচলন হয়নি। হাতে বাওয়া নৌকা নিয়ে অন্তিমযাত্রায়। আমার এক চাচা (প্রয়াত কিতাব আলী মিয়াকে) ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করতাম মা’কে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আজ বুঝি! তিনি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য উত্তরে বলতেন, ওই যে বাড়িটা (গোরস্থান) আছে সেখানে বেড়াতে দিয়ে যাবো। আবার কয়েক দিন পর নিতে আসবো। এটাই মায়ের শেষ বেড়ানো। “মা” আর ফেরেননি। অনুভব করতাম। পানি পানের তৃষ্ণা পেলে যেমন লাগে মা’কে দেখার এরকম তৃষ্ণা পেত। আনমনে “আম্মা!” বলে ডাক দিয়ে ঘরে আসতাম। এদিক সেদিক তাকাতাম। কিন্তু নাহ্! অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে গেছে সেই চাঁদ মুখ। বাবা, দাদা-দাদীমা, মামা, নানী, খালারা মায়ের অভাব পূরণে অহর্নিশি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু ছোট্ট দুধের শিশুটার কি হবে? সবাই ভেবেছিলেন পিচ্চিটাও মায়ের পদাঙ্কই অনুসরণ করবে।
নাছিমাকে দেয়া হলো আমার এক খালা আছিয়া বেগমের কাছে। উনার যত্নে প্রাণ ফিরে পেয়ে বেঁচে আছে। এখনো আমার বোনটার দিকে তাকালে সেদিনের মাতৃবিয়োগের স্মৃতি ভেসে আসে আমার সামনে। আমাদের বেড়ে ওঠার পেছনে খালাদের অসীম মমতা ছিল। খালারা বোন দু’টিকে গায়ে হাত বুলিয়ে বলতেন, তোদের শরীরে মায়ের গন্ধ করে। আমার ছোট ভাইতো এসএসসি’র সনদে মায়ের নামের স্থলে খালার নাম দিয়ে দিয়েছে। মায়ের স্মৃতি আমার কাছেই অস্পষ্ট, ওদের মনে থাকবে কি করে!
যেখানেই মা’কে নিয়ে আলোচনা হয়! আমি হয়ে যাই নিস্তব্ধ! আনমনে! নির্বাক। আজ ৩২ বছর যাবত “মা” বলে ডাকিনি। শব্দটা যেন দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে। দূরে কোথাও ট্রেনিংয়ে কিংবা কোনো কাজে গেলে অবসরে সহকর্মীরা যখন মা’কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “মা” কেমন আছো? আমার হৃদয়টা তখন বিষণ্ন বিলাপে কেঁপে ওঠে। লেখনীর সময় মাঝে মধ্যে চোখ ঝাঁপসা হয়ে ভিজে আসছিল। ফোঁটা ফোঁটা করে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। বিধাতা আমার এ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। কোনো দিনও আমি এ অভাব পূরণ করতে সক্ষম নই। ছোট্ট শিশুরা যখন মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়, মায়ের সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠে, তখন আমিও আমার মা’কে অনুভব করি। শত দুঃখ, কষ্টে, যন্ত্রণায় মানুষ যখন মায়ের সংস্পর্শে আসে, সব দুঃখ ব্যথা দূর হয়ে যায়। চৈত্রের খরতাপে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে ধরনীর লাখো-কোটি মুখ হা করে ওপরে তাকিয়ে থাকে একপশলা বৃষ্টির জন্য। আমি এ রকমই তৃষ্ণাকাতর। একবার যদি মায়ের মুখটা দেখতে পেতাম! কোথায় গেলে পাব এ মুখ? বেঁচে থাকতে আর কোনো দিনই নয়। আমার কাছে একটা প্রতিচ্ছবিও নেই, যা দেখে সান্ত্বনা নেব। অবশ্য মফস্বলে এতো আগে ছবি উঠানের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। সবই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। মা’কে নিয়ে যখন কথা হয় আমার খুবই কষ্ট হয়।
দয়াময় আল্লাহর কাছে মায়ের জন্য একটাই প্রার্থনা, তোমার রহমতের ছায়াতলে আমার মা’কে আশ্রয়দান করো।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, আব্দুল জব্বার রাবেয়া খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খালিয়াজুরী, নেত্রকোনা।