কেমন আছেন হৃদয়কাঁপানো নায়িকা অঞ্জু ঘোষ

onju beder meye josna

মুজাহিদ সামিউল্লাহ, কলকাতা থেকে ফিরে ।।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে তখন চলছে রোজিনা, চম্পাসহ আরো কয়েকজন নায়িকার আধিপত্য। নতুনদের বিকল্প ভাবার কোনো সুযোগই ছিলো না নির্মাতাদের। হঠাৎ সব ভাবনার চিড় ধরিয়ে রূপালী জগতে আবির্ভূত হন তখনকার যাত্রাপালার এক নিয়মিত নারী অভিনেতার। তিনি চট্টলার সুন্দরী অঞ্জু ঘোষ। যাত্রা দুনিয়ায় তখন সম্রাজ্ঞীর আসনটি তিনিই দখলে রেখেছিলেন।

প্রয়াত পরিচালক এফ. কবির চৌধুরীর হাত ধরে চলে এলেন চলচ্চিত্রের আলো ঝলমলে দুনিয়ায়। ‘সওদাগর’, ‘আবেহায়াৎ’ অঞ্জুকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এলো আর ভিত কাঁপিয়ে দিলো রোজিনা, চম্পাদের মতো জনপ্রিয় নায়িকাদের। সেই অঞ্জু দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে কলকাতায় পরবাসী। বাংলা চলচ্চিত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবিটি অঞ্জুর জীবনকে পাল্টে দেয়।

onju beder meye josna

উল্লেখ্য, কলকাতায় ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ রিমেক হয়ে যেদিন হলে রিলিজ হয় একই দিনে অমিতাভের ‘হাম’ ছবিটিও মুক্তি পায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ‘হাম’ ফ্লপ করে আর ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এই জনপ্রিয়তার সুবাদে অঞ্জুও ধীরে ধীরে তার বাংলাদেশের জনপ্রিয়তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে কলকাতার ফিল্ম দুনিয়ায় নিজেকে সঁপে দেন। তাপস পাল, রঞ্জিত মল্লিক, চিরঞ্জীব, অভিষেকসহ তখনকার সব জনপ্রিয় নায়কের সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করে যান।

চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী এক সময় জনপ্রিয়তা তার কমতে থাকে। আবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের যাত্রাপালায় ফিরে যান। দীর্ঘ কলকাতার অভিনয় জীবনে তিনি আর বাংলাদেশের কোনো কাগজের সাংবাদিকের মুখোমুখি হননি। এই দীর্ঘ সময় নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রেখে এই প্রথম সম্প্রতি তিনি মানবজমিন-এর মুখোমুখি হলেন। কলকাতার সল্ট লেকের নিজ বাসায় এক সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে। আমিও সেখানে গিয়ে তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে বিশাল ড্রইং রুমে অপেক্ষায় কখন অঞ্জু দিদিকে দেখবো। অপেক্ষার অবসান হলো।

onju beder meye josna

দরজা ঠেলে কালো-লাল সালোয়ার-কামিজ পরা সেই মিষ্টি হাসি নিয়ে সামনে এসে বসলেন। কুশল বিনিময়ের পালা শেষ করে হেসে বললেন, তুমি তো বয়সে অনেক ছোট। এরপর আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু মজার বিষয়, ধীরে ধীরে যখন আমার মুখে তার অতীতের এদেশে অভিনয় জীবনের কথা শুনলেন, অবাক হলেন। জানতে চাইলেন ববিতা আপা, কবরী আপা, শাবানা আপা, চম্পা, রোজিনা সবাই কেমন আছেন। কেমন আছেন ওয়াসিম ভাই, রাজ্জাক ভাই, কাঞ্চন ভাই, রুবেল, মাহমুদ কলিসহ সবাই। প্রয়াত অভিনেত্রী দিতির অকাল মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করলেন।

এবার দিদি আপনি কেমন আছেন জানার পালা। একরাশ দুঃখ নিয়ে বললেন, ভালো থাকি কি করে! বাবা-মা দু’জনেই গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো। যেদিন মা’র শাঁখা ভাঙার দৃশ্য দেখলাম সেদিনের কষ্ট তোমাকে বোঝাতে পারবো না। এই কষ্টের রেশ কাটতে না কাটতেই হঠাৎ আমার পৃথিবী আমার সবকিছু মা- স্বর্গবাসী হলেন। আমার চারপাশ শূন্যতায় ছেয়ে গেল। এই যে তুমি আজ আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছো, ক্ষুদ্র এই অভিনেত্রী অঞ্জুর সাফল্যের একমাত্র শক্তি ছিলেন আমার মা। দু’চোখ দিদির অশ্রুতে ছলছল করে উঠলো। দেখলাম পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম। বললাম, দিদি তুমি আজও এত সুন্দরী, কি রহস্য বলতো? দিদির সেই কি হাসি- হাঃ হাঃ হাঃ। হঠাৎ দিদি বললেন, তুই লাকি। কারণ তুই যখন ফোন করলি তখন আমি পূজায় ছিলাম। যেখানে বাংলাদেশের সব কাগজকে না বলি, ভগবান জানে তোকে না বলতে পারিনি কেন। তুই বললি, দিদি তুমি আমাকে পারমিশন দাও তোমার বাসায় আসার জন্য। আমিও প্রমিজ করছি তোমাকে পিছনে বাংলাদেশে ফেলে আসা সোনালি অতীতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিয়ে যাবো।

onju-beder-meye-josna3

ধীরে ধীরে অতীতের ঝাঁপি খুলে বসলাম, দিদিও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। দিদি বর্তমানে তোমার সময় কিভাবে কাটে? অনজু বললেন, আমি জনপ্রিয়তা, রুপালি জগতের মোহ- সেই সব থেকে অনেক দূরে। পূজা অর্চনা করি, মাঝে মধ্যে জিমে যাই, ফুলের বাগানের পরিচর্যা করি, সময় কেটে যায়। সত্যি আর ভালো লাগে না এসব কিছু। কি লিখবে আমাকে নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের ছবি থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সময়টা অনেক বর্ণিল আমার। ঘুম নেই, সময়মতো নাওয়া-খাওয়া নেই। আজ কক্সবাজার তো কাল মানিকগঞ্জের ঝিটকা, আবার এফডিসি। চিত্রালীর বেলাল আমার ঘুমের ছবি তুলে ছাপিয়ে দিলো, আওলাদ ছায়াছন্দে আমার হাঁটুর উপরে শাড়িপরা ছবি ছাপিয়ে শিরোনাম করলো বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীল আগমন আরো কত কি? আমার গার্ডিয়ান আহমেদ জামান চৌধুরী, হীরেন দে, ইমরুল শাহেদ সবার আশীর্বাদে আজকের এই অঞ্জুর জন্ম। শরীফ, আওলাদ এরা আমার বন্ধু। ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র পর যখন পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় প্রযোজক আমাকে এদেশে এনে একে ছবি তৈরি করতে থাকেন তখনকার হিট নায়ক তাপস পাল আর আমি জনপ্রিয় জুটি। পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই যাই তাপস আর অঞ্জু। সে কি তুমুল জনপ্রিয়তা। এইচএমভি গোল্ডেন ডিস্ক দিয়ে সম্মানিত করলো আমাকে!

onju beder meye josna

সুখের খুব কাছাকাছি বোধহয় দুঃখ লুকিয়ে থাকে। আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিছু লোক আমার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করলো। যাকে আমরা ফিল্ম পলিটিক্স বলি। যাদেরকে বন্ধু ভাবতাম তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল। হঠাৎ আমি যেন আলো থেকে অন্ধকারে ছিটকে পড়লাম। একাকী হয়ে গেলাম। যে মা’কে ঘিরে আমার সবকিছু, সেই মা-ও হঠাৎ স্বর্গবাসী হলেন। আমি অসহায় হয়ে গেলাম। ঢাকায় যে অঞ্জু দিন-রাত শুটিং নিয়ে ব্যস্ত, কলকাতায় সেই অঞ্জু হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়লো। এটা যে একজন শিল্পীর জন্য কত কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক সেটা বোঝানোর মতো ভাষা, শব্দ মনে হয় পৃথিবীর কোনো ডিকশনারিতে নেই। রাজ্জাক ভাই, সৈয়দ শামসুল হক- এদের অসুস্থতা আমাকে ভাবায়, কষ্ট দেয়। চাষী ভাই, শিবলী ভাই, খোকন ভাই, বুলবুল ভাই, হান্নান ভাই এদের মৃত্যু আমাকে মর্মাহত করেছে। ওই সময় রোজিনা, অঞ্জু তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলে কেমন লাগে? রোজিনা ম্যাডাম তো আমার অনেক সিনিয়র ছিলেন। সে কি চিত্রালী ও ছায়াছন্দে দু’জনকে নিয়ে লেখালেখি!

আচ্ছা দিদি, মাহমুদ কলির সাথে আপনার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল? ওই প্রসঙ্গ বাদ দাও। কি হবে আর অতীত ঘেঁটে। আচ্ছা কলি সাহেব কেমন আছেন? ছেলেমেয়ে ক’জন? আচ্ছা দিদি, তুমি সংসার সাজালে না কেন? কে বললো আমি সংসার সাজাইনি। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোকই আমার পরিবার। তবুও দিদি তোমার যশ, খ্যাতি, অর্থ, বৈভব সবই রয়েছে, সংসার হলে ভালো হতো না? কাজের ব্যস্ততায় আমি সংসার কি জিনিস বুঝতে পারিনি। প্রেম কি জীবনে এসেছিল তোমার? দিদি এবার হেসে বললেন, সত্যি তোকে মারবো। আবার সাংবাদিকতা শুরু করলি। বললাম, না আজ শুধু আড্ডা হবে।

onju beder meye josna

১৯৮২ সালে এফ. কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ দিয়ে শুরু। ১৯৮৬ সালে ক্যারিয়ারের ছন্দপতন। আবার প্রবল প্রতাপে ফিরে আসেন ১৯৮৭ সালে। সর্বাধিক ১৪টি সিনেমায় সেই বছর অভিনয় করেন। অঞ্জুর ক্যারিয়ারে যেমন অশ্লীল ছবির তকমা রয়েছে তেমনি রয়েছে সৃজনশীল এবং সাহিত্যনির্ভর ছবিও- ‘রাই বিনোদনী’, ‘সোনাই বন্ধু’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’।

সূত্র : মানবজমিন, ১৩ মে ২০১৬

Similar Posts

error: Content is protected !!