বই বই এবং বই

books mohibur nikli

মহিবুর রহিম ।।

বাংলা ভাষার মৌলিক শব্দগরোর অন্যতম একটি শব্দ ‘বই’। ছোট্ট কিন্তু অসাধারণ ব্যঞ্জনাময়। একটি দারুণ সম্মোহন আছে শব্দটির মধ্যে। বই শব্দের আরও কিছু সমার্থক শব্দ আছে বাংলা ভাষায়। যেমন- ‘পুস্তক’ ফার্সিজাত শব্দ। ‘গ্রন্থ’ তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ। ‘কিতাব’ আরবি উৎস থেকে আগত। ‘পুঁথি’কে লোকায়ত বা লোকজ শব্দ বিবেচনা করি যদিও তা ফার্সি শব্দ। কী অসাধারণ একটি ব্যাপার। যত দিক থেকে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভার পাওয়া যায়, সব দিক থেকেই বইয়ের একটি সমার্থক শব্দ এসেছে। নিশ্চিত এটি একটি দুর্লভ ঘটনা। একটি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তার প্রয়োজনীয় শব্দ সম্ভার। একটি সমৃদ্ধ ভাষার জন্যে যে পরিমান শব্দ থাকা প্রয়োজন, আমরা জানি বাংলা ভাষায় তা নেই। যদিও বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু বাঙালির মননে এর বিশাল ঘাটতি আছে। বইয়ের প্রতি বাঙালির আগ্রহও অনেক কম মনে হয়।

অতি শৈশবেই বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বইকে প্রায় নিত্য সঙ্গী করে নিতে সক্ষম হই। আর তা সম্ভব হয় সাহস করে অনেক বই একসাথে পড়ার মাধ্যমে। আমি একটি বই পড়ে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। যার ফলে বইয়ের ভিতরের যে মূল রস, প্রধান যে আকর্ষণ আমাকে দারুণ মোহিত ও মুগ্ধ করেছে। অজান্তেই মনের মধ্যে একটি পাঠ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে। আমার মনে হয়েছে একটি বই যা দিতে পারে, আর কিছুই তা দিতে পারে না। বই অজানাকে জানাতে পারে, অদেখাকে দেখাতে পারে। মানুষের সব ধরণের অনুভবকে দিতে পারে সমৃদ্ধি। পৃথিবীতে সত্যিকারের যাদুকরী যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা একমাত্র বই। বইয়ের এই শক্তিটা আমি উপলব্দি করেছি, বই পাঠের মাধ্যমেই। কিছু কিছু বই আছে যেগুলোকে বলা যায় জ্ঞানের আকর। সব ধরণের জ্ঞানের জন্যে আমরা প্রধানত বইয়ের দ্বারস্থ হতে পারি। বহু বিষয়ে নির্ভরযোগ্য জ্ঞান আমাদের দিতে পারে বই। কিন্তু তা হতে পারে বইয়ের একটি ক্ষুদ্র গুণ! কারণ বই তো শুধু জ্ঞানের বিষয় নয়। বই আনন্দও বিলিয়ে দেয়। যে আনন্দ শরীর ও মনকে স্নিগ্ধ আর জাগ্রত করে। যে আনন্দ আমাদের অপার্থিব চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে। বই হচ্ছে এক্ষেত্রে নির্ভেজাল একটি সংযোগ সেতু।

বইকে একমাত্র সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সমুদ্র যেমন আমাদের মনে বিশালতার ধারণা দেয়, তেমনি বই আমাদের মনের ক্ষুদ্রতার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে রীতিমত অসীমের গান শোনায়। মানব জীবনের সার্থকতা আমরা বই পাঠের মাধ্যমে উপলব্দি করতে পারি। যারা বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়, তাদের একটি প্রাণি হিসেবে বেঁচে থাকা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। মানুষ হতে হলে যে মহত্তের সঙ্গে অটুট বন্ধনের প্রয়োজন পড়ে, তা আমাদের একমাত্র দিতে পারে বই। বই আমাদের চোখ বৃদ্ধি করে। কথাটা বলেছিলেন আমাদের একজন বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি লিখেছেন-‘পৃথিবীতে আর সব সভ্য জাতি যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের এক চোখা দৈত্যের মত ঘোৎ ঘোৎ করি আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কী? – প্রথমত বই পড়া এবং তাহার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি।’ মুজতবা আলীর ‘বই পড়া’ নামক সেই স্যাটায়ার প্রবন্ধের কথা আমাদের আজও মনে আছে।

আমার মতে শুধু চোখ বাড়াবার প্রশ্ন নয়, আমাদের বিশাল সম্ভাবনাময় সুপ্ত চেতনাকে কীভাবে জাগাতে পারি আমরা? প্রথমত উত্তর তো আসবে বই পড়ার মাধ্যেমে। আমরা প্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে চাই, এ ক্ষেত্রেও বই সবচেয়ে বেশি প্রেরণা যোগাতে পারে। যে প্রত্যশাকে বলা হয় নিয়তির দর্পণ, অবশ্যই বই সে প্রত্যাশার চারাগাছটিকে পূর্ণতা দিতে পারে। সুতরাং বইকে জীবনের নিত্য সঙ্গী করা ছাড়া অন্য উপায় কী? মহামতি কাউন্ট লিও তলস্তয় সম্ভবত এই চিন্তা করেই বলেছিলেন-‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন, বই, বই এবং বই।’

আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। তবু আমি উপলব্দি করি, বই আমাকে পথ দেখিয়েছে; যথার্থ সঠিক পথ। যে পথে যাওয়া আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আমরা কী তা এমনিতেই চিনে নিতে পারি? পারি না। এক্ষেত্রে বই আমাদের সবচেয়ে বড় পীর হতে পারে। মানুষ পীরের অনেক সমস্যা আছে, বইয়ের সে সমস্যা নেই। যদি আমরা বই নির্বাচন করে নিতে পারি, তা অবশ্যই ভাল। যদি আমরা তা না পারি, তাহলেও বইয়ের কোন কারণ নেই। কেননা বই আমাদের সঠিক পথই দেখাবে। কারণ বই কালের মতই নিরপেক্ষ। তার নিজের চিন্তা সে কারও উপর চাপিয়ে দেয় না। গ্রহণ বর্জনের বিষয়টি পাঠক সহজেই করে নিতে পারে। এমন অভয় আমি নিজেও উপলব্দি করেছি। কারণ বই পাঠে যে ব্যক্তিসত্ত্বা জেগে ওঠে, সে তার নিজের পথ নিজেই চিনে নিতে পারে।

একজন পাশ্চাত্য পণ্ডিত মার্টিন এফ টুপার বলেছেন-‘ একটি ভাল বই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, আজ এবং চিরকালের জন্য।’ বইয়ের এই গুরুত্বের কথা উপলব্দি করতে পারেন কেবল উন্নত জাতির মানুষেরা। কেননা তারা জানেন বই ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। বই সভ্যতার প্রধান বাহন। সভ্যতা আর জাতি গঠনের নেপথ্য শক্তি যোগায় বই। সম্ভবত সে কারণেই মেকলে বলেছেন-‘বরং প্রচুর বই নিয়ে গরিবী অবস্থায় চিলেকোঠায় থাকব, কিন্তু এমন রাজা হতে চাই না যিনি পড়তে ভালবাসেন না।’

অনেক বই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনাভিজ্ঞতাকে ধারণ করে আছে। মানুষের জীবনব্যাপী সাধনার ফলাফলও আমরা বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই। মানব জীবনের যে অতীত অভিজ্ঞতা তা মানুষ অধিকাংশই বইয়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে করে রেখে গেছে। সে অভিজ্ঞতার কথা পাঠ না করে আমরা অতীতকে উপলব্ধি করতে পারব না। ভবিষ্যতের প্রয়োজনেই আমাদের অতীতকে জানা প্রয়োজন। মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধেছে। অতি ছোট আকৃতির একটি বই কত বৃহৎ বিষয়বস্তুকে ধারণ করে আছে তা অনেক সময় কল্পনা করা যায় না। পৃথিবীতে যত মনীষী জন্মেছেন তারা কেউ বিখ্যাত হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তারা সাধনা করেছেন, এই সাধনার বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল বই। বইয়ের এই ভূমিকার কথা কত অসংখ্য জ্ঞানী গুণীরা বলেছেন তা শুমার করে বলা সম্ভব নয়। এক সময়ে রুশ সাহিত্য পড়ায় মনোযোগী হয়ে উঠেছিলাম। পুশকিন, দস্তভয়েস্কি, চেখভ, তলস্তয় ও গোর্কি দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এরমধ্যে তলস্তয়ের লেখার কথা আমি অনেকবার বলেছি। তাঁর ‘যুদ্ধ ও শান্তি’; ‘আনা কারেনিনা’; ‘পুনরুজ্জীবন’; ‘কসাক’; ‘হাজি মুরাদ’; ‘শয়তান’ কিংবা তাঁর অসাধারণ গল্পগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি না। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’; ‘আমার ছেলেবেলা’; ‘মা’ প্রথম পড়ার অভিজ্ঞতা আজও আমাকে আলোড়িত করে। নিঃসন্দেহে গোর্কির অভিজ্ঞতা ভিন্নমাত্রার। বই সম্পর্কে গোর্কির একটি বাণী আজও হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। তিনি বলেছেন-‘আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী।’ আমার নিজের কাছে মনে হয় একমাত্র বই আমার শিক্ষক, পথ প্রদর্শক। জীবনে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে পেয়েছি বইকে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা আমাকে দিয়েছে বই। তাই আমার প্রিয় বইগুলোকে কবর পর্যন্ত সঙ্গী হিসেবে পেতে আমি গভীর আগ্রহী।

মহিবুর রহিম : কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক। বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Similar Posts

error: Content is protected !!