মহিবুর রহিম ।।
মানুষের স্মৃতির জগতকে নানাভাবে আলোকিত করে রাখে শৈশবের বর্ণিল দিনগুলো। যখন জীবনের মূল্যবান সময় অতিক্রান্ত হতে থাকে, মানুষ ক্রমেই জীবনের গুরুত্ব বুঝতে পারে। তখন হারানো সময়গুলোর জন্য মনে একটা হাহাকার পড়ে যায়। হেলায় কাটানো শৈশবের স্মৃতিগুলো ক্রমেই উজ্জ্বল হতে থাকে। তখন হারানো অতীতের জন্য অনেক আক্ষেপ হয়। সময়ের গুরুত্ব বুঝতে না পারার আক্ষেপ। জীবনের মধুরতম ভুলগুলোর জন্য আক্ষেপ। তারপরও পুরনো স্মৃতিগুলো অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। অতীতকে জীবন্ত এক উপলব্ধির মধ্যে ধারণ করে; স্মৃতি যেন প্রজাপতির রঙিন পাখায় এঁকে দেয় একগুচ্ছ সুখ। মানুষ বুঝতে পারে জীবন হারায় না। জীবন জাগ্রত থাকে জীবনেরই নিবিড় সান্নিধ্যে।
শৈশবের ঈদের স্মৃতিগুলো আরো বেশি তাৎপর্যময়। তার কারণ ঈদের স্মৃতির সঙ্গে আনন্দের সংযোগ আছে। জীবন তাড়িত হয় সুখ ও আনন্দের জন্যে। যদিও মানুষ কোনদিন তার কাঙ্খিত সুখের ঠিকানা পায় না। তবে অতীত সাক্ষ্য দেয়, কখনো কখনো মানুষ সুখের সান্নিধ্য পেয়েছিল। তখন সে হয়তো তার মূল্য বুঝতে পারেনি। কারণ ‘মানুষ যা পায় তা চায় না। যা চায় তা পায় না।’ এখানে জীবনের একটা দ্বান্দ্বিকতা আছে। এই দ্বান্দ্বিকতাই ব্যর্থতা ও দুঃখের সীমাহীন রাজত্বে জীবনকে মধুরতম করে রাখে। ঈদ জীবনে এক অপার্থিব আনন্দের ছোঁয়া এনে দেয়। বিশেষ করে শৈশবের ঈদ উদযাপনের স্মৃতির ঢালিটা খুলে দেখি- আহা কী মধুরতম সময় পার হয়ে এসেছি। যেন মনে আজও এক ঝর্ণাধারা বয়ে যাচ্ছে। তার কলধ্বনি এখনো বেশ স্পষ্টতরো।
জীবনের প্রথম পর্যায়ের এক ঈদের কথা মনে পড়ছে। আব্বা আমার জন্যে একটা রঙিন শার্ট আর তার সাথে একটা ইংলিশ প্যান্ট বানিয়ে দিলেন। সে গুলো ঈদের দিন সকালে পড়েছিলাম। সাথে একটা লাল ফেজ টুপি। সম্ভবত কাগজে তৈরি ছিল। সকালে আব্বার সাথে নদীতে গোসল সেরেছি। সাত সকালে শত শত মানুষ গোসল করছে- অনেকে আবার সুগন্ধ সাবান ব্যবহার করে গোসল করছে। এ যেন এক অন্যরকম আবহ। যাদের জীবনে আনন্দ বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, তারাও আজ আনন্দকে নিয়ে মেতেছে। রঙিন জামাতে ধারণ করেছে আনন্দকে। সুগন্ধি দ্রব্যের সুবাসের সঙ্গে উড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। ঘরে ঘরে সেই আনন্দের রব। গ্রামে ঈদের আনন্দের মধ্যে কয়েকদিন চলে মেহেদি পরার পালা। এখানে মেয়েদেরই অংশগ্রহণ বেশি। তবে ছেলেরাও হাতে ও আঙুলে মেহেদি লাগায়। এই মেহেদি কোরবানির ঈদ পর্যন্ত হাতে থাকলে অনেক ছোয়াব হয় এমন জনশ্রুতি আছে। সে জন্য মেহেদি যত্ন করে দীর্ঘক্ষণ ধরে লাগাতে হয়। মেয়েরা হাতে পায়ে আলতা পরে ও সজ্জিত হয়। শৈশবে আলতার প্রচুর ব্যবহার দেখেছি। এসব কিছুতেই ছিল ঈদের আনন্দের বহি প্রকাশ। ঈদের দিন সকালে নানা রকমের শিরনি, সুয়াই, ফিরনি, পায়েস রান্না হয়। সাথে কত রকমের পিঠা। অনেক দিন ধরে চলে তাওয়া পিঠা কিংবা পাক্কন পিঠা বানানো। প্রতিবেশি ঘরে ঘরে দাওয়াত দেয়া হয়। কতজনকে জোর করে ধরে এনে খাওয়ানো হচ্ছে। কতজনের রাগ অভিমান ভাঙানো হচ্ছে। আব্বা সেই সকালে গিয়ে বুবুকে নিয়ে আসলেন। বুবুর জন্যে একটা শাড়ি আগেই কেনা হয়েছে। সেই শাড়িটা পড়ে বুবু উপাদেয় সুয়াই খেতে বসলেন। আমাকেও আদর করে খাওয়ালেন। বুবুর অনেক দুঃখ কষ্টের জীবন যেন নতুন পরাগ মেলে আজ জীবন্ত হল। মাকে দেয়া হল সুগন্ধি চালের খিঁচুড়ি আর তরকারি রান্নার ভার।
এবার ঈদের জামাতে যাওয়ার পালা। ঈদের জামাত হবে গ্রামের উত্তর পাশে একটা উঁচু টিলার মতো মাঠে। নদীর পাড় ধরে রাস্তাটি গিয়েছে সেদিকে। সকলেই সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করল। আমার এক ছোট চাচা আমাকে নিয়ে মাঠে রওনা দিলেন। বেশ দূরের পথ। কিন্তু সকলেই আনন্দ চিত্ত, তাই কারো ক্লান্তি নেই। মাঠের কাছে গিয়ে দেখা গেল- ইতোমধ্যে মাঠ প্রায় ভরে গেছে। আরও কত মানুষ আসছে। সকলেই দল বেঁধে বেঁধে আসছে। মাঠ থেকে কিছুটা দূরেই হবে, সেখানে ষাঁড়ের লড়াই শুরু হয়েছে। সেদিকে ছোট ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। কিন্তু আমার মনে তো একটা অজানা ভয়। এত বড় মাঠ, এতো মানুষের সমাগম, সবই তো প্রথম দেখা। এত হৈ হুলোড় কী আগে দেখা হয়েছে? মুরব্বিরা ষাঁড়ের লড়াই থামিয়ে দিয়েছেন। এখন নামাজ পড়া শুরু হবে। আমি তো খুবই ছোট। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ দেখছি। সব মানুষ সিজদায় যাওয়ার পর কী সুন্দর লাগছে। আবার তারা উঠছে- আবার সিজদায় যাচ্ছে। বিশাল উন্মুক্ত মাঠে এ এক অসাধারণ সৌন্দর্য। আমাদের সারা গাঁয়ে ঈদের মাঠ ছিল এই একটা। তাই এখানে অগণিত মানুষের সমাবেশ। নামাজ শেষে মোনাজাত হল। আমি মোনাজাতে অংশ নিলাম। ইমাম সাহেব অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করছেন। মোনাজাতে কতজনের চোখে ছিল পানি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তারা কান্না করছেন। আল্লাহর কাছে শান্তি চেয়ে, জীবনের সমৃদ্ধি চেয়ে কান্না করছে সবাই। কিন্তু আমি অপলক শুধু দেখছি। সবই তো নতুন দেখছি। এই নতুনের আকর্ষণ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। উন্মুক্ত বিশাল আকাশের নিচে সারা গাঁয়ের মানুষ একত্রিত। এত মানুষের সমাগমে সৃষ্টি হয়েছে একটা ভিন্ন রকম আমেজ। ঈদের জামাতের সৌন্দর্য কী কম আকর্ষণীয়? মাঠের সৌন্দর্য, ফসলের সৌন্দর্য, নদীর সৌন্দর্য এতটা হৃদয়ভেদী নয়। এ জগতে মানুষের সৌন্দর্যের চেয়ে বড় কোন সৌন্দর্য নেই। ঈদের বিশাল জামাতে তাই যেন চোখে পড়ে। মানুষকে একত্রিত ঐক্যবদ্ধ করা গেলে, আর মানুষের মনে শুভবোধকে জাগ্রত করা গেলে এই সৌন্দর্যকে স্থায়ী করা সম্ভব হত। ঈদ যেন আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। দীর্ঘক্ষণ খুতবা আর মোনাজাতের পর ঈদের জামাত সমাপ্ত হল। এবার সকলেই কোলাকুলি করছে। একজন আরেকজনের কুশল জিজ্ঞাসা করছে। জামাত শেষ হওয়ার পর মানুষ যেন বেড়ে গেল। অনেকেই বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। কিন্তু মাঠের পূর্ব প্রান্তে পুরো দমে শুরু হয়েছে ষাঁড়ের লড়াই। একটি নয়, বেশ কয়েকটি লড়াই। সেখানে তরুণ যুবকদের হট্টগোল হৈ চৈ। আমি লড়াই দেখছি বেশ দূর থেকে। কেননা এ ষাঁড়ের লড়াই ভয়েরও ব্যাপার আছে। কী তাগড়া তাগড়া ষাঁড়গুলো- একটি আরেকটিকে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে নিয়ে চলেছে। সেদিকের মানুষজন ও দ্রুত সরে পড়ছে। কতজন পদপিষ্ট হচ্ছে। ষাঁড়ের লড়াই কখনো কখনো ঘণ্টাও পার হয়ে যায়। পরিসমাপ্তি হয় না। অনেক সময় ষাঁড়গুলো শিং-এর গুঁতোয় ক্ষত বিক্ষত হয়। তখন সে গুলোকে চিকিৎসা দিতে হয়। আবার বেশি আহত হয়ে পড়লে জবাইও করে ফেলতে হয়। গ্রামের মানুষদের এইসব নিয়েই আনন্দের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হয়। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বন্দী মানুষের এই ছিল সংস্কৃতি। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শাসন ও শোষণ পীড়িত। জমিদার ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে নিপীড়িত মানুষেরা এখানে প্রায় দুশবছর আগে একটি গ্রাম গড়ে তুলেছিল। এরা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকার থেকে নিদারুণভাবে বঞ্চিত।
আমরা ষাঁড়ের লড়াই অসমাপ্ত রেখে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় কী দীর্ঘ মানুষের সারি। আমাদের গ্রামে এত মানুষজন চিন্তাই করা যায় না। মানুষের সারিতে গ্রামের নির্জন পথগুলো মুখরিত হয়ে উঠেছে। পথে পথে কতজন আমাকে কাঁধে নিয়েছে, কোলে নিয়েছে। বাড়িতে যেতে সাধাসাধি করেছে। তারা সকলেই আমাদের আত্মীয় স্বজন। ঈদের দিনে এমন কত আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যেতে হয়, খেতে হয়। আবার কতজনকে বাড়িতে এনে খাওয়াতে হয়। আমার মা ও আব্বা মানুষজনদের খাওয়াতে আনন্দ পেতেন। মা‘র হাতের রান্নাও ছিল অন্যরকম। খিঁচুড়িতে মা নিজের হাতে করা ঘি ব্যবহার করতেন, আবার কী একটা সুগন্ধিও ব্যবহার করতেন। যার কারণে রোজার ঈদের খিঁচুড়ি হয়ে উঠতো উপভোগ্য। মা মুরগিও রান্না করতেন সেই মত। সবই তো ছিল আমাদের নিজের ঘরের জিনিস। তরতাজা, ফ্রেশ। ঈদের জামাত থেকে বাড়িতে ফিরে খাওয়া-দাওয়া আর আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা শুরু হলো। এভাবে ঈদের দিনটি কতো উপভোগ্য আনন্দের মাধ্যমে শেষ হতো। নির্জলা সহজ সরল জীবনের আনন্দ এখন যে চিন্তাও করতে পারি না। দিন কাল কত বদলে যায়! মানুষ তার নিজের চিন্তা ভাবনার দ্বারা তৈরি করে জটিল থেকে জটিলতর বাস্তবতা। যে বাস্তবতা এক দীর্ঘ অজগরের মতো গিলে ফেলতে চায় জীবনের সহজ সৌন্দর্যগুলোকে। আজকে শহরে যে আমরা ঈদ উদযাপন করে থাকি- তা খুবই সীমিত পরিসরে, অনেক একাকীত্বের মধ্যে। এখানে কৃত্রিমতা, ভেজাল কত দ্রুত আমাদের গ্রাস করছে। শুধু ঈদের জামাতের বড় সমাবেশটি ছাড়া বড় প্রাপ্তি আর তেমন নেই। আত্মত্যাগের মনোভাব ছাড়া তা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
“ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ॥”
মহিবুর রহিম : কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক। বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।