মো: আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ) ।।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলাকারী জঙ্গিরা শহরের নীলগঞ্জ রোডের এক বাসায় ১ জুলাই থেকে অবস্থান করছিল। তারা শহরের নীলগঞ্জ রোডের একটি তিন তলা বাসার নিচতলার দু’টি রুম ভাড়া নিয়েছিল বলে জানা গেছে। সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট ওই রুমটি এখন সিলগালা করে রেখেছে।
ওই বাড়ির সামনে পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। ঈদের দিন সকালে বাড়ির মালিককে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে তারা আর বাসায় ফিরে যায়নি। পুলিশের ধারণা ওই বাসাতে বসেই জঙ্গিরা হামলার পরিকল্পনা করে। ওই বাড়িটি ঘিরেই এখন সন্দেহের ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে। মালিকের সাথে ওই ছেলেদের পূর্বপরিচয় ছিল কি-না বা অন্য কোনো কানেকশন ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঈদের দিন রাতে র্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে বাসার মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখন তিনি আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন।
বাড়িটির মালিক সাবেক খাদ্য কর্মকর্তা মো. আবদুস সাত্তার। তার বাড়ি কটিয়াদী উপজেলার সহস্রাম-ধুলদিয়া ইউনিয়নের রায়খলা গ্রামে। তিনি সর্বশেষ নরসিংদীর মনোহরদীতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং সেখান থেকে অবসরে যান। পেনশনের টাকা দিয়েই তিনি ২০১০ সালে এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, জুলাই মাসের এক তারিখ বিকেলে জয়নাল আবেদীন নামে এক যুবক বাড়ির সামনে টু-লেট সাইনবোর্ড দেখে নিচতলার দুটি রুম ভাড়া নেয়। ওইসময় ছেলেটি আমাকে জানায়, তারা চারজন এখানে থাকবে। তারা সবাই গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ছাত্র। দু’জন ইংরেজি ও দু’জন অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করছে বলে পরিচয় দিয়েছিল। তারা এতদিন মেসে থাকছে। ওই মেসে পড়াশোনা ঠিকমতো হয় না বলে বাসা ভাড়া নিচ্ছে।
তিনি জানান, জয়নাল আবেদীন তার বাড়ি ময়মনসিংহের আশিমপুর বাজার এলাকায় বলে তাকে জানিয়েছিল। এ সময় তিনি বলেন, ঈদের পরে তারা আর বাসায় ফিরে যায়নি।
র্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানতে পেরেছেন, ওই বাড়িতেই জঙ্গিরা অবস্থান করছিল। হামলার পর ওই ছেলেগুলো ফিরে না আসায় এ সন্দেহ সঠিক বলে মনে হচ্ছে।
রোববার দুপুরে শহরের নীলগঞ্জ সড়কের ৪৩২ নম্বর পরশমনি নামে ওই তিনতলা ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায় পুলিশের একটি গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে বাড়িটি। এ সময় কিশোরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক মো. সালাহউদ্দিন জানান, এটিই সেই বাড়ি।
বাড়ির মালিক জানান, ওরা ২ জুলাই থেকে তার বাড়িতে উঠে। তাদের সাথে ব্যাগ ছাড়া কিছুই ছিল না। বিছানাপত্র ও আসবাবপত্র বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তারা এগুলো পরে কিনে আনবে বলে জানায়। তিনি দাবি করেন, তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারা ঈদের পরে এগুলো তাকে দেবে বলে জানায়। তাদের কোনো ছবি রাখেননি তিনি। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে বাসা ভাড়া দিলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঈদের পরই পেয়ে যাব, এ বিশ্বাসে বিষয়টি নিয়ে চাপাচাপি করিনি।
নীলগঞ্জ সড়কটি শোলাকিয়ার খুব কাছাকাছি একটি এলাকা। এ সড়ক ধরে খুব সহজে শোলাকিয়ায় যাওয়া যায়। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, যোগাযোগের সুবিধা ও অপারেশন করে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগসহ সবকিছু বিবেচনায় এ বাড়িটিই হয়ত হামলাকারীদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় মনে হয়েছিল।
সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীরা নীলগঞ্জ সড়ক ধরে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকে রেললাইন পার হয়ে বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে শোলাকিয়া মাঠে যেতে চেয়েছিল। ওই সড়কের মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট থাকায় বাধার মুখে পড়ে তারা। বাধা পেয়ে সেখানেই পুলিশের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।
বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, ছাত্র পরিচয়ধারী জয়নালকে মাসিক ছয় হাজার টাকায় নিচতলার পেছনের দুটি কক্ষ ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। তারা অগ্রিম দুই হাজার টাকাও তাকে দিয়ে যায়। তিনি জানান, ২ জুলাই বিকেল থেকে বাসায় যায় তারা। তখন তিনি বাসায় ছিলেন না। তার এক আত্মীয়ের মৃত্যুজনিত কারণে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।
ওই এলাকার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ঈদের দিন রাতে এ বাড়িকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌঁড়ঝাঁপে তিনি অবাক হন। পরে জেনেছেন, এ বাড়িতে না-কি জঙ্গিরা আস্তানা করেছিল।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, তিনতলা বিশাল বাড়িটির দোতলার কাজ শেষ হয়েছে। তিন তলার ছাদ হলেও এর কাজ শেষ হয়নি। মালিক নিজে দোতলার একটি ইউনিটে থাকে। নিচতলাসহ দোতলার বাকি ইউনিটগুলো ভাড়া দিয়েছেন তিনি। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, সবগুলো ইউনিটে ভাড়াটিয়ারা পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির মালিক কেন হঠাৎ করে নিচতলার ওই দুটি কক্ষ সন্দেহভাজনদের ভাড়া দিতে গেলেন।
র্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের অধিনায়ক রাজিব কুমার দেব জানিয়েছেন, বাড়ির মালিককে ঈদের দিন রাতে র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছিল বলে তাদের ধারণা। হামলার পর ওই বাসার নতুন ভাড়াটিয়ারা ফিরে না আসায় তাদের এ সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়েছে। তবে এখনও বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তারা এ বিষয়ে আরো তদন্ত চালাবেন।