বড় হাওরে নৌকাডুবি : যে মৃত্যু কাঁদালো সবাইকে

hafij uddin kishoreganj

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

শনিবার রাত ৮টা। বৃষ্টি হচ্ছিল টিপটিপ। করিমগঞ্জের কান্দাইল দারুসসালাম দাখিল মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক হাফিজ উদ্দিনের পুরো পরিবার ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ এসে নামেন তারা। পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে জয়কার বারুক বাজার পর্যন্ত এসে কোনো নৌকা না পেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। হাফিজ উদ্দিন তখন বাড়িতে। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে নিজেই মাঝারি এক ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে শিশুসন্তানদেরসহ পরিবারকে এগিয়ে নিতে আসেন। ঘাট থেকে বাড়ির উদ্দেশে ট্রলার ছাড়ার পরই হাওরে শুরু হয় ভীষণ বাতাস। বাড়ি আরো ৩ কিলোমিটার দূরে। উথাল-পাথাল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে ছোট নৌকাটি এক সময় খাড়া হয়ে ডুবে যায়। নৌকার একটি মাথা কেবল কিছুটা ভেসে থাকে। তখন নৌকার ভেতরে স্ত্রী-সন্তানসহ হাফিজ উদ্দিনের পুরো পরিবার আটকা পরে। কোনো চিন্তা না করে পানিতে ঝাঁপ দেন তিনি। একে একে সবাইকে নৌকার ভেতর থেকে বের করে নৌকার ভেসে থাকা ছইয়ের ওপর এনে দাঁড় করান। ছই-ও ঢেউয়ের ঝাঁপটায় আস্তে আস্তে ঢুবে যেতে থাকল।

তিনি তখন বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে শক্ত করে ধরে রাখো। আর আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকো’। বলেই প্রথমে তিনি আদরের ছোট ছেলে তাসনিমকে (৯) আরো নিরাপদে রাখার জন্য তাকে নিয়ে সাঁতার দেন। তাসনিমকে পিঠে নিয়ে হাওরের প্রচণ্ড ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতরে প্রায় ৪/৫ গজ দূরের একটি বিদ্যুতের টাওয়ারের নিরাপদ উচ্চতায় উঠিয়ে বসিয়ে রেখে আসেন। কিছুক্ষণ পর অন্যদের এ টাওয়ারে আনতে আবার সাঁতরে নৌকার কাছে যেতে চান তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড ঢেউ আর বাতাসে ক্লান্ত হয়ে এক সময় তিনি নিজেই ডুবে যান পানিতে। অন্য সবার জীবন বাঁচলেও হারিয়ে যান তিনি।

তখন প্রায় দুই ঘণ্টা নৌকার ছই আর টাওয়ারে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে থেকে হাফিজ উদ্দিনের পরিবারের আটজন সদস্য অসহায়। তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শুনে পাশের এক মাছের খামার থেকে একটি ট্রলার গিয়ে উদ্ধার করে সবাইকে। কিন্তু হাফিজ উদ্দিনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

hafij uddin kishoreganj
পানিতে হারিয়ে যাওয়া মাদ্রাসা সুপার হাফিজ উদ্দিন

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের জয়কা ইউনিয়নের বড়হাওরে এভাবে নিজের জীবনের বিনিময়ে পুরো পরিবারের জীবন রক্ষা করেন কান্দাইল দারুস সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. হাফিজ উদ্দিন (৪৭)। তার নিখোঁজে এখন পুরো হাওর জুড়ে কান্নার রুল। যেই শুনছেন, সে-ই চোখের পানিতে ভাসছেন। শনিবার ১৬ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রোববার সকালে কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের লোকজন চার ঘণ্টা পানিতে তল্লাশি চালিয়েও এ মাদ্রাসা শিক্ষকের খোঁজ পায়নি। ফায়ার স্টেশনের ইনচার্জ নাঈম ইবনে হাসান জানান, সকাল আটটা থেকে দুই আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করা যায়নি। হাফিজ উদ্দিন উপজেলার গুণধর ইউনিয়নের ইন্দা গ্রামের বাসিন্দা।

মাদ্রাসার সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মো. সাইদুল ইসলাম খান বলেন, হাফিজ উদ্দিনের পুরো পবিবার ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন বাড়িতে। শনিবার সন্ধ্যার পর ঢাকা থেকে প্রথমে কিশোরগঞ্জ যায়। পরে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করেন। হাফিজ উদ্দিনও এলাকা থেকে ছোট একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে পানাহার বারুক বাজারের কাছে পরিবারের লোকজনকে নিতে আসেন।

তাদের বহনকারী নৌকাটি এলাকার বড়হাওর দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই শুরু হয় প্রচণ্ড বাতাস। বড় বড় ঢেউয়ে দোল খেয়ে এক সময় নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় নৌকাতে হাফিজ উদ্দিনের স্ত্রী রোহেনা বেগম (৪০), মেয়ে খাদিজা (২০), ছেলে আনরুল্লাহ (১৮), বাহালুল (১২), আমিনুল (১০), আলা-আমিন, তাসনিম (৯) ও চার মাস বয়সী নাতি নাসিরুল্লাহ ছিল।

জানা গেছে, এ সময় নৌকার মাঝিরা যে যার মতো সাঁতরে নিজেদের জীবন বাঁচায় পরিবারটির সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।
খাদিজা জানান, তারা সবাই নৌকার ভেতরে ছিলেন। নৌকাটি ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যেতেই তার বাবা লাফ দিয়ে পানিতে নেমে সবাইকে বের করে ভেসে থাকা অংশ দাঁড় করান। আর তাসনিমকে নিয়ে বিদ্যুতের টাওয়ারের দিকে সাঁতার দেন। এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার কলিজার টুকরা সন্তানদের বাঁচাও।’ খাদিজা বিলাপ করতে করতে বলেন, বাবা নৌকায় নিরাপদ না ভেবে সবাইকে ওই বিদ্যুতের টাওয়ারে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেলেন পানিতে।

হাফিজ উদ্দিনের ভাই মাওলানা উসমান হারুনি জানান, তার ভাই স্ত্রী-সন্তানদের এমন ভালোবাসতেন, অনেক সময় এটাকে বাড়াবাড়ি বলে মনে হতো। তার সামর্থে না কুলালেও সন্তানদের কালোমুখ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সেই কারণেই হয়তো পরিবারের সবাইকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তার মরিয়া চেষ্টা ও সন্তানদের বাঁচানোর লড়াই বিফলে না গেলেও পরিবারটিও তো অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেল। এখন তাদের কী হবে!

এখন হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। বেঁচে যাওয়া ছেলেরা বলছে, খালি বাবার কথা মনে হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাফিজ উদ্দিনের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর হলো।

এলাকাবাসী জানায়, হাফিজ উদ্দিন খুব ভালো লোক ছিলেন। চাকরিটিই তার একমাত্র সম্বল ছিল। সহায় সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। এ ঘটনায় পরিবারটি বিপদে পড়ে যাবে। সরকারের উচিত পরিবারটিকে সহযোগিতা করা।

করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আছমা আরা বেগম বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফিজ উদ্দিনকে উদ্ধার অভিযান এখনও চলছে। ফায়ার সার্ভিসসহ স্থানীয় জেলেরা হাওরে জাল ফেলে তার লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। প্রশাসন এ পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। সব ধরনের সহযোগিতা তাদের দেয়া হবে। যে ব্যক্তি নিজের জীবন বাজি রেখে সবার জীবন বাঁচালেন, তিনি নিশ্চয়ই মহান ব্যক্তি। তার ত্যাগ ও দায়িত্ববোধ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির রাব্বানির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা লাশটি উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

Similar Posts

error: Content is protected !!