বিশেষ প্রতিনিধি ।।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক শ্মশ্মানখলা গণহত্যা দিবস ২য় বারের মতো পালিত হয়েছে। নিকলী শহীদ স্মৃতি পরিষদ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে বুধবার ২১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিবসটিকে উদযাপন করা হয়।
ভোর বেলায় শহীদবেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, প্রাণ হারানোদের আত্মার শান্তি কামনায় সংকীর্তন, সারা দিনব্যাপী কাঙ্গালি ভোজ, সন্ধ্যায় নিকলী পুরান বাজার মাছ মহালে আলোচনা সভা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের উপহার সামগ্রী দেয়া শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কর্মসূচী।
উল্লেখ্য, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উপস্থিত ২১টি পরিবারের সদস্যদের উপহার সামগ্রী দেয়া হয় ইতালি প্রবাসী নিকলীর কৃতি সন্তান শওকত রানার সৌজন্যে।
গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া বাদল বর্মণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন কিশোরগঞ্জ জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম, শিক্ষক শাহ আহসান উল্লাহ, বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নিকলী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় সাহা, এ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ প্রমুখ। বক্তারা তাদের বক্তব্যে স্বাধীনতার পর অদ্যাবধি শ্মশ্বানখলায় কোন শহীদবেদী, দিবসটি উদযাপনে প্রশাসনের কোন উদ্যোগ না থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
গণহত্যায় নিহতদের পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদা প্রদান, সরকারি ভাতা প্রদানসহ বেঁচে যাওয়াদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান।
এলাকাবাসী ও গণহত্যায় প্রাণ হারানোদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, বাংলা সালের ৬ আশ্বিন। উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের মিস্ত্রিপাড়া থেকে পাক মেজর দোররানী ও রাজাকার কমান্ডার (তৎকালীন থানার ওসি) হোসেন আলীর নির্দেশে স্থানীয় দালাল শান্তি কমিটি ও সেই সময়কার দামপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব আলী ওরফে ট্যাকার বাপের নেতৃত্বে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ ৩৯ জনকে নিরাপত্তা কার্ড দেয়ার নাম করে ২টি নৌকায় উঠানো হয়।
সিরাজ, সানাইসহ কয়েক রাজাকারের তত্ত্বাবধানে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় রাজাকার ক্যাম্প নিকলী থানায়। এদের মধ্যে বাদল সূত্রধর, বাদল বর্মণ, সুনু বর্মণ, গোপাল সূত্রধর বয়সে কিশোর হওয়ায় রাখা হয় থানা লকআপে। বাকিদের পিঠমোড়া বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চালানো হয় নির্যাতন। ক্ষণে ক্ষণে লাঠি আর বেয়নেটের খোঁচাখুঁচি চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পাকমেজর দোররানীর (নিকলী জিসিপি উচ্চ বিদ্যালয় পাক ঘাঁটিতে অবস্থানরত) সাথে ওয়ারলেসযোগে সিদ্ধান্ত নেয় হোসেন আলী। রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ওই ৩৫ গ্রামবাসীকে থানার নিকটস্থ সোয়াইজনী নদীর পশ্চিমপাড়ের শ্মশ্মানখলা ঘাটে সাঁরিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে চালানো হয় ব্রাস ফায়ার। রাজাকারদের সহযোগিতায় গুলিবিদ্ধ ৩৫ জনকেই হলুই (মাছ গেঁথার বড় সুঁই সদৃশ) করে নিয়ে যাওয়া হয় ধুবলারচর নামক হাওরে। মৃত্যু নিশ্চিৎ করতে বর্ষার পানিতে ডুবিয়ে দেয় সবাইকে।
কামিনী বর্মন নামে একজন কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান। ভোর বেলায় ছেড়ে দেয় থানা লকআপের ৪ কিশোরকে। ততক্ষণে হাওরের জলে ভেসে গেছে তাদের মা-কাকীর সিঁদুর। বিধ্বস্ত কিশোরদের চোখে প্রতিশোধের আগুন। উপায়ান্তর না দেখে যোগ দেয় এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। রাজাকার ঘাঁটির পথ-ঘাট চেনানোসহ নানা কাজে সহযোগিতা করে দেশ স্বাধীন হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।