শিমুল আপা ও আমার অ্যাম্বুলেন্স দেখা

red light ambulance

আজমল আহসান ।।

কথাটি শুরুতেই বলে নেয়া ভাল- বাড়ি থেকে নানাবাড়ি বেশি দূরে না হওয়ায় সেখানে কেবল একা একা বেড়ানোর অনুমতি ছিল। অথচ আমাদের দাদাবাড়ি একটু দূরে ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় সেখানে একা যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কাছাকাছি থাকা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ছাড়া একা একা কোথাও যাওয়া হয়নি ছোটবেলা থেকেই।

১৯৯১ সালের কথা। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তারিখটি ঠিক মনে নেই। তবে দিনটি আমার জন্য খুবই উম্মাদনাময় ছিল সেটুকু বলতে পারি। ফেলে আসা ঐদিনগুলো মাঝে মাঝেই শিহরিত করে।

আমার বাল্যবন্ধু রবিনের সাথে বেড়াতে যাওয়া আমার না দেখা এক জায়গা। রবিন আমার বন্ধু হলেও তাদের সাথে আমার ও আমাদের ছিল পারিবারিক যোগসূত্র। তাই তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে এবং অনেককেই আমি খুব ভালভাবে চিনি ও জানি। তারাও আমাকে চেনেন জানেন। ঠিক তেমনটি রবিনের বেলায়ও। আর শিমুল আপা, তিনি হলেন রবিনের খালাত বড় বোন।

শিমুল আপা সম্পর্কে সেই ছোটবেলা থেকে অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু অতীব দুঃখ ছিল তার সাথে দেখা হয়নি বলে। খুব আগ্রহ ছিল সবসময়ই তাকে দেখার জন্য ও তার সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করারও। তার এত গুণের কথা শুনেছি, যা বলে শেষ করা যাবে না। আর সে জন্যই রবিনের খালার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানার তসরা গ্রামে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হওয়া। যাওয়ার দিনটিতে আমার সে কি উচ্ছ্বাস। কারণ, একাকী আর কখনো বের হওয়া হয়নি। তার ওপর সম্পূর্ণ অদেখা, অচেনা এক জায়গা ভ্রমণ। সেই সাথে জড়িয়ে আছে আপুকে দেখার দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে।

বন্ধু রবিন প্রায়ই তার খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। আর কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি খড়মপট্টির আজিমউদ্দিন ভবন। ফুফুর বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের নওমহল। সবখানেই তো তার আসা-যাওয়া পান্তাভাত। আর আমি, একা একা নিকলী উপজেলার বাইরে কিশোরগঞ্জ শহরেও যাইনি আগে কখনো।

দুই বন্ধু মিলে কিশোরগঞ্জ হয়ে রওনা হলাম তসরার উদ্দেশ্যে।

রিকশাযোগে নিকলী থেকে করগাঁও। তারপর বাসযোগে কিশোরগঞ্জ শহর। আবার সেখান থেকে গাইটাল বাসস্ট্যান্ড। ওখান থেকে ময়মনসিংহের বাসে করে আমাদের যাত্রা শুরু। রাস্তাঘাট আমার পরিচিত না হলেও বন্ধু রবিনের অনেক পরিচিত। তার অনেকবারই আসা-যাওয়া হয়েছে এই রাস্তায়। কিশোরগঞ্জের বাইরে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত ছিল তার চেনা।

গাইটাল বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পর দেখলাম আমার এই গুণধর বন্ধুটির কত যে জানাশোনা! তার নানাবাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরে হওয়ার সুবাদে অনেকেই তাকে চেনে ও জানে।

আমরা দুই বন্ধু বাসে চড়ে বসলাম। আমরা ছাত্র হওয়ায় বাস কন্ডাক্টরকে হাফ ভাড়া দিতে চাইলাম। কিন্তু সে প্রথমে অস্বীকৃতি জানাল। পরবর্তীতে যা ঘটল, তা আমাদের হিসাবের সম্পূর্ণ বাইরে। বাস আমাদের তসরা পর্যন্ত নিয়ে তো গেলই আবার বাসস্ট্যান্ডে সম্মানের সাথে নামিয়ে দিয়ে একটি রিকশা করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেলো। তার কোনো মাহাত্মই আমরা বুঝতে পারিনি। যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন জেনেছিলাম বিষয়টি। (এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিধায় উল্লেখ করা হলো না)

রাস্তায় আমরা গাড়ি-ঘোড়া কত কিছুই না দেখেছি। বাসে যাতায়াতে আমার খুব কষ্ট হত বিধায় আমি বসেছিলাম জানালার পাশে। নয়ন ভরে দেখছিলাম গ্রামগুলো পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি গন্তব্যের দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত।

শিমুল আপার মুখেই হয়তো প্রথম শুনেছিলাম অ্যাম্বুলেন্সের কথা। আর অ্যাম্বুলেন্স দেখা তো হয়-ই-নি। অ্যাম্বুলেন্স যে একটি বাহন যা রোগী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয় তাও বুঝেছিলাম শিমুল আপার কাছ থেকেই। রাতে গল্প করতে করতে তিনি বলেছিলেন অ্যাম্বুলেন্স কি এবং এ দিয়ে কী করা হয়।

আমার তো আগ্রহ অনেক গুণে বেড়ে গেছে। পারলে এক্ষুণি ধরে নিয়ে আসি অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু এ কি সম্ভব? তারপরও শিমুল আপা অ্যাম্বুলেন্স দেখাবেন বলে আমাদের নিয়ে বাড়ির সামনে গেলেন রাতের বেলায়।

দলনেতা শিমুল আপা। সাথে আমি, রবিন ও ছোটবোন পাপিয়া। আমরা গল্প করছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল শেয়াল মামারা। আমরা বেশ কয়েকজন হওয়ায় আমাদের কাছে আসার সাহস করেনি। শুনেছি তারা নাকি খুবই দুরন্ত ও দুঃসাহসী।

হঠাৎ কানে ভেসে আসলো হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। শেয়াল যে এমন শব্দে ডাকে তা আগে আমি শুনিনি। আমি একটু ভীতু গলায় শিমুল আপাকেই জিজ্ঞেস করলাম- আপা এগুলো কিসের শব্দ? আপা হাসতে হাসতে খুব সুন্দরভাবে জবাব দিলেন- এগুলো শেয়ালের শব্দ। কেন তুমি আগে কখনও শেয়ালের শব্দ শোননি? আমি মাথা নেড়ে জানালাম, দেখা হয়নি। সকলে সশব্দে হেসে উঠল। আমি বোকা হয়ে গেলাম।

রাতের আঁধার ছাপিয়ে কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ আরেকটি নতুন ধরনের শব্দ কানে আসলো। এই ধরনের শব্দের সাথেও আগে কখনো পরিচিত ছিলাম না। সে শব্দ শুনে আমি চুপই ছিলাম। আর অমনি শিমুল আপা নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললেন- ওই দেখো রাস্তায় একটি লাল বাতি দৌড়াচ্ছে। শব্দটা তো দেখানো যাবে না। তাই মনে রাখো এই দৌড় দেয়া লালবাতি থেকেই ওই শব্দটি আসছে। আর ওই শব্দটিকে বলে সাইরেন এবং সাইরেন ও দ্রুতগতিতে ছুটে চলা গাড়িটিকেই বলে অ্যাম্বুলেন্স। তখন আমরা উৎসুকভাবে রাস্তার পানে তাকিয়ে। সাগ্রহে অবাক দৃষ্টিতে দেখছি অ্যাম্বুলেন্স নামক বাতির ছুটে চলা। গাড়ি তো আর দেখিনি। তাই বাতিটিই বলা।

শিমুল আপার সাথে আমার এটিই প্রথম এবং শেষ দেখা। এরপর আর শিমুল আপার সাথে দেখা হয়নি। এতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। তিনি কোথায় কিভাবে আছেন তা-ও জানি না। খবর নেয়া হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু দেখা আর হয় না। তবে, যখনই দূর কোথাও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনি তখনই শিমুল আপাকে মনে পড়ে।

খুব মনে হয় শিমুল আপা। খুব, খু–উ—ব। মনে হবে বার বার, অন্তত যতবার সেই লাল সাইরেনঅলা গাড়ি ছুটবে। কানে আসবে সেই সেদিনের অচেনা শব্দ। স্নেহমাখা কণ্ঠও ততদিন মনে সাইরেন বাজিয়ে যাবে। ভালো থাকুন আপু।

Similar Posts

error: Content is protected !!