রিফাত আনজুম ।।
শৈশবে ভাইবোনদের ভেতর মা-বাবার আদর নিয়ে চলে কাড়াকাড়ি। কাকে মা-বাবা বেশি ভালোবাসেন তা-ই নিয়ে খুনসুটি। আর পরিণত বয়সে মা-বাবা যখন বার্ধ্যকের ঘরে, তখন দৃশ্যপট যায় পাল্টে। নিজের গড়ে ওঠা পরিবারে মা-বাবাকে বাদ দিয়েই চলে সব হিসাব-নিকাশ। ‘ঝামেলা’ এড়ানোর জন্য ভাইবোনেরা এ-ওর ঘাড়ে তাঁদের দায়িত্ব চাপাতে থাকেন, আর এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলে মন-কষাকষি। তাঁদের সান্নিধ্য তখন যেন আর কাম্য নয়। কখনো বা তাঁদের গুরুত্ব শুধু নাতি-নাতনির দেখভালের জন্যই।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু এখনকার আত্মকেন্দ্রিক সমাজে যখন পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে আসছে, তখন বৃদ্ধ মা-বাবা আর সন্তানের সম্পর্কের চেহারা মোটা দাগে এমনই। উল্লেখ করা যেতে পারে, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিল সংসদে পাস হয়েছে ২০১৩ সালে। সন্তান পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না দিলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এতে। নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত ভালোবাসার সম্পর্কে আনতে হয়েছে আইনি বাধ্যবাদকতা।
কেন এই ভাগাভাগি
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এই দীর্ঘ বার্ধক্যে প্রবীণেরা আবার যেন শৈশবে ফিরে যান। শিশুর মতোই অসহায়, অভিমানী, সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; সন্তানকে অবলম্বন করে বাঁচতে চান। একজন সন্তানের একার পক্ষে বয়স্ক মা-বাবার পুরো দায়িত্ব নেওয়াটাও বাস্তবে কঠিন। তাঁদের যত্ন-আত্তি, চিকিৎসা, ভরণ-পোষণের ভার সব ভাইবোন মিলে ভাগাভাগি করে নিতে চাইলেও অনেক সময় পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। অনেকে পেশাগত ব্যস্ততার কারণে, অনেকে আবার জীবনসঙ্গীর বাধায় এ দায়িত্ব এড়াতে চান। অনেকে পিছপা হন অর্থনৈতিক অসচ্ছলতায়, কেউ কেউ স্রেফ আত্মকেন্দ্রিকতায় কিংবা স্বার্থপরতায়। ভাইবোনদের কেউ হয়তো ছোটবেলা থেকেই দায়িত্ব নিতে অভ্যস্ত। বাকি ভাইবোনেরা তাঁর ঘাড়েই মা-বাবাকে ফেলতে চান। কেউ আবার ছেলেবেলার ‘আদুরে’ কিংবা ‘আনাড়ি’ ভাবমূর্তি বজায় রেখে দায়িত্বের মতো গুরুভার নিতে নারাজ।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মা-বাবা ছেলের কাছে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অনেক সময় পুত্রবধূরা বাধা হয়ে দাঁড়ান। আবার মেয়ে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হন, তাহলে মা-বাবাকে নিজের সংসারে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বৃদ্ধবয়সে মা-বাবারা শারীরিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েন। মেয়েরা এ ক্ষেত্রে যতটা ইমোশনাল সাপোর্ট দিতে পারেন, ছেলেরা তা পারেন না। এখনকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে ছেলেমেয়েরা যাঁর যাঁর জীবন নিয়ে এতটা মগ্ন থাকেন যে, মা-বাবার জন্য সময় বের করাটা তাঁদের কাছে অসম্ভব মনে হয়। একাধিক ভাইবোন থাকলে দায়িত্ব নিয়ে চলে ঠেলাঠেলি। দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা শহরাঞ্চলে বেশি।’
এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট অধ্যাপক মেহজাবীন হক এই পরিস্থিতির মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং এ থেকে উত্তরণ নিয়ে বললেন। তাঁর কথা হলো, ‘বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়নের প্রভাবে পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও গড়ে উঠছে একক পরিবার বা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। এই অণু পরিবারগুলোর সন্তানেরা যখন দেখছেন মা-বাবা, দাদা-দাদি বা নানা-নানির দেখাশোনা করছেন না, তখন তাঁদের অবচেতন মনে দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা গেঁথে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তাঁরা এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন।’ মা-বাবা নিজেরা তাঁদের মা-বাবার প্রতি যত্নশীল হয়ে উদাহরণ স্থাপন করলে পরবর্তী প্রজন্ম এ থেকে শিখবে। এর পাশাপাশি সন্তানদের ভেতর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের বীজ বুনে দেওয়াটাও জরুরি। ভাইবোনদের মধ্যে আন্তরিকতা, বোঝাপড়া থাকলে বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে রেষারেষি হবে না।
দায়িত্বে সবার অংশগ্রহণ
মা-বাবার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে ভাইবোনেরা একসঙ্গে বসতে পারেন। কেউ অতীতে মা-বাবার প্রতি দায়িত্বে গাফিলতি দেখিয়ে থাকলে তাঁকে সেটা মনে করিয়ে দোষারোপ না করাই ভালো। তাতে পরিবেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শান্তভাবে পুরো বিষয়টা পরিচালনা করা উচিত। মা-বাবার শারীরিক অবস্থা, মানসিক চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করণীয় বিষয়গুলো ঠিক করে ফেলা যায়। মা-বাবা কী চান, কোথায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তা-ও মাথায় রাখতে হবে। দায়িত্ব ভাগাভাগির বিষয়টি সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট এবং বাস্তবসম্মত হওয়া চাই, যাতে পরে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে। ভাইবোনদের মধ্যে পুরোনো কোনো দ্বন্দ্ব থাকলে নিরপেক্ষ স্বভাবের কাউকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাখা যেতে পারে। প্রত্যেকের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় এনে ঐকমত্যে পৌঁছানো উচিত। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যাঁর ওপর মা-বাবার দৈনন্দিন দায়িত্ব বর্তাবে, তাঁর পাশাপাশি অন্যদেরও ঠিক করে নেওয়া উচিত যে সেই সময়টায় তাঁদের ভূমিকা কী হবে। মা-বাবার অসুস্থতায় কার কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা কাম্য তা-ও খোলাখুলি আলোচনা করে নেওয়া ভালো। যিনি অর্থনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, তিনি মা-বাবার আর্থিক প্রয়োজনীয়তার দিকটায় বেশি মনোযোগ দিতে পারেন। যিনি পেশাগত জীবনে অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত, তিনি মা-বাবাকে বেশি সঙ্গ দিতে পারেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যখন কর্মজীবী, তখন মা-বাবার যথাযথ সেবা-শুশ্রূষার জন্য নার্স বা আয়ার সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু তাঁদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করলে সেটা স্রেফ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। কোনো সন্তান শুধু টাকাপয়সা দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা মোটেও কাম্য নয়।
শুধু দায়িত্ববোধ নয়, চাই ভালোবাসা
পরিণত বয়সে মা-বাবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে তাঁদের জীবন থেকে বাতিল করে দেন অনেকেই। অজুহাতের বিশাল তালিকা বানিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। অথচ এ দায়দায়িত্ব সব ভাইবোন মিলে পালাক্রমে পালন করলে কারও একার ওপর বিরাট চাপ পড়ে না। আবার মা-বাবা অনেক সময়ই সন্তানের প্রতি আকাশচুম্বী অবাস্তব প্রত্যাশা করে কষ্ট পান। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে বুঝিয়ে বললে ভুল-বোঝাবুঝি কমে যায়। তবে পুরো ব্যাপারটাকে শুধু দায়িত্ববোধের দিক থেকে দেখাটা হয়তো ঠিক হবে না। মা-বাবার অপরিসীম ভালোবাসার ন্যূনতম প্রতিদানও যদি কেউ দিতে চান, তাঁকে ভালোবাসাই দিতে হবে।
সূত্র : মা-বাবার দেখভাল নিয়ে ঠেলাঠেলি! (প্রথম আলো)