রোহিঙ্গা নির্যাতন ও সাগরে ভেসে যাওয়া অগণিত লাশ

sea vese thaka lash

ওয়াহিদ জামান ।।

সাগর তীরে কয়েক রোহিঙ্গা নারী-শিশুর লাশ আর সাগরের গভীরে অগণিত লাশ এবং বর্বর, অমানবিক পৃথিবীর অসভ্য রাজনীতি।

রাখাইন বৌদ্ধ আর মায়ানমারের সেনাবাহিনী মিলে শুধুমাত্র গত কয়েক মাসেই হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে পানিতে ভাসিয়েছে। অনেকের ধারণা যে বিতাড়িত এসব রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র নাফ নদীতে ভাসছে আর বাংলাদেশের উপকূলের দিকেই আসছে। ব্যাপারটা আসলে ওরকম নয়। অসহায় রোহিঙ্গারা অনিশ্চিত যাত্রায় যেমন পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে তেমনি পাড়ি জমাচ্ছে চীন, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের দিকে। চীন ইতোমধ্যেই তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তবে কাছের দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশেই। আগেও এমনটিই হয়েছে।

আশ্রয় নিতে আসা এসব রোহিঙ্গাকে যেসব নৌকা, মৃত লাশ আমাদের তীরে এসে ভিড়ে সেগুলোই শুধু আমরা দেখতে পাই। কিন্তু কত শত নৌকা যে গভীর রাতে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, কতশত লাশ যে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সমুদ্রের পানিতে পঁচে, গলে মিশে যায় সে খবর হয়ত কেউ রাখে না। সে খবর কোনো পত্রিকায় আসে না। সেসব গলিত লাশের ছবি ভাইরাল হয় না। আর সেসব ছবিকে নিয়ে ফটোশপ বিশেষজ্ঞদের নাচন-কোঁদন করতেও দেখা যায় না।

sea vese thaka lash
২০১৪ সালে আন্দামান সাগর থেকে লেখকের ক্যামেরায় ধারণ করা। ট্রলার ডুবিতে মৃত প্রায় ২০০ বাঙালি এবং রোহিঙ্গাদের ভেসে যাওয়া লাশগুলোর খণ্ডচিত্র

২০১৪ সালের মে মাসের কোনো এক দুপুরবেলার কথা। ভিয়েতনাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে আন্দামান সাগর পাড়ি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে ভেসে আসতে থাকা অসংখ্য লাশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই অদূরের একটি লাইবেরিয়ান জাহাজ থেকে রেডিও টেলিফোনিতে কল আসে। কথা বলে জানতে পারি, সেদিন সকালে এই জায়গায় এসে তারা অর্ধনিমজ্জিত একটি কাঠের ট্রলার দেখতে পায়। ট্রলারটিতে আঁকড়ে ধরে ৬ জন কোনরকমে বেঁচে ছিল। ৬ জনকেই তারা জীবিত উদ্ধার করেছে এবং এরা সবাই বাংলায় কথা বলতে পারে। যেহেতু আমাদের জাহাজটি বাংলাদেশি ছিল তাই লাইবেরিয়ান জাহাজটি আমাদের অনুরোধ করে যেন আমরা উদ্ধারকৃতদের সাথে কথা বলে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।

উদ্ধারকৃত ৬ জন নিজেদেরকে ভৈরব এবং নরসিংদীর বাসিন্দা বলে দানি করেন। তাদের ভাষ্যমতে, দালালদের খপ্পরে পড়ে ট্রলারে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫০ জন (অধিকাংশই রোহিঙ্গা হবে বলে আমার ধারণা) নিয়ে ট্রলারটি বার্মায় আসে এবং সেখান থেকে নারী, শিশুসহ প্রায় ৫০ জন রোহিঙ্গা নিয়ে মালয়েশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার কারণে আন্দামান সাগরের গভীরে এসে ট্রলারটি নিমজ্জিত হয়। ৬ জন ছাড়া বাকি সবাই পানিতে ডুবে মারা যায়। আমরা যে লাশগুলো ভেসে যেতে দেখছিলাম সেগুলো সেই হতভাগা বাঙালি আর রোহিঙ্গাদের লাশই ছিল। নির্যাতন সইতে না পেরে শান্তিতে একটু মাথা গোঁজার জায়গার আশায় সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে এভাবে আরও কতশত রোহিঙ্গার লাশ পঁচে, গলে সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়েছে তার হিসাব হয়ত কারও জানা নেই। তবে এটা তো সবারই জানা যে, শত শত বছর ধরে এই রোহিঙ্গারা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আসছে।

নিজ ভূমিতে নাগরিকত্ব হারিয়েছে রোহিঙ্গারা। সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে এই রোহিঙ্গাদের। রাখাইন বৌদ্ধ আর সেনাবাহিনী মিলে রোহিঙ্গাদেরকে পরিণত করেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতিতে। অথচ এসবের কোনকিছুই মায়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো, জাতিসংঘসহ ক্ষমতাধর সব দেশের মানবতাবাদী শাসকদের অজানা নয়। সবাই দেখেও কেমন জানি না দেখার ভান করছে।

খৃষ্টানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় যদি পূর্বতিমুর এবং দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা লাভ করতে পারে তাহলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনে কেন ক্ষমতাধর পশ্চিমা বিশ্ব নীরব!! মানবতার সার্বজনীন বুলি কি তাহলে শুধু নিজ ধর্ম আর নিজ জাতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ!! যে আমেরিকা আর পশ্চিমা বিশ্ব শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একের পর এক দেশে ধ্বংস করে দিতে পারে, মুসলিম বিশ্বের যে সব নেতারা যুগের পর যুগ ক্ষমতার মসনদে আসীন থাকতে পারে তারা কেন বর্বর জাতিগত নির্যাতনের দেশ মায়ানমারকে ধমকটুকুও দিতে পারে না!! অথচ যে ধরনের জাতিগত নির্যাতন মায়ানমারে হয়েছে তাতে ধমক না দিয়ে বল প্রয়োগ করে নির্যাতন থামাতে মায়ানমারকে বাধ্য করা দায়িত্ব ছিল বিশ্ব নেতাদের।

মায়ানমারে বহুবার গিয়েছি। এরা আমাদের থেকেও অনেক পিছিয়ে। শিক্ষাদীক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমাদের ধারে কাছেও নেই। এর পরেও এরা আকাশচুম্বী দেমাগ দেখানোর সাহস পাচ্ছে কিভাবে? পশ্চিমা বিশ্বের মানবতার বুলি আওড়ানো ভণ্ড নেতাগুষ্টি, মুসলিম বিশ্বের হারামখোর নেতাগুষ্টি দরকার ছিল না শুধুমাত্র মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশগুলোও যদি একবার মায়ানমারকে ধমক দিত তাহলেও অং সান সুচি এত সাহস পেতো না। আফসোস আর বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে, জাতিসংঘ সহ অন্য দেশগুলোও অং সান সুচিকে না থামিয়ে বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দিতে বলছে! ভাবখানা এরকম যে, মায়ানমার মারতে থাকুক আর বাংলাদেশ আশ্রয় দিতে থাকুক। এভাবে আশ্রয় নিতে নিতে যেদিন মায়ানমার রোহিঙ্গাশূন্য হবে সেদিন তো নির্যাতন থামবেই! আর বাস্তবতাও এটাই। বাংলাদেশ প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। আরও ৫ লাখকে যদি আশ্রয় দেয় তাহলে মায়ানমার আরো ১০ লাখকে বিতাড়িত করবে। বিতাড়িত করতেই থাকবে যতক্ষণ না মায়ানমার রোহিঙ্গাশূন্য হয়। বাংলাদেশ আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হবে আর সমুদ্র গলে যাওয়া, পঁচে যাওয়া লাশের অদৃশ্য সমাধিতে পরিণত হবে।

ভয় হয় প্রকৃতিকে নিয়ে, ভয় হয় সমুদ্রকে নিয়ে। বিশ্ব বিবেকের নিঃস্ব রূপ দেখে না জানি কোনদিন প্রকৃতি ক্রোধান্বিত আর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে। কোনদিন না জানি সমুদ্র ফুলে- ফেঁপে বহুদিন ধরে তার তলদেশে জমতে থাকা লাশের হাড় তীরের দিকে উদগিরণ করে দেয়!

তীরে পরে থাকা একটি শিশুর লাশ যদি আমাদের শোকান্বিত করে তাহলে মৃত মানুষের হাজার হাজার হাড়গোড় পরে থাকার দৃশ্য কি আমরা সহ্য করতে পারবো! সহ্য করতে পারবো কি সমুদ্রের ভয়াবহ উদগিরণ! সুনামি নামক উদগিরণ এত সহজে কি সহ্য করতে পেরেছিল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো !!

 

লেখক : মেরিন ইঞ্জিনিয়ার

সূত্র : লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত

Similar Posts

error: Content is protected !!