টগবগে তরুণ হামিদুল হক। সবেমাত্র মেট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করা ছাত্র। দেশমাতৃকার এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। বাড়ি থেকে অনেকটাই পালিয়ে যোগ দেন যুদ্ধে যাওয়া দলের শিবিরে। এমন দূর্বিষহ সময়ে কি করতে হবে, না করতে হবে বুঝেননি। শুধু দেশকে স্বাধীন করতে হবে, শত্রুমুক্ত করতে হবে- এই প্রত্যয় নিয়ে বের হন ঘর থেকে। ট্রেনিং করার উদ্দেশ্যে নিকলী থেকে আট/দশ জনের দলে তিনিও ছিলেন একজন। তাঁদের দলের অন্য লোকজন পুড্ডার অনেকের ভাগ হয়ে ভারতের চেলার দিকে চলে যান এবং পরবর্তী সময় পর্যন্ত একসাথে ট্রেনিং করেছেন কূর্শা মিয়া বাড়ির ইকবাল। পরবর্তীতে একসাথে যুদ্ধও করেছেন।
তিনি ট্রেনিং গ্রহণ করেন ইকুয়ান, চেরাপঞ্জী, ভারত। ট্রেনিং শুরুর সময়টি সঠিকভাবে মনে নেই। তবে তাঁর হিসাব অনুসারে জুন-জুলাইয়ের দিকে হবে। তাঁদের ট্রেনিং শুরুর সময়ে আগের ব্যাচ হিসাবে নিকলীর অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি পান। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নিকলীর আরেক সূর্যসন্তান মতিয়র রহমান (বীরবিক্রম)। ট্রেনিং শেষ করে বের হবার সময় তার সাথে দেখা হয়। তখন তরুণ হামিদুল হক ট্রেনিংয়ের জন্য ঢুকেন।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ট্রেনিং শেষ করে এসে দেশে ঢুকেন। তিনি প্রথম যুদ্ধ করেছেন অষ্টগ্রামে। ইটনাও গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানে কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। পরবর্তীতে করিমগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় (প্রয়োজনানুসারে) হানাদারমুক্ত করার জন্য। তবে স্মরণীয় যুদ্ধের মধ্যে ছিলো বাইল্লাবাড়ির যুদ্ধ।
হামিদুল হক (স্যারের) বিবরণে
দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাইল্লাবাড়ি, করিমগঞ্জ। গুণধর ক্যাম্প থেকে। কমান্ডার ছিলেন- মতিয়র রহমান (বীর বিক্রম), ঠাকুর (নামটি স্যার মনে করতে পারেননি)। এর মাত্র দু’দিন পরেই স্বাধীন হয় এ দেশ। হানাদারমুক্ত হয়। আমরা পাই নতুন একটি দেশ। বাংলাদেশ। যুদ্ধকালীন সময়ের একটি ভয়ঙ্কর দিন ছিল বাইল্লাবাড়ির সন্মুখ যুদ্ধের দিন।
ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে আমরা বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করে করে পরবর্তীতে করিমগঞ্জ থানার গুণধর গ্রামে এসে মিলিত হই অন্য মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে। ইকবাল সেখানে আগেই গিয়ে উপস্থিত ছিল। তার নানাবাড়ি সেখানে হওয়ায় ওখানে থেকে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমরা সবাই যাওয়ার পর তিনি গ্রাম থেকে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে এনে শাস্তি দেন। ওখানে আগে থেকেই বাইল্লাবাড়ি আক্রমণ করার জন্য তৈরি হচ্ছিল ২৫০-৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা।
বাইল্লাবাড়ি ক্যাম্পটি ছিল আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্যাম্প। আর সেটি আক্রমণ করার জন্য সবাই মুখিয়ে ছিলাম। সেখানে কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ইটনার ঠাকুর (নামটি স্যার মনে করতে পারেননি)। কমান্ডার আমাদের চারটি দলে বিভক্ত করে দিলেন। তার মধ্যে একটি দল পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে। প্রত্যেক দলে ৪৫ জন করে লোক দেয়া হল। দক্ষিণ দিকের দলে দুইটি এলএমজি ছিল। আর এলএমজি বাহিনী ছিল দলের অগ্রভাগে। এছাড়া প্রত্যেকেরই অস্ত্র হিসাবে ছিল থ্রী-নট-থ্রী রাই। আর আমি ছিলাম উত্তর দিকের দলে।
ওই দিন আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ৪-৫ গ্রুপ গেলাম করিমগঞ্জের বাইল্লা বাড়িতে হানাদারমুক্ত করতে। জায়গাটি ছিল আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই রাতে পজিশন নিয়ে বসলাম রাস্তার নিচে। রাস্তার একেবারে পাশ ঘেঁষে। গুণধর থেকে বাইল্লাবাড়ি যাওয়ার সংক্ষেপ রাস্তাটি ছিল ধানী জমির মাঝখান দিয়ে এবং আমাদের পজিশন নেয়া জায়গা থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু। দিনের বেলায় হানাদার বাহিনী আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তখন ওরা ওই রাস্তা দিয়ে না এসে অন্য বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়। বাইল্লাবাড়ির আশপাশেই তাদের বিভিন্ন বাঙ্কার ছিল। তারা সেখানে থেকে দিনের বেলায় বিভিন্ন সময়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। তারা বাঙ্কারে থাকায় আমরা তাদের সাথে পেরে উঠছিলাম না। কিন্তু মুহুর্মুহু যুদ্ধ হচ্ছিল।
বাইল্লাবাড়ির কাছে যাওয়ার সময় রাস্তাটি দক্ষিণ দিকে মোড় দেয়। উত্তর দিকের গ্রুপের লোক ও দক্ষিণ দিক থেকে আসা লোকদের পূর্ব দিকে যাওয়ার অন্য কোনো রাস্তা না থাকায় তারাও একসাথে মিলিত হয়ে ৯০ জন হয়ে যান। তারা ছিলেন উত্তর মাথায়। হানাদাররা পর্যায়ক্রমে বাঙ্কার থেকে গুলি করে আবার বাঙ্কারে চলে যায়; আর আমরাও গুলি চালাই। বাঙ্কারে থাকায় আমরা বেশি সুবিধা করা করতে পারিনি। সারাদিন কাটে এভাবেই গোলাগুলি করে। এক পর্যায়ে কিশোরগঞ্জের দিক থেকে ওপর থেকে একটি বিমানের আওয়াজ শুনে গোলাগুলি আপাতত বন্ধ রাখা হয়।
সন্ধ্যার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে একটি ট্রাক আসে ৩০/৩৫ জন লোক ভর্তি একটি দল (তাদের মধ্যে পুলিশ ও অন্যান্য লোক ছিল। আর্মি ছিল কিনা বলা যাচ্ছে না)। পশ্চিম দিকে আমাদের যে দল ছিল তারা ট্রাকের উপস্থিতি টের পেয়ে ভাগ হয়ে সরে যায়। অর্থাৎ নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ব্লক রেইডে ফেলে দেয়া হয় তাদের; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরাই পরে গেলাম তাদের কবলে। খোলা রাস্তা পেয়ে ট্রাক চলে আসে বাইল্লাবাড়ি বাজারের ভিতর হয়ে বাঙ্কারে। এরপর বাঙ্কার থেকে চলে আসে আমাদের কাছাকাছি। আমরা যাতে টের না পাই সেই জন্য তারা রাজাকারদের জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে পাঠায়। রাস্তাটা উঁচু হওয়ায় তারা আমাদের দেখতে পারেনি; কিন্তু আমরা তাদের দেখে ফেলি। বাজার এবং গুণধরের রাস্তার মাঝ বরাবর একটি ব্রিজ আছে।
তারা ট্রাক থেকে নেমে জয়বাংলা বলে শ্লোগান দিতে থাকে। আমরা তখন ভাবি আমাদেরই লোক। তখন আমাদের কমান্ডার বললেন- কেউ ফায়ার করো না। ওরা মনে হয় আমাদেরই সাথের কোনো গ্রুপ হবে। আমরা তখন পজিশন নিয়ে বসে থাকলাম। কোন ধরনের আক্রমণ করলাম না।
পতাকা নিয়ে রাজাকাররা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে ব্রিজের নিচ দিয়ে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। আর হানাদার বাহিনীর দোসররা (রাজাকার) রাস্তার নিচ দিয়ে ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে উঠে ওপর দিকে। পাক সেনারা ফাঁদ তৈরির মতো করে তখন একটু বামের অন্য রাস্তায় সরে অন্য দিক দিয়ে বিকল্প রাস্তায় আসতে থাকলো। আমাদের দলের বাম পাশে নিয়োজিত যোদ্ধাগণ পাক সেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পজিশন থেকে আস্তে আস্তে সরে যায় নিরাপদ স্থানে। আমরা রাস্তার দক্ষিণ পাশে অপেক্ষমান থাকাবস্থায় একটা রাজাকার ব্রিজের নিচ দিয়ে গিয়ে আমাদের অবস্থানের কাছে দাঁড়ায়। আমরা তাদের উপস্থিতি সঠিকভাবে টের না পাওয়ায় আমি দাঁড়িয়ে দেখি তাদের অবস্থান। তখনও ওই রাজাকারের কাছ থেকে ৫-৬ ফুট নিচে কিন্তু সে আমাদের লক্ষ্য না করায় আমরা নিরাপদেই ছিলাম। আমাদের অন্য গ্রুপগুলো চলে যাচ্ছে সেটি আমরা টের পাইনি। আমাদের উত্তরের দিক থেকে একটি রাজাকার আমাদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বলে শালারা জাগা (চলে যায়)। ওর এমন ধরনের দম্ভোক্তিপূর্ণ কথা শুনেই আমরা ফায়ার (ট্রিগার চাপলাম) ওপেন করলাম ওকে গুলি করে মারার উদ্দেশ্যে। আমরা অনিরাপদ; সেটি বুঝতে পারি তখন, যখন আমরা গুলি ওপেন করি। প্রথমে যদি তারা টের পেত তাহলে হয়তো ওই সময়ই আমাদের মেরে ফেলে দিত কিংবা ধরে নিয়ে যেত তথ্য সংগ্রহের জন্য।
এদিক ওদিক তাকালাম, দেখলাম আমাদের কেউ নেই। শুধু আমি আর ইকবাল ছাড়া। আর আমাদের প্রায় সবাই সরে গেছে নিরাপদ স্থানে। আমরা দু’জন সবার থেকে একটু আলাদা অন্য একপাশে ছিলাম বলে টেরই পাইনি। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌঁড় শুরু করলাম আর ইকবালকে বললাম তাড়াতাড়ি দৌড়াও আমাদের পিছনে কেউ নাই। সময় খুব কম। আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে পাক সেনাদের সামনে দিয়ে যেতে থাকলাম। কারণ, আমাদের একটাই রাস্তা ছিল আর তা ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে। ওরা আমাদের ৫-৬ ফুট রাস্তার ওপর থেকে গুলি করছে। আমরা দু’জন নিচের রাস্তা ধরেই ওদের পাশ দিয়ে প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় ধরে দৌঁড়াচ্ছি। কান ঘেঁষে, চুল ঘেঁষে গুলি যাচ্ছে টের পাচ্ছি। টের পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। সার্বক্ষণিক আল্লাহকে স্মরণ করছি আজ হয়তো আর প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরবো না। তারপরও ভাগ্যের ওপর ভরসা রেখে দৌঁড়াতে থাকলাম। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে বলতে থাকলাম আল্লাহ গুলি যদি লাগেই যেন সেটি মাথায় লাগে আর সাথে সাথে মৃত্যু হয়। পায়ে কিংবা অন্য কোথাও গুলি লাগলে ওরা ধরে ফেলবে। তখন ওরা অনেক কষ্ট দিয়ে আমাদের মারবে। থ্রী-নট-থ্রী রাইফেলটা বেশ ওজনদার (প্রায় সাড়ে চার কেজি)। নিজের জীবন বাঁচাতে তারপরও ওইটা নিয়েই দৌঁড়াচ্ছি। অস্ত্রটাকে ফেলি না। যদি ফেলে দিই তাহলে হয়ে যাব অস্ত্রবিহীন নিঃসঙ্গ। তারা গুলি করলে পাল্টা গুলি করতে না পারলেও ভরসা একটি আছে। আর ক্ষণে ক্ষণে হয়তো গুলি করতে পারব। ভয়টা দূরে থাকবে। আর তখন যুদ্ধ করে করে মরব। তবুও ওদের হাতে ধরা দিবো না।
আমার সাথে থাকা ইকবাল ওইদিন খুবই চঞ্চল ছিল। তাকে নিয়ে আমি বারবারই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমার পাশে থাকলেও সে বার বার উঁকি মারছিল শত্রুদের দেখার জন্য। আমি তাকে নিবৃত্ত করছিলাম যেন উঠে না দাঁড়ায়। পারছিলাম না। যতবারই সে দাঁড়িয়েছে ততবারেই আমি তাকে বসিয়ে দিয়েছি কিংবা নীচু করে দিয়েছি। পিছু হটার সময় সবকিছু খেয়াল করা হয়নি। এসব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখি ইকবাল পরে গেল বুঝতে পারলাম যে ইকবালের গুলি লেগেছে। আমি তুলে আনার চেষ্টা করেও নিজে ধরা পড়তে পারি এই আশঙ্কায় আর তার কাছে যাওয়া হয়নি। আমরা সকলে যখন মিলিত হয়েছি তখন জানতে পারি অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেদিন শাহাদাত বরণ করেছেন। পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর অনেক দোসরও সেদিন মারা যায়। ইকবাল গুলিবিদ্ধ হয়ে কাদাপানিতে পড়ে গেলে তাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় এবং বুকে গুলিবিদ্ধ করে মেরে ফেলে। তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এতটাই নিকৃষ্ট ছিলো, সেদিন ইকবালকে রশি দিয়ে গাড়িতে বেঁধে বাইল্লাবাড়ি থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁর লাশ কি করা হয়েছিল তা আর জানা যায়নি।
আমরা একত্রিত হওয়ার পর সারাদিন পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ হলো। ওই যুদ্ধে নিকলী ও অন্য জায়গারও অনেকেই শহীদ হয়েছেন। বাইল্লাবাড়ি পাকবাহিনী মুক্ত হল।
দেশ স্বাধীন হল। বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরল আপন আলয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন দেশে সব বিভাগেই যোগ্যতাভিত্তিক লোক নিয়োগ চলে। সেই মোতাবেক তিনি যোগদান করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে। সুনামের সাথে চাকুরি করেন নিকলী উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে চাকুরির শর্তানুসারে মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। বর্তমান সরকারের বিশেষ আদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি আরো ৩ বছর বর্ধিত করা হয়। সেই অনুসারে ২০১৪ সালে সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক।
কত কষ্টের এই স্বাধীনতা, যার ইতিহাস শুনলে চোখে পানি এসে যায়। গা শিউরে ওঠে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখো বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাজি রাখার ইতিহাস লুকিয়ে আছে এ স্বাধীনতার পেছনে। সালাম জানাই তাদের প্রতি; যাদের রক্তের বিনিময়ে, যাদের জীবন বাজি রাখার বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, পেয়েছি পতাকা। পেয়েছি স্বাধীন মানচিত্র।
অনুলিখন : মোহাম্মদ আজমল আহছান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আমাদের নিকলী ডটকম।