আপন তারিক ।।
মাশরাফি বিন মর্তুজা শুধু একজন ক্রিকেটারের নামই নয়, লাখো মানুষের প্রেরণার বাতিঘরও। মাঠ এবং মাঠের বাইরের কোনো বিতর্কই তার ১৫ বছর ছাড়িয়ে যাওয়া ক্যারিয়ারে সামান্য কলঙ্কটুকুও লাগতে দেয়নি। টাইগারদের রঙিন পোশাকের অধিনায়ক সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক চরিত্র। মাশরাফি নামটাই যেন একটা মিথ। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যক্তিত্ব অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবর্তন ডটকমের। আমাদের নিকলী ডটকম-এর পাঠকদের জন্য তার হুবহু তুলে ধরা হলো।
মিরপুরে নিজের নতুন ফ্ল্যাটে প্রাণ খুলে বলেছেন নানা কথা। যেখানে আশরাফুল, মুস্তাফিজ থেকে শুরু করে ফেসবুক প্রজন্মের কথাও উঠে এসেছে। তিন পর্বের দীর্ঘ সেই সাক্ষাতকারের দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন আজ।
আপনার ইনজুরি নিয়ে মিথ আছে। সাতবারের বেশি বড় অস্ত্রোপচার হলো। ডাক্তাররাও নাকি একবার বলেছেন, ফের মাঠে নামলে এক সময় আপনাকে পঙ্গুত্ব মেনে নিতে হবে। হাটতেও পারবেন না? তারপরও কিভাবে ফিরে আসছেন?
-কিছু নিয়ম আছে, সেগুলো মেনে চলেছি। পুনর্বাসনের পুরো প্রক্রিয়ায় ডাক্তার, ফিজিওর কথা মেনে চলতে চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে বড় কথা মাঠে ফেরার একটা আকুতি সবসময়ই মনের মধ্যে নড়েচড়ে উঠতো। ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটা কিংবা, বিছানায় শুয়ে দিনগুনতে ভাল লাগে না আমার। সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে ভালবাসি। তাইতো দ্রুত মাঠে ফেরার একটা তাগিদ ছিলই। তার সঙ্গে মানসিকভাবেও সব সময় শক্তিশালী থাকতে চেয়েছি। সেটাই হয়তো প্রতিবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।
এভাবে সংগ্রাম করতে করতেই তো গত মাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার ১৫ বছর হয়ে গেল।
-যুগ পূর্তি কিংবা মাইলস্টোন, এইসব নিয়ে কখনোই আমার ভিতরে কোন অনুভূতি কাজ করে না। কিন্তু ১৫ বছর সেটা পার করা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জায়গায়। এই প্রসঙ্গটা নিয়ে আলাদা করে আসলে বলার কিছু নেই।
১৫ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক অর্জনই নামের পাশে যোগ হয়েছে। এমন কিছু অপূর্ণতা কি আছে যা কষ্ট দেয় আপনাকে? মনে হয় সেটা অর্জন করতে পারলে আরো ভাল লাগতো?
-ব্যর্থতা মানুষের জীবনে সব জায়গাতেই থাকবে। মানুষ যেমন সফল হয়, তেমনি আবার ব্যর্থতার বৃত্তেও বন্ধী হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। অপ্রাপ্তির পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। যা পেয়েছি সেটা নিয়েই থাকবো।
কলকাতার নামী সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন যে, দুই বাংলা মিলিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির পর আপনিই সেরা ক্রিকেটার, সেরা ক্যাপ্টেন, সেরা মোটিভেটর।
-এইসব প্রশংসার সরাসরি জবাব আমার কাছে নেই। আমার মতো করে আমি। মাঠে নামলে আমি আমার মতো করে যতটুকু পারি চেষ্টা করি। তখন সেটা কী হয় না হয়, সবই আসলে আল্লাহ’র ইচ্ছা। আমি শুধু আমার সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করে যাই। সেরা ক্রিকেটার কিংবা সেরা অধিনায়ক হতে হবে এসব ভেবে মাঠে নামিনি কখনো।
যখন খেলা থাকেনা, অনুশীলন থাকে না, তখন একটা দিন কিভাবে কাটে আপনার?
-বাসায় পরিবারের সঙ্গেই থাকি বেশিরভাগ সময়। দুই সন্তানকে সময় দেই। খেলার কারণে বেশির ভাগ সময়টাতেই তো ওদের সঙ্গে থাকা হয়না। এছাড়া মাঝে-মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে আসি।
ডায়েট প্ল্যানটা কি থাকে?
-আমার তো ইনজুরি আছে অনেক। এজন্য সবসময়ই একটা ছকের মধ্যে থাকতে হয়। নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় শরীরের ওপর। তবে বাসায় রান্না করা সব খাবারই ভাল লাগে আমার। যদিও আলুভর্তা, ডাল আর ভাত হলেই চলে আমার।
আপনার আশে পাশে কেমন মানুষ দেখতে চান? প্রতিটা দিন কারা ঘিরে থাকুক আপনাকে?
-আশপাশে যারা আছে তাদের নিয়েই খুশি। স্বাভাবিক মানুষ, নর্মাল মানুষ চাই। আমার যাদের প্রয়োজন তাদের না বরং আমাকে যাদের দরকার, আমাকে দিয়ে যাদের কিছুটা হলেও উপকার হবে তাদেরকেই চাই। নিজের প্রয়োজনে কাউকে ডেকে নিয়ে আসতে ভাল লাগে না।
জীবনের লক্ষ্যটা কিভাবে স্থির করেন?
-জীবনে কোন লক্ষ্য নেই। কখনো এমনটা ছিলোও না। আমি বর্তমানেই চোখ রেখেছি, রাখছি। ভবিষ্যতেও হয়তো তাই করবো। আমার কাছে এই যে আজকের সময় এটাই গুরুত্বপূর্ণ। কাল কি হবে, ভবিষ্যতে কি করবো, এমন লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে ভাল লাগে না।
যারা কিশোর কিংবা তরুণ, যারা ক্রিকেটে এসেছে কিংবা আসতে চাইছে তাদের কি বলবেন?
-তাদের আমি বলবো, আমার মতো চিন্তা না করতে। শুরুতে অবশ্যই একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। আমি ক্যারিয়ারে যেভাবে চিন্তা করতাম, সেটা হয়তো সবসময় ঠিকঠাক মতো হয়নি। তবে অনেস্টলি বললে- সবারই একটা লক্ষ্য থাকা উচিত যে একদিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলবো। সেই স্বপ্ন পূরণে কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে সেটারও একটা পরিকল্পনা এবং তার সঙ্গে বাস্তবায়নের লড়াই শুরু করতে হবে।
আর যে বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদের একজন মাশরাফি কিংবা সাকিব বানাবেন বলে স্থির করেছেন। আর তাদের নিয়ে যাচ্ছেন কোন কোচের কাছে। তাদের কি উপদেশ থাকবে?
-শৃঙ্খলা এবং শৃঙ্খলা। এটা থাকতেই হবে। পরিশ্রম করার মানসিকতাও থাকবে হবে। একইসঙ্গে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার তালিমটাও সেই ছোটবেলাতেই নিতে হয়।
ক্যারিয়ারের শুরুতে কাউকে আদর্শ ধরে শুরু করেছিলেন? এখন যেমন আপনাকে আদর্শ মেনে হাজারো কিশোর ব্যাট-বল হাতে নেয়?
-আমি যখন শুরু করি তখন ২০০০ সাল। তখন বাংলাদেশ দল এতোটা প্রতিষ্ঠিত না। আমরা সবে টেস্ট শুরু করেছি। ওয়ানডে ক্রিকেটেও তেমন সাফল্য নেই। খেলার সুযোগটাই কম মিলতো। তখন আকরাম ভাই, মনি ভাই (এনামুল হক মনি), রফিক ভাই, সুজন ভাই, পাইলট ভাইকে ভাল লাগতো। তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। তবে রোল মডেল যদি বলেন, সেটা অবশ্যই কোর্টনি ওয়ালশ। তাকে সব সময়ই ভাল লাগতো আমার।
আপনার ভক্তের অভাব নেই। এমন কী সোশাল মিডিয়াতে দেখেছি যে অনেকে তাদের নাম বদলে ‘মাশরাফি’ অংশটা নিজের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। ফেসবুকে আপনাকে নিয়ে প্রতিদিনই তাদের ভালবাসা, আবেগ ঝরছে..
-এমন ভালবাসা আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করে। তাদের বলবো- সব সময় আমার জন্য দোয়া করবেন। যারা পছন্দ করে, যারা আমাকে ভালবাসে, যারা চায় যে আমি ভাল খেলি বা ভাল কিছু করি, তারা আসলে আমার পরিবারেরই অংশ। যতোদিন পারি আপনাদের জন্য খেলে যাবো। সব মিলিয়ে আসলে তাদের ধন্যবাদ দিলেও কম হয়।
সন্তানরা বড় হচ্ছে। কন্যা হুমায়রাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। ছেলে সাহিল বেড়ে উঠছে। সময় যাচ্ছে, কেমন লাগে..
-এটাতো একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম। আমি ছোট ছিলাম। আমার বাবা আমার মতো ছিল। এখন তাদের বয়স হয়েছে। আমিও বড় হয়েছি।
আপনার ছেলে সাহিল যদি ক্রিকেটে আসতে চায় তবে কি বলবেন?
-আমি তাকে আসতে না-ই বলবো। চাইবো আমার সন্তান যেন ক্রিকেটে না আসে!
কিন্তু কেনো?
-আসলে এটা দরকার নেই। ক্রিকেটারের জীবন কোন জীবন নয়। হয়তো আলাদা একটা ফ্লেভার আছে। মানুষ হয়তো বা চিনবে। কিন্তু যদি ও ভাল কিছু করতে চায় তবে ক্রিকেটের বাইরেও অনেক কিছু আছে।
আপনার কাছে সুখের ব্যাখ্যাটা কি?
-সুখ হচ্ছে আপনার নিজের জিনিস নিজে ঠিকমতো করতে পারছেন কীনা সেটাই। সৎ থেকে সততা নিয়ে চলতে পারছেন কীনা সেটা। পরিবারটাই আসল আনন্দ। পরিবার ছাড়া আসলে কোন আনন্দ কিংবা সুখ নেই। আপনার খারাপ সময়েও পরিবার থাকবে, আবার ভাল সময়েও থাকবে। আমার মনে হয় পরিবারের সঙ্গে সবাই মিলেমিশে থাকাটাই আসলে ‘সুখ’, এটাই আনন্দের।
প্রথম কিস্তি পড়ুন : আশরাফুলকে এখনো বন্ধু জানেন মাশরাফি
তৃতীয় কিস্তি পড়ুন : হুট করেই একদিন খেলা ছেড়ে দেবো : মাশরাফি
সূত্র : ‘চাই না আমার সন্তান ক্রিকেটে আসুক’ (পরিবর্তন ডটকম)