কেমন আছে নরসুন্দার শাখা সুতি নদী

আজমল আহসানমীর কবির উদ্দিন ।।

দখল, দূষণে বিপন্ন আমাদের অহংকার সুতি নদী। এ নদীটি নরসুন্দার শাখা নদী। নখলা, পাড়দিয়াকুল, সুতি ও দিয়াকুল গ্রামের বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটি। এর উত্তরে পাড়দিয়াকুল ও নখলা আর দক্ষিণে দিয়াকুল। এ নদীটি নিকলীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ঘোড়াউত্রার শাখানদী নরসুন্দা হিসাবে ঢুকে পরবর্তীতে বড় হাওরের ভেতর দিয়ে লাহুন্দ গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে বয়ে এসে শাখা নদীটির নাম ধারণ করেছে সুতী নদী।

suti-river5

নখলা, পাড়দিয়াকুল, সুতি (আতখলা) ও দিয়াকুল গ্রামের ভেতর দিয়ে ঢুকে ও সোজা চলে যায় সেটি মানিকখালি ও এর হাওরবেষ্টিত এলাকায়। সুতি নদীর মাছ শিকারের ওপর ভিত্তি করে আশপাশের জেলে সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্ত বর্তমানে এ নদী নাব্যতা হারাতে হারাতে এখন প্রায় জায়গাতেই হয়ে গেছে ধানী জমি। যেখানে কিছু কিছু জায়গায় পানি জমা আছে সেখানেও চরম দূষণের শিকার। আশপাশের গ্রামগুলোর নানা রকমের ময়লা আবর্জনা পতিত হয় এই নদীতে। যেন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

suti-river4

আশপাশের গ্রামগুলোর টয়লেটের আশ্রয়স্থল এ সুতী নদী। যত রকমের ময়লা আছে সব কিছুরই আশ্রয়স্থল এই সুতী নদী। নদীটিকে দেখলে মনে হবে জবুথবু বয়ঃবৃদ্ধ কত অপরাধের অপরাধী সে। নদীর তীরবর্তী অধিকাংশ পরিবারের টয়লেটের আস্তাবল এই নদী। নদীর দিকে তাক করা তাদের টয়লেটের ময়লা নিষ্কাশনের পাইপ, বাড়ির সার্বিক পানি প্রবাহের রাস্তা। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত থাকলেও বর্তমানে শুকিয়ে পানি একেবারে নদীর তলায়। কোথাও কোথাও ধান চাষও হয়।

suti-river2

এ নদীর (যেসব জায়গায় ডোবা/পুকুরাকৃতি করে পানি ধরে রাখা আছে) পানিতে প্রতিদিন শতশত মানুষ ওজু, গোসল করে, মাছ ধরে। কিন্ত নদীর মাছগুলোও মৃত্যুর প্রহর গুণছে দূষণের কারণে। গোসল করলে নানা রকমের রোগে আক্তান্ত হচ্ছেন আশপাশের বাসিন্দারা। বিশেষ করে চুলকানি আর পানি দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় মুখে নিতে গেলেই বিপদের আশংকা। হতে পারে যে কোন ধরনের মারাত্মক রোগ এমন আশঙ্কা তো আছেই। নদীর যেখানে যেখানে পুকুরাকৃতি করে পানি ধরা আছে বা ডোবাকৃতির জায়গায় জমাটকৃত পানি আছে সেখানে আগো মতো এখনো শীতের শেষে মানুষ মাছ ধরতে নামে মহাউৎসাহে।

একটি সময়ে এই নদীর পানি দিয়ে হাওরের বোরো জমিতে ধান ওঠার আগ পর্যন্ত সেচের কাজ চলত। বর্তমানে সেচ কাজ চালানো তো দূরে থাক আগের মত নিত্যনৈমিত্তিক কাজ কর্মগুলোও করার কোন উপায় নেই। নদী খনন না হওয়ায় নাব্যতা হারিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় নদীর পানি প্রবেশ হওয়ার যেসব পথ ছিল সেগুলোও রাস্তা নির্মাণ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে পানির প্রবাহ বর্ষাকালেও থাকছে না। বর্ষায় যখন পানিতে ভরে ওঠে তখন বেশকিছু ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করতে দেখা যায়। তাতে বর্ষা মৌসুমেও পানি দূষিত হয় ইঞ্জিনের তেল, মবিল ও তেল-মবিল মিশ্রিত পানির মিশ্রণে।

suti-river

নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেত। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এখন এ নদী মাছশূন্য হওয়ার পথে। নদীপাড়ের জেলে পরিবারের অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা খুঁজে ফিরছে জীবন-জীবিকার তাগিদে। অনেক জেলে পরিবার আবার এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। উল্লেখ্য যে, দিয়াকুল গ্রামের গৌরাঙ্গের পরিবারসহ আরও অনেক পরিবার পৈত্রিক পেশা ছেড়ে জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়েছেন।

একটি সময় ছিল অন্তত বর্ষাকালে হলেও নদীতে পালতোলা নৌকা চলত; আজ এর কিছুই নেই। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া যায় অনায়াসে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নদীর বুকে ক্রিকেট খেলার মাঠ তৈরি করে খেলা করে থাকে। অবাধে চলছে তীরবর্তী কিছু অসাধু লোকদের নদী দখলের মহোৎসবও। নদীটি দিন দিন দখলী স্বত্ত্বে হয়ে যাচ্ছে তাদের সম্পত্তি। নদীটি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। খনন করা এবং দখলমুক্ত না করা হলে এটি শুধুমাত্র মানচিত্রেই থাকবে। হারিয়ে যাবে নদী। হারিয়ে যাবে নদীকে ঘিরে থাকা স্বপ্নগুলো। সুদিনের প্রত্যাশায় সুপ্রভাত বাংলাদেশ।

একটি সময় ছিল যখন এখানে নদী স্বরূপেই ছিল তখন নদীপাড়ের বিভিন্ন গাছে ও পানির ওপর পড়ে থাকা গাছ বা ভেসে থাকা লতাপাতায় দেখা মিলত পানকৌড়ি পাখি। দেখা যেত ডানা ঝাপটিয়ে বেড়ানো বালিহাঁসও। এখন আর দলবেঁধে আসে না; মাঝে মাঝে ২/১ টা চোখে পড়ে, সে-ও শিকারীর ভয়ে তটস্থ থাকে।

সুতী নদীর অন্য একটি অংশ যেটি সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে হাওরের দিকে সুতী ব্রিজের নিচ দিয়ে। এটি দিয়েও এক সময় প্রবল স্রোতের প্রবাহ ছিল। হাওরে পানির প্রবাহ থাকত সারা বছর জমিতে সেচের কাজে লাগত এই পানি। ভরে থাকত ডোবা ও বিলসমূহ। এই অংশটিও জরুরিভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন।

Similar Posts

error: Content is protected !!