নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ ।।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি, শ্রম আর মেধা-মননে জয় করা যায় অনেক কিছু। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা নিয়েও রাখা যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিশোরগঞ্জের প্রতিবন্ধী যুবক খায়রুল আলম বাদল এর জ্বলন্ত উদাহরণ। শৈশবে পোলিও রোগে পঙ্গু হয়ে গেলেও মানসিক দৃঢ়তায় খায়রুল আলম বাদল আজ সমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও অবদান রাখছেন অন্য প্রতিবন্ধীদের সহায়তায়।
ছোটবেলায় মায়ের কাছে সুই-সুতার শৈল্পিক কাজে হাতেখড়ি বাদলের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে রয়েছে তার প্রতিভার ছাপ। একই সঙ্গে তিনি চিত্রশিল্পী, কবি, গায়ক, গীতিকার, আবৃত্তিকার, বংশীবাদক, ডিজাইনার ও ভাস্কর।
মেধাবী বাদল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তিসহ কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৪ সাল থেকে শহরের একটি বিনোদন পার্কে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। ওই পার্কে তার শৈল্পিক ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ডিজাইন, পোর্ট্রেট আর ভাস্কর্য বিমোহিত করে বিনোদনপিপাসুদের। তার আঁকা বাংলা কৃষ্টি-সংস্কৃতির এম্বুস, বালি-সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ ভাস্কর্য, কুমির, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর ব্যাঙের ছাতার ভাস্কর্য মন কাড়ে সবার।
সৃষ্টিশীল কাজে দিনভর এখানে-সেখানে ছুটে চলেন বাদল। কখনও ভাস্কর্যে হাত বোলাচ্ছেন, কখনওবা অন্যদের নির্দেশনা দিচ্ছেন নানা কাজে। আর ছুটে চলার বাহনটিও তৈরি করেছেন নিজে। ওয়েল্ডিং করে তৈরি করেছেন ব্যাটারিচালিত ফোর হুইলার। দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রতিবন্ধীরা তার তৈরি ফোর হুইলার কিনে নিচ্ছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ললিতকলার এসব নান্দনিক চিত্রকর্ম তিনি শিখেছেন শুধু দেখে দেখে। খায়রুল আলম বাদল মনে করেন, প্রতিবন্ধীরা নিজেদের অসহায় না ভেবে মানসিক পরিবর্তন ঘটিয়ে উত্পাদনশীল কাজে এগিয়ে আসা উচিত। তিনি জানান, মানুষের মস্তিষ্ক ভালো থাকলে শরীরের কোনো একটি বা দুটি অঙ্গ অকেজো থাকলেও তাতে কিছু যায়-আসে না।
নিজের প্রতিভা যদি অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া না যায়, তবে সে প্রতিভার কোনো মূল্য নেই। সেই ভাবনা থেকেই কিছু একটা করার চিন্তা। আর প্রতিবন্ধীদের জন্য সামান্য হলেও অবদান রাখতে পারছি এটিই কম কিসে-বলছিলেন প্রায় ৫০ বছরে পা রাখা খায়রুল আলম বাদল।
খায়রুল আলম বাদল কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার বড়হাটি গ্রামের এমএ আজিজের ছেলে। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা বাদল। থাকেন শহরের সাদুল্লারচর এলাকায়। তার স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, ‘মানুষের মুখে আমার স্বামীর গুণের কথা শুনে এবং বিভিন্ন টেলিভিশনে তার অনুষ্ঠান দেখে মনটা গর্বে ভরে যায়।’ স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি সবসময় তিনি যত্নবান বলে জানান নাজমা।
বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানিতে সাঁতরানোসহ, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিজের প্রতিভা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন খায়রুল আলম বাদল। তার একটি জারিগানের দল রয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অনুষ্ঠানে জারিগান পরিবেশন করেছে তার দল।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম জানান, প্রতিবন্ধী হয়েও বাদল সমাজের বোঝা নন। বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে তার অবদান। কারও কাছে হাত পাতেন না। এমনকি সমাজসেবা বিভাগ থেকেও তিনি কোনো সহায়তা নিচ্ছেন না। তার যে কোনো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনে পাশে থাকবেন বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে সামাজিক জাগরণে ভূমিকা রাখায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট বাদলের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে ১৮ মিনিটের একটি জারি তৈরি করেছেন বাদল। তার ইচ্ছা, সুযোগ পেলে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জারিটি উপস্থাপন করা। সরকারি সহযোগিতা পেলে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার ইচ্ছার কথাও জানান তিনি।
সূত্র : হার না মানা বাদল [সকালের খবর]