অনুপম মাহমুদ ।।
১৭৮৩ সালে মেজর রেনেল কর্তৃক অংকিত ঐতিহাসিক মানচিত্রে নিকলী জনপদের নাম উল্লেখ আছে। ১৭৮৭ সালে যখন ময়মনসিংহ ৩৯ টি পরগনা নিয়ে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন নিকলী তার অন্যতম একটি পরগনা। মজার ব্যাপার হলো কিশোরগঞ্জ নামে তখন কোন গঞ্জ/ থানা/ মহকুমা হিসেবে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও দামপাড়া, সিংপুর, কুরশা, গুরুই, ডুবি, মিঠামইন এর নাম উল্লেখ ছিলো তখনও। ১৮২৩ সালে নিকলীতে থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারও তিন যুগ পর কিশোরগঞ্জ মহকুমা ও থানা একত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লেখ্য যে, কিশোরগঞ্জে মহকুমা প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর আগে ১৮৪৫ সালে নিকলী কে মহকুমা করার প্রস্তাব করা হলেও অজ্ঞাত কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। বঞ্চনার শুরু বোধ করি তখন থেকেই…
১৮৮০ সালে নিকলীতে মুন্সেফী আদালত প্রতিষ্ঠা হয়। যা পরবর্তীতে হোসেনপুর হয়ে কিশোরগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। পোষ্ট অফিস স্থাপিত হয় ১৯০৭ সালে। কটিয়াদি ও মিঠামইন এক সময় এই নিকলীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ব্রিটিশদের বিমান নিকলীর সোয়াইজনী ও নরসুন্দা নদীর পানিতে অবতরণ করতো সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। আন্তর্জাতিক ভাবে সোনালী আঁশ আমরাই রপ্তানি করতাম এবং এ-ও কথিত আছে নিকলী বাংলাদেশের দ্বিতীয় ড্যান্ডি বলা হত।
হাওড় সমৃদ্ধ জনপদ নিকলীর গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাসের পাতায় শোভা পায় সোনালী হরফে! এখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ। বর্তমানে এই উপজেলায় ৭ টি ইউনিয়ন আছে, যথা; নিকলী (সদর), দামপাড়া, সিংপুর, কারপাশা, জারইতলা, গুরুই ও ছাতিরচর। নিকলী-বাজিতপুর নিয়ে সংসদীয় আসন। পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার পর থেকে বরাবর বাজিতপুর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন দুয়েকবার ব্যতিক্রম ছাড়া। বাজিতপুরে পৌরসভা, রেলওয়ে ষ্টেশন (২টি), বেসরকারী মেডিকেল কলেজ, ডিগ্রী কলেজ থাকায় আগে থেকেই অগ্রগামী ছিলো।
মজার ব্যাপার হলো আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদ সাহেব আমাদের “নিকলী গোরাচাঁদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়” থেকেই মেট্রিকুলেশন পাশ করেছেন। তখন গোটা ভাটি এলাকায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা নিকলী আছে আগের মতোই, যেখানে অপরাপর এলাকা এগিয়ে গেছে বহুগুণ। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জকে বিভক্ত করে ভৈরব উপজেলাকে জেলায় উন্নীত করা নিয়ে গুঞ্জন জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। নিকলীকে কিশোরগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি অশুভ চক্রান্ত হতে পারে এই আশঙ্কায় ভাটির সন্তানেরা আজ সোচ্চার…
আমাদের অনগ্রসরতার মূল কারণ হচ্ছে অনৈক্য। এই সুযোগে বিভাজনের দেয়াল তুলে ফায়দা তুলেছে স্বার্থান্বেষী মহল। মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ সাহেব সম্প্রতি ভাটিতে এসে একটি সভায় বলেছেন, দিন বদলাইছে আমরা অহন আর “ভাইট্টা গাবর না…” আসলেই দিন বদলাইছে, আমরা এখন ডিজিটাল প্রজন্ম। কিশোরগঞ্জ থেকে সড়ক পথে নিকলী গেলেই আপনি বুঝতে পারবেন আমাদের উন্নয়নের বাস্তব চিত্র…
হাওরের লীলাভূমি এই নিকলীর দামপাড়ায় আমার জন্ম, এই মাটিতেই চির নিদ্রায় শায়িত আমার বাবা নিকলী উপজেলার তৃণমূল জনসাধারণের প্রাণের “নেতা”, মুজিব বাহিনীর তদানীন্তন কমান্ডার, বিপুল ভোটে বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যান (১৯৯০) মরহুম জননেতা ইদ্রীস আলী। আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন এই মাটি ও মানুষের জন্য। সুযোগ পেলে এখনো ছুটে যাই আব্বার কাছে। ভাটি এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রতিষ্ঠিত। যুগের পর যুগ তাই হয়ে এসেছে। এই দেশে এখন কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে আমাদের যোগাযোগ ও অবস্থান হবে দুটি ভিন্ন জেলায়?
হাওড় এর মূল জীবিকা কৃষি ও মৎস্য আহরণ। কার্যকর বাঁধ না থাকায় উজানের ঢলে হাওরের ফসল তলিয়ে যায় প্রায় প্রতি বছরই। নদীর নাব্যতা কমছে দিনের পর দিন। খালগুলো শুকিয়ে গেছে সেই কবেই। পল্লী বিদ্যুতের আসা যাওয়া এখন আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। তাই অনেকেই বলে বিদ্যুৎ এখন যায় না, মাঝে মাঝে আসে…
অপার জলমগ্ন হাওরের মৎস্য আহরণ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলেও প্রান্তিক জেলে সম্প্রদায় এখানে উপেক্ষিত। সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক বলয়ের কাছে জিম্মি গোটা হাওর এর জলমহাল। থেমে থেমে রক্তে রঞ্জিত হয় শান্ত হাওরের জলরাশি…
হাঁস পালন ও শুটকি উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হলেও আমরা খুব বেশী সুফল পাচ্ছি না যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার অভাবে।
শীতের মৌসুমে আগত অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুগ্ধতা ছড়ায় দৃষ্টিনন্দন হাওর। পর্যটন হাতছানি দেয়, নেই অবকাঠামো। তারপরেও দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকের ভীড় দেখা যায় নিকলীর বেড়ী বাঁধে। আমাদের নিকলীর ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচের সুনাম দেশজোড়া।
নিকলীর মেলা, ঈদ কিংবা পূজা পার্বণের চেয়ে কম জৌলুসপূর্ণ নয়। মেলার কয়েকটি দিন খুব আনন্দে কাটে আমাদের দিন রাত্রি।
দিনশেষে অন্ধকার, হিসেব মেলানো ভার… কি হতে পারতো আর আমরা কোথায়? এর জবাব দিতে হবে আমাদের নিকলীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তথা সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের।
স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবত উন্নয়নের খতিয়ান চাই। তা না হলে আসছে নির্বাচনে জবাবদিহি করতে হবে আপনাদের। জনতার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের মুখে কুলুপ এঁটে রাখলে উন্নয়ন বঞ্চিত থেকে যাবে নিকলী আর উন্নতি হবে কতিপয় দুর্বৃত্তের…
মনে রাখতে হবে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, কখনো কখনো তা আদায় করে নিতে হয়। উন্নয়নের স্বার্থে, আমাদের অনাগত প্রজন্মের কথা ভেবে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। দল মত নির্বিশেষে নিকলীর উন্নয়নে একটি কমন প্লাটফর্মে আসতেই হবে…
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী