মো. আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ)।।
হাওরে থামছে না কৃষকের কান্না। প্রতিদিনই বাড়ছে পানি। পানি বাড়ায় একের পর এক তলিয়ে যাচ্ছে আধাপাকা ধানের জমি। এ অবস্থায় কৃষকের কান্নায় হাওর পাড়ের বাতাস এখন ভারি।
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের মেঘনা, কালনী, কুশিয়ারা, ধনু, দাইরা, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরী, করাতিয়া, কলকলিয়া, বৈঠাখালী, কলমারবাক নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়েছে। এ অবস্থায় নদীর কূল উপচে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক হাওর। আগাম বন্যায় এরই মধ্যে কিশোরগঞ্জের বেশ কয়েকটি বড় হাওরসহ অন্তত ত্রিশটি হাওর পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
শুক্রবার ৭ এপ্রিল ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি, করনশি, মুদিরগাঁও, আলগাপাড়া, বীরকূল, ভয়রা, মৃগা, লাইমপাশা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় হেক্টরের পর হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার কৃষকেরা কাঁচা ধানও কাটতে পারেনি। মিঠামইন উপজেলার চারিগ্রাম ফুলপুর, কাটখাল, হাশিমপুর, কোলাহানি, গোবিন্দপুরসহ আশপাশের এলাকায় গিয়ে একই অবস্থা চোখে পড়ে।
করনশি গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এবার তিনি ১৯ একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন। তাঁর সব জমি তলিয়ে গেছে। এক ছটাক ধানও তিনি তুলতে পারেননি। হাবিব জানান, তাঁর এলাকার শত শত কৃষকের অবস্থা একই। কান্না ছাড়া এখন তাদের আর কোনো উপায় নেই।
মিঠামইনের চারিগ্রামের কৃষক মিলন চৌধুরী জানান, বানের পানিতে তাঁর ২৫ একর জমি তলিয়ে গেছে। কোলাহানি গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, এবার শুধু মানুষের খাদ্য ঘাটতিই হবে তা নয়, যাদের বাড়িতে গরু আছে তাঁরা গরুর খাবার নিয়েও বিপদে পড়বেন। এর জন্য অর্ধেক দামে অনেকে আগেভাগে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
ইটনা ও মিঠামইনের কৃষকেরা জানান, তাদের এলাকায় অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের চেষ্টায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগে ২০০৪ সালে হাওরের প্রতিরক্ষার জন্য ৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের ‘বিজয় বাঁধ’ নামের একটি বাঁধ নির্মিত হয়। ৪-৫ বছর কৃষকেরা এ বাঁধের সুফল পান। অথচ সরকার গত ১৩ বছরেও এ বাঁধে একটুও মাটি ফেলেনি। বাঁধের কোনো কোনো স্থান নিচু হয়ে গেছে। এ জন্য গত কয়েক বছর ধরে বাঁধের উপর দিয়ে হাওরে এসে পানি ঢুকে ফসলের ক্ষতি হয়।
ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মনির উদ্দিন জানান, ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জের কাকালছেও ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত এ বাঁধ। বিশাল এ বাঁধ এলাকায় ১৬ হাজার একরের চেয়েও বেশি জমি রয়েছে। মিঠামইনের কাটখাল, বৈরাটি, কেওয়ারজোড় ও ঢাকী, ইটনার জয়সিদ্ধি ও এলংজুরি এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এই ৭টি ইউনিয়নের অন্তত ২২ গ্রামের কৃষক বোরো চাষ করে এই বাঁধ এলাকার মধ্যে। বিশাল এ বাঁধের সংস্কার ইউনিয়ন পরিষদগুলোর উদ্যোগে করা সম্ভব নয়। জয়সিদ্ধিতে আমরা কিছু সংস্কার করেছিলাম। কিন্তু পুরো বাঁধের সংস্কার করতে হলে সরকার বা এলাকার সংসদ সদস্যের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে নজর দিচ্ছে না।
কৃষকেরা জানান, গত কয়েকদিনে এ বিজয় বাঁধ এলাকার অন্তত ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নিচে পড়ে পঁচে গেছে। প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। একইভাবে ইটনা উপজেলার ইটনা সদরের বেড়ারবন্দ, রায়টুটীর হাজলারকান্দা, আড়ালিয়া, ধারা ও গন্ধবপুর, বড়িবাড়ীর কনিয়ার হাওর ও পাটাইয়া বিল, চৌগাঙ্গার কয়রার হাওর এবং ধনপুরের হাপানিয়া হাওর, ষাটংগা ও নালুয়ার হাওর তলিয়ে গেছে।
এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ইটনার ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর, বস্তিপুর হাওর বাঁধ, গয়রার হাওর বাঁধ, তেড়ালিয়া হাওর বাঁধ এবং বোয়ালদা হাওর বাঁধের বাঁধ ছুঁইয়ে পানি ঢুকছে এবং ঝিয়লের বাঁধের লড়িখাই অংশে পানি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝিয়লের হাওর, কারার বন্দ হাওর এবং বস্তিপুর হাওর বাঁধ একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হওয়ায় এর যেকোন একটি বাঁধ ভেঙ্গে গেলে ৩টি হাওরই তলিয়ে যাবে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।
অষ্টগ্রাম উপজেলার বড় হাওরসহ শিয়াল ভাঙ্গা, কৈরাইল, আদমপুর, নুরপুর, সমারচর, আব্দুল্লাহপুর, কাকুরিয়া, চণ্ডিপুর, ইছাপুর, কলিমপুর, চরদেওঘর, আনোয়ারপুর, পানিতোলপা, চরপ্রতাপ, খারুয়াইল, লাউড়ার চর, হায়দরাবাদ হাওরের কাঁচাপাকা ধানীজমি তলিয়ে গেছে। বৈঠাখালী ও বিলমাকসার সংযোগ গাঙ্গিনার বাঁধ ভেঙ্গেও হাওরের জমি তলিয়ে গেছে। পাশ্ববর্তী বিলমাকসার বাঁধটি রক্ষার জন্য হালালপুর ও কাকুরিয়া গ্রামের ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ মাথায় মাটির বোঝা বয়ে বাঁধ রক্ষা করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কয়েকটি হাওর সরেজমিন ঘুরে ও কৃষকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে নদীর কূল উপচে বাঁধ ভেঙে কিশোরগঞ্জের নিকলী, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ ও বাজিতপুরে অন্তত চল্লিশ হাজার হেক্টর বোরো ধানের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
হাওরের কৃষকদের অভিযোগ, নদীখনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের মনোযোগ অনেকটাই কম। যে কারণে হাওরের মানুষ প্রতি বছর তাদের একমাত্র ফসল হারিয়ে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন। এ বছর যেভাবে ফসল নষ্ট হয়েছে নিকট অতীতে এমন দুর্যোগের কথা তাঁরা স্মরণ করতে পারছেন না। কৃষকদের দাবি হাওর অঞ্চলকে যেন সরকার দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ বছর হাওরের কৃষকদের কৃষি ঋণ মওকুফ, ফসলের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তাঁরা। পাশাপাশি নদী খনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে সরকার যেন মনোযোগী হন এ দাবিও করেন তাঁরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার হাওরে মোট ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে এ তিন উপজেলাতেই গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৩ হাজার ২৭০ হেক্টরের মতো জমি পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কৃষকেরা জানান ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় (কিশোরগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ফসলহানির ঘটনা ঘটছে না। যেসব হাওর তলিয়ে গেছে সেসবের বেশিরভাগই নদীর পাড় ডুবে পানি ঢুকছে। নদীর নাব্যতা হারানোই এর অন্যতম কারণ। তিনি এলাকায় অবস্থান করে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলেও জানান।