অনুপম মাহমুদ ।।
যখন দুরন্ত শৈশবের কোনো স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, ভয় হয়! বুড়ো হয়ে গেলাম কি? সময় পেলে তাই ঘুরে আসি একা নিভৃতে..
১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আমাদের স্কুল। কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় (গভমেন্ট স্কুল নামেই বেশি পরিচিত)। বাবু রামানন্দ এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করায় রামানন্দ স্কুল নামেও চিনে থাকেন মুরুব্বীরা। ১৯৯০ সালে আমার বাবা উপজেলা নির্বাচনে (নিকলী) ব্যস্ত ছিলেন। বিপুল বিজয়ের পর কিশোরগঞ্জ ফিরে আসি জুলাই মাসে। তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। তবে কি আমার একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে? ১৯৮৯ সালে সেন্টার (এখন বলা হয় পিএসসি) পরীক্ষায় জেলায় অবস্থান ছিলো ২১তম। আমি মানতে পারছিলাম না। অগত্যা সুপারিশে ভর্তি হই আগস্ট মাসে, আর সাথে সাথেই সেকেন্ড টার্মিনাল পরীক্ষা। দশটা বিষয়! এতো বই তো পড়ি নাই আগে, আমার মাথায় তখন শুধুই “আমার ভাই তোমার ভাই, ইদ্রিস ভাই, ইদ্রিস ভাই…”
২৮৫ পেয়ে লজ্জাজনক ভাবে ফেল করেছিলাম। সোহরাপ স্যার ছিলেন সিক্সের ক্লাস টিচার। ডেকে নিয়ে বললেনঃ “বাপধন, ফাইনালে এই রিজাল্ট করলে কিন্তু প্রমোশন পাইবা না”। ভয় পেয়ে গেলাম। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। শুরু হলো ফেইল ঠেকানোর যুদ্ধ। ফাইনালে পেলাম ৫৮২, ঠিক আগের রেজাল্টের উল্টো। স্যার বললেনঃ যাক বাবা, লাইনেই আছিস…
১৯৯২ সালে যখন ক্লাস এইটে পড়ি, একদিন স্কুলে যাইনি, গায়ে জ্বর ছিলো। তনু স্যার, কাজী স্যার আর পাঠান স্যার আমার কয়েকজন বন্ধুকে বাসায় পাঠালেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। জরুরি তলবে ছুটে এলাম। স্যারেরা বসেছিলেন কমনরুমে। বললেনঃ চল, শোলমারিয়ায়। উপজেলা পরিষদে যেতে হবে শিশু একাডেমীর মৌসুমি প্রতিযোগিতা আছে। তুই সাধারণ জ্ঞান, উপস্থিত বক্তৃতা আর বিতর্ক করবি। আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ভয়ে ভয়ে বললামঃ স্যার, আমি তো কখনো এইসব করি নাই। আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তনু স্যার বললেন, আমি বলছি তুই যাবি, ব্যস। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা একটা ছাড়া সব বিভাগেই চ্যাম্পিয়ান হয়েই জেলা পর্যায়ে পৌছেছিলাম। সেখান থেকে বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে গিয়েছিলাম। স্যারদের সেদিনের এই আবিষ্কার আমাকে এখনো ভাবায়, কিভাবে উনারা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে আমি পারবো!
১৯৯২ সালে বিএনসিসি’র হয়ে ঢাকায় পুরনো এয়ারপোর্টে অনুষ্ঠিত ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। মুজিবুর রহমান স্যার আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পরবর্তীতে বোরহান স্যার দায়িত্ব নিয়েছেন। রমনা ৫ রেজিমেন্টের পতাকা আমি বহন করেছিলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গার্ড অব অনার দেয়ার সময়। খুব কাছে থেকে একজন প্রধানমন্ত্রীকে দেখার ও কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো সেদিন। এই বিএনসিসির হয়ে ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আমরা গোটা শহর চষে বেড়িয়েছি পুরনো কাপড়, শুকনো খাবার যোগাড় করতে। এর পর ঢাকায় পাঠানো হয়েছিলো তা চট্টগামে পৌঁছে দেয়ার জন্য। তখন ফাইনাল পরীক্ষায় অতিরিক্ত ১০ নম্বর দেয়া হতো বিএনসিসি’তে যুক্ত থাকার জন্য। এখন দেয়া হয় কি না জানি না। সপ্তাহে ২ দিন আমরা পিটি প্যারেড করতাম, আর স্কুল থেকে এর জন্য বিশেষ টিফিন দেয়া হতো। প্যারেড কমান্ডার ছিলাম তাই আমার শারীরিক কষ্ট কম হতো। তবে বন্ধুদের টিপ্পনি কম হজম করতে হয়নি; আমাদের বলতো মাইট্টা পুলিশ…
আর্তমানবতার সেবায় যুক্ত হই এই স্কুল থেকেই। যুব রেড ক্রিসেন্ট তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। মনে আছে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মৌলিক প্রশিক্ষণে প্রথম হয়ে স্কুলের দলনেতা নির্বাচিত হই। আমাদের স্কুলের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি রুম আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো। নিয়মিত প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে আমাদের মিটিং হতো। কাজী মাইনুদ্দিন স্যার ছিলেন আমাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। স্যারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় স্কুলে একটা সুন্দর বাগান গড়ে উঠেছিলো। একটা জলাধার ছিলো বাগানের মাঝখানে। সেখানে কিছু মাছ ছিলো। আমরা সাধ্যমতো কাজ করতাম বাগানের জন্য। স্যার ঘুরে ঘুরে বাগানের গ্রিলের জন্য স্পন্সর যোগাড় করেছেন। একটা গ্রিলে সেই সুবাদে আমার নামটাও লিখা ছিলো। মাছের খাবার দেয়ার উছিলায় স্কুলের গেটে বাবুলের দোকান থেকে মুড়ি এনে নিজেও খেতাম। কিছু মাছগুলোকেও দিতাম। কাজী স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। দুঃখ হয়, স্যারের বাগানটাও টিকে রইলো না বলে।
স্কাউটিং করেছি অল্প কিছু সময়ের জন্য। তৃতীয় তলায় ছিলো আমাদের স্কাউট রুম। সেখানে একটা অদ্ভুত স্মৃতি এখনো আমাকে ভীষণ রোমাঞ্চিত করে। আর সেটা হলো আমাদের অগ্রজদের দূরদর্শিতা আর স্কাউটিং স্পিরিট। আসাদ ভাই ছিলেন এক সময়ের স্কাউট লিডার। তিনি আশির দশকের শুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কাউটিং-এ যুক্ত যারা আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন আর সেই স্যুভেনিরগুলো থরে থরে সাজানো ছিলো। ছিলো প্রচুর স্ট্যাম্প (ডাকটিকেট) আর কয়েনের সংগ্রহ। এই থেকে নিজেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাকটিকেট ও মুদ্রা জমানো শুরু করেছিলাম। আসাদ ভাই ছিলেন আমার বন্ধু খোকনের বড়ভাই ও আমার বড় বোনের বন্ধু। বারী স্যার, পরে হাসান মাসুদ স্যার স্কাউটিং-এ যুক্ত হয়ে আমাদের নানাভাবেই উৎসাহ দিয়েছেন।
স্কুলের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মান আর গৌরবের স্মৃতি আমার ১৯৯৪ সালের টেলিভিশন স্কুল বিতর্ক প্রতযোগিতা। বিটিভি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চ্যানেল ছিলো না তখন। স্কুলের ইতিহাসে আমরাই একমাত্র দল যখন এই সুযোগ পেয়েছিলাম। মজার বিষয় হলো সেটা অনএয়ারে গিয়েছিলো আমার জন্মদিনে, তাই আনন্দ ছিলো অন্যরকম। তখন অনেকেই পেছন থেকে বলতো, এই যে, এই ছেলেটা টিভিতে বিতর্ক করেছিলো। শুনতে ভালোই লাগতো। সম্মানী বাবদ বিটিভি ৮০০ টাকার একটা চেক দিয়েছিলো। সেই সুবাদে আমার প্রথম ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছিলো সোনালী ব্যাংক, কিশোরগঞ্জ শাখায়। যুক্তি দিয়ে তর্ক করার এই মাধ্যমটি আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো। আমি এখনো যুক্তি দিয়েই বিবেচনা করি কি বলবো। ভুল বললে ক্ষমা চাইতেও শিখিয়েছে এই বিতর্ক। কাজী মাইনুদ্দিন স্যার, আবু খালেদ পাঠান স্যার, তনু স্যার, হাবিবুর রহমান স্যার, হাসান মাসুদ স্যার, সর্বোপরি প্রধান শিক্ষক শামসুল হক স্যার অনেক আদর ও ভালোবাসা দিয়ে আমাদের প্রস্তুত করিয়েছিলেন। আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কিশোরগঞ্জের এডভোকেটবৃন্দ পর্যন্ত। শাহ আজিজুল হক (বর্তমান পিপি), বাবু বিকাশ মজুমদার, লিয়াকত হোসাইন মানিক, নাসির উদ্দীন ফারুকী প্রমুখ আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটিং, উপস্থাপন ও উচ্চারণ নিয়ে ভীষণ সহযোগিতা করেছেন। আপনাদের ঋণ কখনো শোধ দেয়া যাবে না। স্যারদের কমনরুম ছিলো আমাদের মহড়া কক্ষ। মনিপুরী হাইস্কুলের সাথে মাত্র ২ পয়েন্টে (১৫৯/১৫৭) আমরা হেরে গিয়েছিলাম। তবে অনেক কিছু শিখেছিলাম।
সিক্সে যখন পড়ি, তখন সবচেয়ে ভয় পেতাম ইংরেজি ক্লাস। বাবু অমূল্য রতন স্যার হাঁটতেন আর নিজেই নিজের পায়ে-হাতে থাকা সন্ধি বেত দিয়ে আঘাত করতেন। প্যান্টের ওপর সন্ধি বেতের আঘাত গা ছমছম ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করতো। ট্রান্সলেশন ধরতেন, মুখস্ত করার পরেও ভয়ে ভুলে যেতাম। স্যারের পিটুনি! সে আর কি বলবো…
২২ বছরের পর এই কিছুদিন আগে স্কুলে গিয়েছিলাম, ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কত স্মৃতি মনে পড়ে। তার পরের দিন কালিবাড়ী-থানার রাস্তায় হাঁটছিলাম। দূরেই দেখি আসছেন অমূল্য রতন স্যার। মনের অজান্তেই চোখে থাকা সানগ্লাস খুলে ফেললাম। পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আশেপাশের লোকজন খুব অবাক হয়েছে মনে হয়। কাছে এলেন, কথা বললেন “তুমি” সম্বোধন করে। মনে করিয়ে দিলাম, স্যার আপনি তুই করেই বলেন, আগে যেমন বলতেন। স্যার বললেনঃ না না না। তোমরা এখন বড় হয়ে গেছো, তুই কিভাবে বলি? খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি পড়েছো? আর এখন কি করছো? আরো অনেক কথা বললেন, স্যারের সাথে যে কথাগুলো হলো এটা আমার জীবনের জন্য একটা অমূল্য শিক্ষা হয়েই থাকবে। শুধু একটাই আফসোস, আর বড় হতে চাই না। স্যার, আপনাদের কাছে “তুই” ডাকটাই শুনতে চাই…
লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী