ইব্রাহীম মল্লিক সুজন ।।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই হিসেবে রেকর্ড গড়েছে জাতির জনক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
প্রকাশের পর শুধু এর মূল প্রকাশনা সংস্থা থেকেই দুই লাখ ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে বইটি। এছাড়া, প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন পেপারব্যাকসহ যেসব সুলভ মুদ্রণ প্রকাশ করেছে সেগুলোও বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার।
খোঁজ করে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন বই বিক্রয়কেন্দ্র ও বইয়ের দোকানে এখনও বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ২০১২ সালের জুন মাসের ১৮ তারিখে দি ইউনিভার্সিটি পাবলিশার্স লিমিটেড (ইউপিএল) বইটি প্রথম প্রকাশ করে।
বইটি এরইমধ্যে ইংরেজি, জাপানি, আরবি, ফরাসি, হিন্দি ও চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এ বিষয়ে বইটির প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ২০১২ সালে প্রথম প্রকাশের পর এখন পর্যন্ত বইটির তিনটি সংস্করণের মোট দুই লাখ ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে, যা আমাদের প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে সব থেকে বেশি।
‘এই বিক্রি এখনও অব্যাহত আছে।’
বইটির পাঠকপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে উল্লেখ করে ইউপিএলের কর্ণধার বলেন: বইটির প্রকাশক হতে পেরে আমরা গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করি।
মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন: বইটি পাঠকের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছে। এমনকি যারা আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে সমালোচনা করে থাকেন, তারাও এই বই সম্পর্কে আবেগী ও ইতিবাচক মন্তব্য দিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, কেমন ছিলো তার জীবনবোধ ও জীবন-দর্শন তার সবকিছুরই তার প্রতিফলন ঘটেছে বইটিতে।
‘এই বই থেকে আমরা সত্যিকারের শেখ মুজিবুরর রহমান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাই।’
বাংলা একাডেমি থেকে নীলক্ষেত, বাংলা বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা এবং বইয়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র– সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকার এক নম্বরে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
নীলক্ষেতের মামুন বুক হাউজের সত্ত্বাধিকারী মো. মামুন বলেন: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রতিদিনই বিক্রি হয়। এজন্য অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি বইটি আমরা সব সময় রাখি। প্রায় সব বয়সের মানুষই বইটি কিনে থাকেন।
‘শুধু বিক্রি হওয়ার দিক থেকে নয়, ইতিহাসের সব থেকে বেশি পঠিত গ্রন্থও হবে এই বই,’ উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং বইটির সম্পাদক শামসুজ্জামান খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: চলতি মাসে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিরও প্রায় দুই লাখ কপি বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান এর প্রকাশক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।
আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন এবং দেশের জনসাধারণের অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এমনটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি এবং অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম।
তিনি বলেন: বঙ্গবন্ধুর বই সব থেকে বেশি বিক্রি হবে, এটি হওয়াই স্বাভাবিক। যে বাংলাদেশে আমরা বসবাস করছি, যে পরিচয়ে আমরা আজ গর্বিত, সেই পরিচয় ও দেশ বঙ্গবন্ধুর অবদানেই আমরা পেয়েছি। কাজেই তার বই সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রিত হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর দুটি বই দেশের সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রি হওয়া বই হতেই হবে।
অন্য প্রকাশকরাও বলেছেন, বাংলাদেশে কোন বইয়ের এতবেশি বিক্রি হওয়ার রেকর্ড আর নেই।
‘বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছি। আমরা অনেকে এমন অনেক বই প্রকাশ করেছি যার বিক্রি ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু, যে পরিমাণ মানুষ “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” কিনেছে তা অন্য যেকোন বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি,’ বলে মন্তব্য করেন শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান।
তবে, বিভিন্ন স্থানে এ বইয়ের পাইরেটেড কপি বিক্রি হচ্ছে এবং তা বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, কপি রাইট আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ চাইলে যে কেউ এ বইয়ের টেক্সট পরিবর্তিত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে পারে।
প্রিন্ট কপির পাশাপাশি বইটি অনলাইনেও বেশ সহজলভ্য। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখে গুগলে সার্চ করলে অসংখ্য পিডিএফ ফরম্যাটের বই ফ্রি ডাউনলোডের লিংক চলে আসে। এখান থেকে যে কেউ চাইলেই খুব সহজে ই-বই আকারে পড়ার সুযোগ পান।
জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দি হিসেবে কাটাতে হয়েছিলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে বার বার তাঁর জীবনে দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে এসছে। নিজে এসব স্মৃতিকথা লিখে গেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার ২৯ বছর পর কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা উদ্ধার করতে পারেন শেখ হাসিনা।
উদ্ধার হওয়া স্মৃতিকথায় ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত লেখা ডায়েরি পাওয়া যায় যা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ২০১২ সালের জুন মাসে এসব স্মৃতিকথা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। বইটির ভূমিকা লিখেছেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও কারাবন্দি অবস্থায় এই ভূমিকা লিখেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং এর ইংরেজি অনুবাদ ‘দি আনফিনিশড মেময়ারস’ প্রকাশ করে ইউপিএল। একইদিন ভারত ও পাকিস্তান থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় বইটি। ইউপিএলের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় ভারতে বইটি প্রকাশ করে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানে প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান।
এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজ জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
এ ছাড়া বইটিতে বঙ্গবন্ধুর জেলের ও বাইরের জীবন, পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও পরিবার-পরিজনের কথা বর্ণিত হয়েছে।
বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম। জাপানি ভাষায় এর অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে, চীনা ভাষায় চাই সি এবং আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী।
সূত্র : দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (চ্যানেল আই অনলাইন)