ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আধুনিক কবিতাচর্চা : পটভূমি ও প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

মহিবুর রহিম ।।

সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অন্যতম এক পীঠস্থান মেঘনা ও তিতাস নদী বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ‘সমতট’ নামক এই অববাহিকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাললিক উর্বরতা, জীবন সংগ্রামের ঐতিহ্য-বিভিন্ন কারণে জীবন বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। জীবন বিকাশের সঙ্গে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ঘটে প্রাচীনকাল থেকে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানকাল অবধি। ধারণা করা হয় বাংলার প্রাকৃত জনগোষ্ঠীগুলোর বসবাস ছিল নদ-নদী অধ্যুষিত এই ভাটি অঞ্চলে। প্রাকৃত বাংলার সুষম ভাষা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এ অঞ্চলের প্রাচীন লোকসাহিত্যে। প্রথম পর্যায়ে সমৃদ্ধ লোকমানসের হাত ধরেই বিকাশিত হয়েছে এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতি।

আধুনিক সাহিত্য এসেছে আধুনিক জীবনবোধের হাত ধরে। পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎকর্ষ জীবনবোধ থেকেই উদ্ভুত হয় আধুনিকতা। বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক সময়কালে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। সেই সাথে আসে রেনেঁসাস বা বঙ্গীয় আধুনিকতা। একথা অনস্বীকার্য আধুনিক জীবন চেতনার প্রভাবে এদেশের জীবন প্রণালীর উন্নয়ন ঘটে। আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার, নাগরিক জীবনের প্রসার, মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি সব মিলিয়ে বাঙালি জনসমাজের আবহমান ধারায় বিবর্তন ঘটে। এই বিবর্তনের হাত ধরেই আসে বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বের আধুনিকতা। মাইকেল মধুসূধন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৪) থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৩) পর্যন্ত এ সয়কাল বিস্তৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রথম পর্বের আধুনিকতার পূর্ণতার প্রতীক। দ্বিতীয় পর্বে আধুনিকতার সূচনা ঘটে বিংশ শতকের বিশের দশকে। ত্রিশের আধুনিক কবিরা এ ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের আবহমান জীবনবোধ থেকে আধুনিক জীবন চেতনার বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক সাহিত্য আধুনিক মানুষের জীবন সংগ্রামেরই প্রতিভূ। পুরো বিংশশতক ধরেই আধুনিক সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ঘটে।

ঔপনিবেশিক শাসনামলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ব্যাপক বিবর্তন ঘটে। গড়ে উঠে একটি নাগরিক পরিবেশ। শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসার ঘটে। আধুনিক জীবনবোধের অতিঘাত এসে লাগে জীবনের সর্বত্র। এভাবে কালক্রমে এখানে গড়ে ওঠে আধুনিক সাহিত্যচর্চার পরিবেশ। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দু’ধারায় এ চর্চা আজও অব্যাহত আছে। আধুনিক জীবন চেতনার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে মনীষী প্রথম সংহতি স্থাপন করেন তাঁর নাম আব্দুল লতিফ খান (১৮৯১-১৯৫৯)। তিনি ইংরেজি মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন এবং ইংরেজি ভাষায় বহুসংখ্যক মূল্যবান গ্রন্থ লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। এসময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন (১৮৯৭-১৯৮৬), কবি সুফী জুলফিকার হায়দার (১৮৯৯-১৯৮৭), মিজানুর রহমান (১৯০২- ), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) প্রমুখ কবি সাহিত্যিকদের আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে সুফী জুলফিকার হায়দার ও আবদুল কাদির প্রথম পর্বের আধুনিক ধারায় কাব্যচর্চা করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। এদের পরে সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১), মতিউল ইসলাম (১৯১৪-১৯৮৪), সানাউল হক (১৯২৪-১৯৯৩) প্রমুখ আধুনিক কবিতাচর্চায় সিদ্ধি অর্জন করেন। মতিউল ইসলাম ও সানাউল হকের মতো খ্যাতিমান কবিদের প্রভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাহিত্যের আধুনিকতা প্রসারিত হয়। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবিদের অবদান চির-স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের তিন পথিকৃৎ মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ (১৯১৭-১৯১৩), ফজল শাহাবুদ্দীন (১৯৩৬-২০১৪), আল মাহমুদ (১৯৩৬) বর্তমানকালে বাংলা ভাষার তিন শ্রেষ্ঠ কবি। এদের কল্যাণে ও অবদানে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সাহিত্যে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকেও এই কবিতা চর্চার ধারা নানা বাঁকে নানা শাখে বিকশিত হয়ে চলেছে। প্রতিটি দশকেই রয়েছে বিশেষ ধরনের অর্জন। এভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি ও লেখকগণ।

বর্তমানকালে ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রণোদনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির স্বাধীন নবযাত্রার এবং স্বাধীন মননচর্চারও উত্থান ঘটে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। ষাটের দশকে যে চেতনার বুনিয়াদি প্রস্তুতি, সত্তর দশকে সেই সৃজন সম্ভাবনার চাষাবাদ শুরু। সেদিক থেকে সত্তর দশক বাঙালির আপন ঘরে ফেরার ভাব প্রবণতায় উৎফুল্ল। স্বাধীন স্বকীয়তার আনন্দ বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর সৃষ্টির অফুরন্ত উদ্দীপনা সত্তর দশককে করেছে গতিময়। এ সময়ে বাংলাদেশ যেন তার হারানো পরিচয় ফিরে পায়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর কবিতাচর্চায় বাংলাদেশ নিজস্ব পরিচয়ের সন্ধানে মুখরিত হয়ে উঠে। আমরা দেখি এই ভাব প্রবণতা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিমুক্ত নয়। ষাটের দশকে এ অঞ্চলের যে তরুণ সমাজ জাতীয় চিন্তার পুনর্গঠন এবং স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিত ছিলেন সত্তর দশকে তাদের হাত ধরেই আসে আমাদের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক অর্জন। কবিতাচর্চার জন্য যে মনন চেতনা অর্জনের প্রয়োজন পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার সূচনা ঘটে ষাটের দশকেই। ষাটের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রগতিচর্চার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ, সাম্যবাদী মার্কসীয় চিন্তাধারা, বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয় ইত্যাদি প্রগতি অনুগামী ভাবধারায় তরুণ প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হয়। এ চর্চার কেন্দ্র উঠেছিল লালমোহন পাঠাগার। তিতাস সাহিত্য পরিষদ, প্রগতি সাহিত্য মজলিশসহ বিভিন্ন সংগঠন সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হয়। কিছু স্মরণিকা, লিটলম্যাগ ও স্থানীয় ছোট কাগজ ছিল এ সময়ের সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসগুলো উপলক্ষে এখানে নিয়মিত ভাবেই স্মরণিকা প্রকাশ হতে পারে। এর পাশাপাশি ‘ভেলা’, ‘ত্রিধারা’, ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘প্রবাহ’, ‘মুসাফির’, ‘সূর্যশপথ’, ‘সমাজ’, ‘পাড়ি’, ‘পরিচয়’ প্রভৃতি ছোটকাগজ সাহিত্য ও কবিতাচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠে। এ সকল সংকলনের সৃজনশীল প্রতিকশ্রুতি ছিল- যা সাহিত্যের ঘরোয়া পরিবেশ তৈরীতে সহায়তা করেছে। ষাট ও সত্তর দশকের অনেক খ্যাতিমান লেখকেরই লেখায় হাতেখড়ি ঘটে স্মরণিকায় লেখালেখি করে। যদিও প্রথাগত স্মরণিকাগুলোতে প্রতিশ্রুতি ও সৃষ্টিশীলতার প্রচণ্ড অভাব থেকে যায়। তবুও সত্তর দশকে প্রকাশিত অনেক স্মরণিকাকে আমরা গৌণ মনে করতে পারিনি। স্বাধীনপ্রিয় মুক্তিকামী জাতীয় চিন্তায় আন্দোলিত মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত আবেগী প্রকাশ এ সকল স্মরণিকাতেই ঘটে। সযত্ন পরিশীলন ও শিল্পচিন্তার অভাব রয়েছে বটে, তবু বাঁধাহীন আবেগের মধ্যে এক রকম সম্ভাবনার বীজ রোপিত ছিল যা পরবর্তীতে বিকশিত হয়ে উঠে।

সাহিত্য সর্বদাই অগ্রজের প্রভাবে অনুপ্রণিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণকারী খ্যাতিমান লেখকদের অনুপ্রেরণা স্থানীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাছাড়া ষাট ও সত্তর দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করেন আহমদ ছফা, আসাদ চৌধুরী, মিন্নাত আলী, হরলাল রায় ও শান্তনু কায়সারের মতো লেখকরা। এদের সক্রিয় তৎপরতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানীয় সাহিত্যচর্চা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ছিল। সত্তর দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় কবিরা হলেন- মতিউল ইসলাম, জমিলা বেগম, মুহম্মদ মুসা, চন্ডীপদ চক্রবর্তী, খুরশেদুল ইসলাম, আবিদুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুক, একে এম হারুনুর রশীদ, মাশুক চৌধুরী, সুধীর দাস, তিতাশ চৌধুরী, মুহম্মদ সিরাজ, ফজল মাহমুদ, আসহাবুল ফাতেহ, মাহবুব উল-করিম, সাজ্জাদ হোসাইন খান, শিহাব সরকার, খান মোহাম্মদ ফারাবী, রবীন্দ্র গোপ, সিরাজুল করীম, ওয়াহিদ রহমান, আতিকুল ইসলাম খোকন, বাবুল চৌধুরী, জীবন বর্মণ, আশরাফ আজিজ, মজিবুর রহমান স্বপন প্রমুখ। তাদের সকলেরই প্রায় উত্থান ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। এ সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি স্থানীয় ঘরানায় সাহিত্যচর্চা গঠনমূলক স্বাতন্ত্র নিয়ে স্থায়ী ভিত্তি অর্জন করতে শুরু করে। এদের অনেকের মধ্যেই সৃষ্টিশীল সম্ভাবনার বিকাশ ঘটে সত্তর দশক থেকে। যে সৃষ্টিশীলতার বীজ রোপিত হয়েছিল ষাটের দশকে, সত্তর দশকে তার উন্মেষ ঘটে। কিন্তু ফুলে ফলে বিকশিত হতে শুরু করে আশি দশকে এসে। বিশেষত আমরা প্রকাশনার দিক থেকে বিচার করে দেখেছি স্মরণিকা থেকে লিটলম্যাগে উত্তরণ এবং নিজস্ব গ্রন্থ প্রকাশ আশির দশকে এসে এগুলো প্রায় নিয়মিত ঘটতে থাকে। একেএম হারুনুর রশীদের ‘সাগরে ঠিকানা, শিশিরে শয্যা’; ‘আমাকে ক্ষমা করো’ ‘পালাবদলের পালা’; জয়দুল হোসেনের ‘স্বরবৃত্তে স্বরাঘাত’; আসহাবুল ফাতেহর ‘আমি যেন কী হরিণীর চোখে’; ওয়াহিদ রহমানের ‘কোথায় রাখি এই প্রেম’; সিরাজুল করীমের ‘সুরায়নে শব্দাবলী’ ইত্যাদি গ্রন্থ আশির দশকে প্রকাশিত হয়। নিজস্ব গ্রন্থ প্রকাশ না হলেও সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুক, আতিকুল ইসলাম খোকন, বাবুল চৌধুরী, জীবন বর্মণ, বেলী চৌধুরী, আব্দুল আজাদ, মোহাম্মদ হোসেন, মিলি চৌধুরী প্রমুখ কবিরা সৃষ্টিশীল কাব্যচর্চার খ্যাতি অর্জন করেছেন। সত্তর ও আশির দশকে বেশ কিছু সাহিত্য সংগঠন সাহিত্য ও কবিতাচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। সত্তর ও আশির দশকে বেশ কিছু সাহিত্য সংগঠন সাহিত্য ও কবিতাচর্চায় উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা রাখে। প্রান্তিক সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, উত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, সাহিত্য একাডেমী, প্রবাহ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ সরব কর্মকাণ্ডে সাহিত্য অঙ্গনকে মুখরিত করে রাখে। সাহিত্য একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘সাহিত্য একাডেমী পত্রিকা’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪) আশির দশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া চমন মোহাম্মদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘উত্তর প্রবাহ’ (১৯৮০), সরকার আমিনুল ইসলামের ‘বিপ্লব ও বৃষ্টির কবিতা’ (১৯৮৩), মনজরুল আলম সম্পাদিত ‘নবান্ন’ (১৯৮৫), নিয়াজ মোহাম্মদ খান সম্পাদিত ‘সকাল’ (১৯৮৮), শোয়েব চৌধুরী সম্পাদিত ‘রেনেসাঁ’ (১৯৮৮) এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ লিটলম্যাগ। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রেরণায় এবং লিটলম্যাগে আত্মপ্রকাশে কবিতার আবাদ উর্বরতা লাভ করে। বিশেষ করে আধুনিক কবিতাচর্চা যে পরিবেশের দাবি রাখে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় তা উদ্ভাসিত হতে থাকে। এ সময় প্রকাশিত সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া বেশ সুস্পষ্ট। কবি সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুক, আসহাবুল ফাতেহ, সুধীর দাস, মাহবুব উল-করিম, ওয়াহিদ রহমান, মারুফুল ইসলাম, কাজী ঝুনু, মিলি চৌধুরী, সরকার আমিন, হাসি সরকার প্রমুখের কবিতায় শিল্প ও নান্দনিকতার প্রভাব আমাদের আনন্দিত করে। আশির দশকের শক্তিমান কবি মারুফুল ইসলাম। পাঁচটি প্রকাশিত কাব্যে তাঁর নিজস্বতা যেমন সুস্পষ্ট তেমনি নিজস্ব এক কবিতাদর্শ রয়েছে তাঁর। আশির দশকে বাংলা কবিতার ভাববলয় যেমন প্রসারিত হয়, গদ্যছন্দের আলাদা আশ্বাদ, বিষয়ের বৈচিত্র্য কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। আশির দশকে আমরা আবার ভিন্নমাত্রার সংগ্রামী ঐতিহ্যের মুখোমুখি হই। স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন, গণতান্ত্রিক জাগরণ, নিজস্ব ঐতিহ্যের অনুসন্ধান, চিরায়ত জীবন জিজ্ঞাসা, মানবিক সম্পর্কের সংবেদন, নতুন বৈশ্বিক চেতনা ও টানাপোড়েন কবিতা চর্চার নতুন গতির সংযোগ ঘটায়। নব্বই দশক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয়ের দশক। অন্যভাবে বলা যায় পাললিক, সম্ভাবনাময়, বহুমুখী অন্তঃপ্লাবী সময়ের দশক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আধুনিক কবিতা চর্চার ফলপ্রসু আবাদে মুখর আশির দশক। প্রবীণ-নবীন কবিদের সফলতার তরী এ সময়ে ঘাটে এসে ভীড়ে। নব্বই এবং শূণ্য দশকে প্রচুর প্রকাশনা আমাদের হাতে এসেছে। প্রচুর লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে এ সময়ে। গুণগতমানের দিক থেকে এসব লিটলম্যাগ উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে। এসব লিটলম্যাগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রত্না দে সম্পাদিত ‘স্বপ্তস্বর’ (১৯৯৩), সেলিম পারভেজ সম্পাদিত ‘প্রত্যাশা’ (১৯৯৪), সোহেল রশীদ সম্পাদিত ‘মান্দাস’ (১৯৯৫), আমিনুল ইসলাম সম্পাদিত ‘কালান্তর’ (১৯৯৫), ওয়াহিদ রহমান সম্পাদিত ‘আনন্দপ্রবাহ’ (২০০০), মহিবুর রহিম সম্পাদিত ‘প্রতিভাস’ (২০০১), মোহাম্মদ আশরাফ সম্পাদিত ‘সাহিত্যলোক’ (২০০২), কাজী বর্ণাঢ্য সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ (২০০৪)। নব্বই দশক থেকে শূন্য দশক পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবিদের তালিকা নিম্নরূপ : সৈয়দ মোহাম্মদ মাশুক, এ কে এম হারুনূর রশীদ, মোহাম্মদ সিরাজ, শামসুল ইসলাম, রাফিজ উদ্দিন আহমদ, সুধীর দাস, মোহাম্মদ আশরাফ, তালুকদার কাসেম, আশরাফ আজিজ, মিলি চৌধুরী, মজিবুল বারী, নিজাম ইসলাম, রত্না দে, হাসি সরকার, লক্ষী রাণী বণিক, হাফিজুর রহমান হিরু, সরকার আমিন, মাহবুব আলম পিয়াল, খলিল মজিদ, মহিবুর রহিম, মোহন্ত কাবেরী, অর্ধেন্দু শর্মা, শৌমিক ছাত্তার, রাশিদউল্লাহ তুষার, আমজাত সুজন, সেলিম পারভেজ, তানজিম ইসলাম, রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস, সৈম আকবর, আমির হোসেন, মনির হোসেন, এহসানুল ইয়াছিন, রোকেয়া দস্তগীর, রবিউল আলম নবী, কাজী বর্ণাঢ্য, জাহাঙ্গীর আরম, সোহেল শহীদুল্লাহ, নাগর হান্নান, রাকিবুল ইসলাম শুভ,সাইফুল ইসলাম রিপন, স্বপন মিয়া প্রমুখ। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লেখকদের প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকার একাংশ নিচে দেয়া হল : ওয়াহিদ রহমানের ‘ কোথায় রাখি এই প্রেম’, ‘তোমার প্রতীক্ষায় দুলদুল’; মারুফুল ইসলামের ‘শূন্য পুরান’, ‘অনন্তের অলীক অপেক্ষা’, ‘জল পাথুরে’; আসহাবুল ফাতেহুর ‘স্বগত স্বরগম’; রত্না দে’র ‘ক্ষয়িষ্ণু প্রতীক্ষা’; কাজী মোতাহার হোসেন অনিকের ‘হৃদয়ে সহবাস’; লক্ষীরাণী বণিকের ‘মরুতৃষ্ণা’; মিলি চৌধুরীর ‘অন্য বলয়ে আমি’; মোহাম্মদ আশরাফের ‘প্রাকৃত জনের গান’; খুরশেদুল ইসলামের ‘সেতারা হেলাল নামে ডেকেছি তোমাকে’; মোহন্ত কাবেরীর ‘উৎস নগরে উৎসব’; মহিবুর রহিমের ‘অতিরিক্ত চোখ’; জয়দুল হোসেনের ‘সময় অসময় দুঃসময়’; সুধীর দাসের ‘রোদ বাদলের অনুবাদ’; মহিবুর রহিমের ‘হে অন্ধ তামস’; জয়দুল হোসেনের ‘দীর্ঘকবিতা’ খুরশেদুল ইসলামের ‘সায়াহ্নের সুর স্মৃতির সুরভী’ প্রভৃতি।

বক্ষমান প্রবন্ধটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আধুনিক কবিতাচর্চার বিষয়ে একটি সাধারণ আলোকপাত মাত্র। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে সম্পর্ক ও যোগাযোগকে এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবিদের আধুনিক কাব্যজগতে অধিষ্ঠান আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে আছে। এখনও কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন প্রমুখ বাংলা কবিতাকে পুরোপুরি শাসন করেছেন। বিশেষ করে আল মাহমুদ বর্তমানকালের বাংলা ভাষার এমন এক বিরলপ্রজ কবি, যার দ্বিতীয় কোন তুলনা নেই। বাংলা কবিতার প্রধানতম কবির আসনটি এখন তাঁর অধিকারে। বিশাল তাঁর কাব্যজগত, অপ্রতিরোধ্য তাঁর প্রভাব, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায় এক বিস্ময় তিনি। শুধু তাই নয়- তাঁর কবিতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জনপদ আশ্চর্য মহিমা নিয়ে প্রকাশিত। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণ যথার্থই বলেন- ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা ভাবলে প্রথমেই আমি আল মাহমুদের কথা ভাবি, আল মাহমুদের কথা ভাবলে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা মনে পড়ে’। তাই যথার্থভাবেই বলা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আধুনিক কবিতাচর্চার পর্যালোচনা ব্যাপক পরিধির মধ্যে বিস্তৃত। বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের স্থানীয় সাহিত্যের বিস্তৃতি এতটা প্রসারিত নয় সম্ভবত।*

*(লেখাটি ২০০৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি সাহিত্য সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক এ কে এম হারুনূর রশীদ)

মহিবুর রহিম : কবি, প্রাবন্ধিক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক। সিনিয়র প্রভাষক, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Similar Posts

error: Content is protected !!