হাওরবাসীর নিরাপত্তায় টেকসই বাঁধ (ভিডিওসহ)

অনুপম মাহমুদ ।।

হাওর এর সাথে আমার জন্ম ও নাড়ির বন্ধন। তাই হাওর এর হাসি কান্না, আনন্দ বিষাদ আমাকে স্পর্শ করে। ছোটবেলা থেকেই যুক্ত আছি সামাজিক নানা উদ্যোগের সাথে। আপনারা জানেন হাওর এলাকা এখন বিপর্যস্ত। বানভাসি মানুষের আর্তনাদে হাওরের আকাশ বাতাস শোকে মুহ্যমান। ঠিক এমনই একটি সময়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো সময় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, ২৫ এপ্রিল ২০১৭ রাত দশটায় বিরতিহীন টকশো ‘সম্পাদিকীয়” তে। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাননীয় মহা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ জাহাঙ্গীর কবির ও প্রথম আলোর সহ সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক জনাব মশিউল আলম আর হাওর কৃষক ও মৎস্য শ্রমিক জোটের কারিগরি সমন্বয়কারী হিসেবে আমি। সিলেট থেকে যুক্ত ছিলেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি জনাব কাশ্মীর রেজা। পুরো অনুষ্টানটি সঞ্চালনা করেছেন সময় টিভির বার্তা প্রধান জনাব মুজতবা দানিশ।

পুরো অনুষ্ঠানটির ভিডিও দেখার জন্য ছবির ওপর ক্লিক করুন

বছরের পর বছর চলছে এই চিত্র, অথচ কাজের সময় নানা ছুতো। অথচ সরকারি ওয়েব পোর্টালে শোভা পাচ্ছে তাদের নানা কাজের ফিরিস্থি। যেমন বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এর ওয়েবসাইট এর তথ্য অনু্যায়ীঃ

১। হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যাবস্থাপনা ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন প্রকল্প(কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার ২৯ টি হাওরে বন্যা ব্যবস্থাপনা ও কৃষিসহ বিভিন্ন ভাবে আয়বৃদ্ধি কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য) বাস্তবায়নকাল : ২০১৪-২০২২ প্রাক্কলিত ব্যয়: ৯৯৩৩৭.৭২ লক্ষ টাকা, অর্জন ৫.৫০%।

২। হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প (৫২ টি হাওরে আগাম বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করার ফলে ২,৮৯,৯১১ হে. জমির বোরো ফসল আগাম বন্যার কবল হতে রক্ষা পাবে।) বাস্তবায়নে : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড । প্রকল্পের মেয়াদ আরও ০২ বৎসর সময় বৃদ্ধির জন্য একনেক সভায় উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। বাস্তবায়নকাল : ২০১১-২০১৬ । প্রাক্কলিত ব্যয়: ৭০৪০৭.৩৬ লক্ষ টাকা, অর্জন ১৭.৯০%।

৩. সিলেট বিভাগ ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প । বাস্তবায়নে : বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন। সেচ কাজের জন্য খাল খনন, পাম্প স্থাপন, বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি কাজ করা হচ্ছে। ১৪৩৭৫ হে. জমি সেচের আওতায় আসবে। প্রাক্কলিত ব্যয়: ১৩৮০৫.৯০ লক্ষ টাকা । বাস্তবায়নকাল : ২০১৪-২০১৯, অর্জন ৩৩%।

৪. কিশোরগঞ্জ হাওর ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন কর্মসূচী। বাস্তবায়নে : বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন । সেচ কাজের জন্য খাল খনন, পাম্প স্থাপন, বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি কাজ করা হয়েছে। প্রকল্প ব্যয়: ৪৫৩.৯৫ লক্ষ টাকা । বাস্তবায়নকাল : ২০১২-২০১৫, সমাপ্ত (১০০%) ।

৫. উজানচর-বাজিতপুর-অষ্টগ্রাম সড়ক উন্নয়ন (বাজিতপুর-অষ্টগ্রাম অংশ) প্রকল্প। বাস্তবায়নে : সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর । এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে অষ্টগ্রাম উপজেলার সাথে কিশোরগঞ্জ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে, প্রাক্কলিত ব্যয়: ১৩৪২১.৮৫ লক্ষ টাকা , বাস্তবায়নকাল : ২০১১-২০১৬ , অর্জন ৮১.০০%।

উল্লেখিত প্রকল্প সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ২ নম্বর প্রকল্পটি। দুঃখের বিষয়, ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও যথাসময়ে অর্জন টেনেটুনে ১৭.৯০%! আর এটা বাস্তবায়নের জন্য আরো দুই বছর সময় চাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তারমানে বাজেটও বাড়বে, এতে লাভ হবে কার? বলাই বাহুল্য। এই প্রকল্পেই প্রমান হয় আমাদের হাওর এলাকার ২,৮৯,৯১১ হেক্টর জমির বোরো ফসল আগাম বন্যার ঝুঁকিতেই ছিলো। এটা জানার পরেও কেন নির্ধারিত সময়ে তা বাস্তবায়ন হয়নি? কে বা কারা এর জন্য দায়ী, হাওরের সন্তান হিসেবে, ২ কোটি হাওর বাসীর পক্ষে এটা আমার জানার অধিকার আছে নিশ্চয়ই…

খবরে প্রকাশ হাওর এর এই দুর্দিনে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর এর পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তা বিদেশ সফরে আছেন। তাহলে এই শ্বেতহস্তী লইয়া আমরা হাওরবাসী কি করিব? দুর্দিনেই পাশে পাই না, সুদিনে তো শুধু সেলফি তুলে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেবেন…

আমি সুনামগঞ্জের জনসাধারণকে হৃদয় থেকে স্যালুট জানাই, তারা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, বর্জন করেছেন নববর্ষের সমস্ত আনিষ্ঠানিকতা। সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে ভাবিয়ে তুলছিলো, কারন এর প্রভাব আমার জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের হাওরেও পড়বে, আর হয়েছেও তাই। একের পর এক বাঁধ ভেঙ্গে কৃষক আজ সর্বস্বান্ত। হাওরের জমির মালিকেরা এখন আর চাষাবাদ করেন না, কারন পোষায় না, শুকনো মৌসুমেই জমি পত্তন দিয়ে নগদ পয়সা গুণে নেন। আর প্রান্তিক কৃষক উপায়ান্ত না দেখে ধার কর্য, এনজিওর চড়া সুদ ও দাদন নিয়ে সেই টাকার যোগান দেন। ধানের চারা কেনা থেকে শুরু করে, ক্ষেতে পানি দেয়া, কীটনাশক, আগাছা বাছাই, নিড়ানি শেষে যখন সোনার ফলনের ঝিলিক দেখতে পেয়ে আশায় বুক বাঁধে আমাদের কৃষক, তখনি আসে বিপর্যয়। এই চিত্র নতুন নয়, কিন্তু কেন? আমাদের হাওরবাসীর প্রতি কি রাষ্টের কোনই দায় নেই?

বলা হয় আমদের হাওর এলাকার বোরো ধান যোগান দেয় গোটা বাংলাদেশের এক মাসের চাহিদার সমপরিমান। তার পরেও বলা হচ্ছে এতে দেশে খাদ্যের কোন সংকট দেখা দেবে না। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র, এখনই কেজিতে বেড়ে গেছে ৫/৬ টাকা। সমনে কি হবে বলা মুশকিল। তবে দাদনের ফাঁদে জিম্মি কৃষক যে স্থানান্তরিত তথা বাস্তুচ্যুত হবে এটা নিশ্চিত। আমাদের হাওর এর সহজ সরল মানুষগুলো আজ ঢাকার নাখালপাড়ায়, কামরাঙ্গির চর, নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জ, সিলেটের বস্তি, চিটাগাং এর হালিশহর, পতেঙ্গা, বন্দর এলাকায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যাদের অধিকাংশই ছিলো একসময়কার অবস্থাসম্পন্ন কৃষক পরিবারের সন্তান। শহুরে জীবনে অনভ্যস্ত্য এই জনগোষ্টীর জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তাদের এই পরিস্থির জন্য দায়ী এই বাঁধ ও সরকারের সীমাহীন উদাসীনতা।

কৃষি ও মৎস্য ছাড়া এই হাওর বাসীর জীবিকার তৃতীয় কোন সুযোগ নাই, এই বছর প্রকৃতির অপার দান মৎস্য পর্যন্ত হারিয়েছে হাওরবাসী। এর আড়লে রয়ে যাচ্ছে আরেকটা পুরুর চুরি! জলমহালের ইজারা প্রথায় হারিয়ে গেছে জাল যার জলা তার নীতি। ক্ষমতাশালীদের হাতে জিম্মি আজ হাওরের জলমহালগুলো। প্রকৃত জেলেদের নাম ভাঙ্গিয়ে ইজারা নিয়ে সেখানে ত্রাসের রাজত্ব্য কায়েম করে রেখেছে কতিপয় দুর্বৃত্ত। তাই ইচ্ছা থাকলেও আমাদের হাওর এর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য মৎস্য আহরন থেকেও।

উজানের ঢল যদি না ঠেকাতে পারি তবে আমাদের হাওর বাসীর ক্ষয় ক্ষতির পরিমান তো কমাতে পারি, তাই না? আমাদের হাওর এলাকার মানুষ শিক্ষায় পিছিয়ে, পুষ্টিতে দুর্বল, সুচিকিৎসার সেবা থেকে বঞ্চিত। এই এলাকায় ভালো কোন ডান্তার যান না আবার গেলে থাকেন না। মান সম্মত শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না, শিক্ষার জন্য যেতে হয় নিদেন পক্ষ্যে মফঃস্বল শহরে। এতো অর্থ তো আমাদের হাওরবাসীর নেই। তাই বলে কি যুগের পর যুগ আমরা অন্ধকারের তিমিরেই নিমজ্জিত থাকবো?
ছাপ্পান্নো হাজার বর্গ মাইলের আট ভাগের একভাগ এলাকা নিয়ে হাওর, সাত টি জেলা, ৩৪ টি থানা, ৪১৭ টি হাওর আর ২ কোটি জনগণ। এই বিপুল জনগোষ্ঠী ও বৃহৎ অঞ্চলকে রাষ্ট্রের মূলধারায় ধরে না রাখতে পারলে সামজিক বিপর্যয় আসন্ন। আর এতে বাধাগ্রস্থ হবে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। উন্নয়ন বঞ্চিত হাওর বাসী আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব। আমাদের প্রতি সুবিচার করুন…

লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

Similar Posts

error: Content is protected !!