‘প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন আমরা কষ্টে আছি’

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

‘বাবা আমরা নিঃস্ব অয়া গেছি। ঘরে খাওন নাই। নাতি-নাতকররা কান্তাছে। এদের ফেডঅ (পেটে) দুই দিন ধইরা কিছুই দিতাম ফারতাছি না। এহন একটাই চিন্তা কী কইরা বাঁচাম, আর এরারেই (সন্তানদের) কী কইরা বাঁচায়াম।’ হাওর থেকে আনা পচে যাওয়া কাদা মিশ্রিত কিছু ধান কুলায় করে ঝাড়তে ঝাড়তে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন। দুই একর জমি ছিল তার স্বামীর। বানের জলে সব তলিয়ে গেছে। পচা ধান ঝেড়ে খাাবার উপযোগি খুদ-কুড়া কিছু পাওয়া যায় কিনা সে চেষ্টাই করছিলেন রহিমা।

এ রকম অবস্থা শুধু যে রহিমা খাতুনেরই তা নয়, ফসল হারিয়ে এমন নিঃস্ব অবস্থা, এ রকম কষ্ট কিশোরগঞ্জের হাওরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই।

শনিবার ২৯ এপ্রিল নিকলীর সিংপুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে গেলে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় রহিমা খাতুনের। গত ২৫ দিন আগে এলাকার কয়েকটি বাঁধ ভেঙে কাশিপুরের সামনের হাওর ডুবে যায়। এতে এ গ্রামের অন্তত সাড়ে চার শ কৃষকের দুই হাজার একর ফসলি জমির ধান তলিয়ে যায়। তারা হাওরের উঁচু জায়গা থেকে কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। পরে এগুলোও আর বৃষ্টির কারণে শুকাতে পারেননি। ধান ডোবানোর পর থেকে কাশিপুরের মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অভাবগ্রস্ত এ গ্রামে সোমবার পর্যন্ত পৌছেনি সরকারি বা বেসরকারি কোনো ত্রাণ।

গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল কৃষক হিসেবে পরিচিত মো: ফরিদ মিয়া। সোয়া ছয় একর জমিতে তিনি এবার বোরো ধান করেছিলেন। এক ছটাক ধানও কাটতে পারেননি। দুই ছেলে, তিন মেয়ে নিয়ে তার ৭ জনের সংসারে এখন টানাপোড়েন।

ফরিদ মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন আমার ঘরে ৫ কেজি কইরা চাউল লাগে। গত এক সপ্তাহ ধইরা দুই কেজি কইরা চাউলে দিন পার করতাছি। কী আর করাম, ঘরে চাউল কিনার টেহা (টাকা) নাই, তাই আমরা কম কম খাইতাছি, তবে পোলাপানরে তো আর কম খাওয়ায়া রাহন যায় না, ভাত কম দিলে ওরা কান্দে, সরকারের ত্রাণ পাইলে জীবনডা কিছু আসান পাইতো।’

ফরিদ মিয়ার সাথে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়ানো ছিল তার বড় মেয়ে মবিনুর। নিষ্পাপ মায়ারি চেহারা। জানা গেল, দুই বছর ধরে মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা রোগে ভোগছে সে। গত অগ্রাহায়ণ মাসে মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। ফরিদ মিয়ার কথা শেষ হলে সে একটু গোছানো কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো, ‘আমার চিকিৎসা করাইতে গিয়ে আব্বার এক লাখ টাকা ঋণ হইছে। আমরা ৫ ভাই-বোনের সবাই পড়ালেখা করতেছি। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছি। প্রতিদিন আমার ওষুধ খাওন লাগে। এক সপ্তাহ ধইরা আমার ওষুধ নাই। ওষুধ না খাইলে পিঠের ব্যথা বাড়ে। ধান ডুবায়া নেওয়ায় আব্বার হাতে টাকা নাই। প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন আমরা খুব কষ্টে আছি।’

গ্রামের বিধবা কিষাণি আলমনিশা (৫০) গার্মেন্টসকর্মী মেয়ের টাকায় ২৫ শতাংশ জমি করেছিলন। ২৫ দিন আগে তার পুরো জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এক সপ্তাহ আগে তার ঘরের চাল শেষ হয়েছে। ছোট দুই নাতিকে নিয়ে তিনি এখন চরম বিপদে। আলমনিশা বলেন, ‘নির্বাচন আইলে কত নেতা আত-ফাও ধইরা ভোট নিতো আইয়ে, অহন এতো বিফদের সময় কেউ তো আইয়ে না।’

কথা হয় গ্রামের কৃষক মো: এলু মিয়ার (৪৫) সঙ্গে। এলাকার ফালিয়াবিল হাওরে দেড় একর জমি ছিল তাঁর। এ হাওরের পুরো জমির ধান মধ্য এপ্রিলের দিকে তলিয়ে যায়। এলু মিয়া জানান, ফলন দেখে ধারণা করেছিলেন এবার তার জমিতে ১৫০ মনের মতো ধান হবে। সবেমাত্র পাকতে শুরু করেছিল ধান। এর মধ্যেই সব শেষ। এলু মিয়া বলেন ‘ধান হারায়া আমরা এহন পথের ফহির। এই যে এতো বড় দুর্যোগ অইলো, এহন পর্যন্ত কেউই আমরার জন্য তেরান (ত্রাণ) নিয়া আইছে না (আসেনি)। সামনের দিনগুলোতে কিভাবে চলবো, আর খাবই বা কী। এই চিন্তাতেই আছি।’

গ্রামের উমর সিদ্দিক বাড়ির সামনের হাওর থেকে ধানের পচা ‘নাড়া’ সংগ্রহ করছিলেন। কথা হয় তার সাথে। জানালেন, তিনি এবার দেড় একর জমি করেছিলেন। ধানে সবেমাত্র থোর হয়েছিল। এর মধ্যেই বাঁধ ভেঙ্গে সব জমি তলিয়ে যায়। জমি থেকে এক ছটাক ধানও আনতে পারেননি। বললেন, ‘ঘরে চাউল আছিন না সিংপুর বাজার থো বাকিতে ২০ কেজি চাউল আনছি। দুইডা গরু উবাস (অভুক্ত), গরুর লাগি নেড়া কাটতাছি। হুনছি সরকার অনেক কিছু দিতাছে। কই, আমরা তো কিছুই পাইলাম না।’

তিন দিন ধরে আলু খেয়ে বেঁচে আছেন মুলেকা বানু

কাশিপুরে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন মুলেকা বানু (৪৫)। বৈশাখ মাস এলে অন্যের ঘরে ধান মাড়াই-ঝাড়াইয়ের কাজ করেন। স্বামী ধান কাটেন। বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ায় এবার কোনো কাজ করতে পারেননি তারা। ২০ দিন ধরে তার ঘরে কোনো খাবার নেই। মুলেকা বললেন, ‘কিমুন কষ্টে আছি ভাই দেইখ্যা যান। ৫ সন্তান নিয়া এক সপ্তা ধইরা আলু খায়া বাঁইছ্ছা আছি। পেডের খিদা আর সহ্য হচ্ছে না ’ বলে ঘর থেকে কয়েকটি আলু এনে দেখালেন। ছবি তুলতে গেলেই তিনি আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

জানা গেছে, ২৯ বছর আগে এই কাশিপুর গ্রামটি হাওরের ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যায়। গ্রামের ৫০০ পরিবার পার্শ্ববর্তী করিমগঞ্জ উপজেলার ইন্দাচুল্লী, ধীরুয়াইল, নয়াহাটিসহ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে ইন্দাচুল্লি গ্রামের একটি পাড়ায় পাশাপাশি বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তারা। গ্রামবাসীর ফসলি জমি কাশিপুরে থেকে যাওয়ায় প্রতি বছর ইন্দাচুল্লি গ্রাম থেকে অস্থায়ী বাড়িঘর নিয়ে এসে তারা জমিজমা করেন। অগ্রহায়ণ মাসে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে বসত গাড়েন। জ্যৈষ্ঠ মাসে অস্থায়ী ঘরবাড়ি ও চাষকৃত জমির ফসল নৌকায় করে নিয়ে ফিরে যান আবার সেই ইন্দাচুল্লী গ্রামে। এবার ফসল তলিয়ে যাওয়ায় খালি হাতে তাদের ফিরতে হচ্ছে।

কাশিপুর থেকে সন্ধ্যায় ফেরার পথে এ এলাকার আরো অন্তত ২০ জন নারী পুরুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানালেন, কাশিপুর গ্রামের ধনী-গরিব সব কৃষকের অবস্থা এখন এক। সবাই ফসল হারিয়ে অসহায়। কারও ঘরে খাবার নেই। অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে।

সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আনোয়ারুল হক বলেন, ‘কাশিপুর গ্রামের মানুষ এখন করিমগঞ্জের গুনধর ইউনিয়নের ভোটার। ৮৮’র বন্যার পর থেকে এ গ্রামের মানুষজন মূলত যাযাবরের জীবনযাপন করছে। এ বছর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মীরখালি নদীটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে খনন হচ্ছে। এই সুযোগে খননকৃত নদীর মাটি দিয়ে নিজের উদ্যোগে আমি গ্রামটিকে নতুন করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি। ফসল হারিয়ে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এখন না খেয়ে আছে। আমার ইউনিয়নের বরাদ্দ থেকে সোমবার গ্রামে গিয়ে ৩০টি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছি। আমার ইউনিয়নে ৪ হাজার পরিবার ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সারা ইউনিয়নের জন্য মাত্র ৭০০ ক্ষতিগ্রস্তের নাম নিয়েছে। কাশিপুর গ্রামের মানুষগুলোকে বাঁচাতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।’

গুনধর ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য (ইন্দাচুল্লি গ্রামের বাসিন্দা) মো: কাঞ্চন মিয়া বলেন, ‘৩০ বছর আগে নিজেদের পৈত্রিক ভিটা হারিয়েছে কাশিপুরের মানুষ। এবার ফসল হারিয়ে নিঃস্ব। ইন্দা, চুল্লি ও কণ্ডবখালি গ্রাম নিয়ে আমার ওয়ার্ড। আমার ওয়ার্ডে ১৫ শ’র বেশি কৃষক ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কাশিপুরের ৫০০ কৃষকও আমার গ্রামের ভোটার। উপজেলা প্রশাসনের কাছে আমার ওয়ার্ডের মাত্র ৩১১জন কৃষকের নাম দিয়েছি। শুনেছি এ তালিকাও কাটছাট করা হচ্ছে। কবে ত্রাণ দেয়া হবে জানানো হয় নাই। মানুষ এখন অভাবে আছে। বিশেষ করে কাশিপুরের মানুষ খুব অসহায় অবস্থায় আছে। খুব জরুরিভিত্তিতে এ গ্রামে ত্রাণ দেয়া দরকার।’

Similar Posts

error: Content is protected !!