মাহমুদুল হাসান রাজু ।।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ, সমস্ত পাঠ্যবই ই-বুকের মধ্যে রূপান্তর এবং অনলাইনে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ- এর সবগুলোই সরকারের ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২০ মে সারাদেশের ১ হাজার স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ উদ্বোধন করার পর থেকেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার এই উদ্যোগটি ব্যাপক বিস্তৃত হচ্ছে।
অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)-র ই-লার্নিং বিশেষজ্ঞ ফারুক আহমেদ জানান, বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রয়েছে, যেখানে প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার প্রশিক্ষিত শিক্ষক ১০ মিলিয়নেরও বেশি শিক্ষার্থীকে উচ্চমানের পাঠদান করছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য শিক্ষণ এবং শেখার পদ্ধতিকে ইন্টারেক্টিভ এবং উপভোগ্য করতে এই কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এটি শিক্ষা ক্ষেত্রে তিন স্তরে বাস্তবায়ন করা হয়- মাধ্যমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপন, ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরির জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও মাদ্রাসাসহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের ইলেকট্রনিক সংস্করণ তৈরি।
এছাড়াও এটুআই ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ ব্যবহার করে প্রজেক্টরের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করেছে যা একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার ল্যাব তৈরির তুলনায় অনেক সস্তা।
এটুআই’র শিক্ষা বিভাগের প্রধান ফারুক বলেন, একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এখন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সুবিধা পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আরো স্কুল ও মাদ্রাসায় তাদের নিজেদের উদ্যোগে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম গড়ে তোলা দেখতে চাই। যদি একটি স্কুল তাদের নিজস্ব উদ্যোগে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম গড়ে তোলে তবে সরকার স্কুলটি গ্রামীণ এলাকায় হলে সেখানে আরো দুটি এবং শহর এলাকায় হলে আরো একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম গড়ে তোলার সহায়তা প্রদান করবে।’
তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার লক্ষে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া দ্রুততর করার উদ্যোগের সাথে যোগদানের জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিশেষ করে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান।
স্থানীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং এটুআই’র যোগাযোগ এবং পার্টনারশিপ শাখার প্রধান নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, “ভাল শিক্ষকরা প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে চান না। ফলে এসব এলাকায় মানসম্মত শিক্ষার অভাব দেখা দেয়, তবে বর্তমানে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, এখন পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত এলাকার একজন শিক্ষার্থী রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীর মতই প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল উপকরণের প্ল্যাটফর্ম শিক্ষক পোর্টালের মাধ্যমে একই ধরনের শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে।
শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষে সাধারণ, বৃত্তিমূলক ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা এই পোর্টালের সদস্য হতে পারেন এবং ডিজিটাল সামগ্রীর তৈরি বিকাশ এবং আপলোড করার অনুমতি রয়েছে।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এটুআই-এ অংশগ্রহণ করে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সমস্ত পাঠ্যবইয়ের ই-সংস্করণ তৈরি করেছে এবং সেগুলা (http://www.ebook.gov.bd) ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল এই ই-বুকের বর্তমান সংস্করণ চালু করেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, গবেষক এবং কেউ যে কোনও জায়গা থেকে ই-বই পড়তে পারেন এবং এমনকি পরে ব্যবহারের জন্য ডাউনলোড করতে পারেন। যে কেউই তাদের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট কম্পিউটার, ই-বুক রিডার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এইসব ই-বই পড়তে পারেন।
মাহমুদুল হাসানের মেয়ে নাফিসা সৌদি আরবের জেদ্দাতে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-এ ৮ম শ্রেণির ছাত্রী এবং তিনি কন্যাকে তার হোম টাস্কে সহায়তা করার জন্য ই-বুক খুব সহজেই পেয়ে যান।
হাসান বলেন, ‘এটি একটি অনেক বড় সিদ্ধান্ত যা থেকে আমাদের মতো সকল প্রবাসী শিক্ষার্থী ও তাদের পিতা-মাতা অত্যন্ত উপকৃত হচ্ছে।’
ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের সমাজের মূলধারারাদের জন্য নিয়ে আসার লক্ষে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই ধরনের একটি প্রকল্পের আওতায় স্কুলের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল টকিং বুকসহ মাল্টিমিডিয়া প্লেয়ার বিতরণ করা হয়।
এটির আবিষ্কারক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাস্কর ভট্টাচার্য, যিনি বর্তমানে ওয়েব অ্যাক্সেসিবিলিটি জাতীয় প্রকল্পের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। কম্পিউটার, ট্যাবলেট বা অ্যানড্রয়েড ফোনে অ্যাক্সেসের সাথে যে কোন শিক্ষাথী এই সফ্টওয়্যারটি বিনামূল্যে চালাতে, শুনতে বা পড়তে পারে।
এটুআই’র হিসেব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে আড়াই লাখ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত।
এটুআই’র পলিসি এডভাইজার আনির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত পাঠ্যপুস্তক টকিং বুক মাল্টিমিডিয়ায় রূপান্তরিত করেছি।’
সোশ্যাল সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের (ডিএসএস) মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবির বলেন, মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশে ২০০৯ সাল থেকে এসএমএসের মাধ্যমে এসএসসি, এইচএসসি, জেএসসি এবং পিএসসি পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে, অনলাইনে এইসব ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকেই ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৪০০ কলেজে ভর্তির জন্যও আবেদন করা যাচ্ছে।
সূত্র : বাসস