আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
সেনানিবাসের রাস্তায় ভিক্ষা করলে ভিক্ষুককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এমন আইন আসছে বাংলাদেশে। খবরটি পড়ে বিস্মিত হলাম। ভিক্ষুক দেবে ২০ হাজার টাকা জরিমানা! কিভাবে? ভিক্ষা করে? নাকি চুরি-ডাকাতি করে?
বছর দুয়েক ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভিক্ষুকমুক্ত করার কিছু উদ্যোগ লক্ষ্য করছি। এর মধ্যে ভিক্ষুকদের সমাবেশেই এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করার ঘোষণা দিতে দেখেছি উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তাকে।
দেখেছি খুলনা বিভাগকে ভিক্ষুকমুক্তকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৮২জন ভিক্ষুককে ১৯টি সেলাই মেশিন, ১০টি করে মুরগিসহ ১৬টি মুরগির ঘর, ১০৫টি ছাগল, দু’টি গরু ও ২২টি ভ্যান তুলে দেয়ার খবর। এ সব পেয়ে ভিক্ষুকরাও হাত তুলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁরা কোনোদিনই আর ভিক্ষা করবেন না।
এ সব উদ্যোগের পরও বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি আছে। সব এলাকাতেই আছে ভিক্ষুক। কোথাও কম, কোথাও হয়ত বেশি।
ভিক্ষাবৃত্তির পেছনে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ছাড়াও বিভৎস, মর্মান্তিক কিছু বাস্তবতাও থাকে। কিছু কিছু আবার সংবাদমাধ্যমের খবর হয়ে আমাদের নজর কাড়ে। কিছুদিন আগে সেরকম একটি খবর আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রবিউল ভিক্ষা করতো। তার ভিক্ষুক হওয়ার পেছনের কাহিনী জানাতে গিয়ে প্রথম আলো লিখেছিল, ‘‘গুলশানের কড়াইল বস্তিতে পরিবারের সঙ্গে থাকত শিশু রবিউল। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সে নিখোঁজ হয়। কয়েক দিন পর দুই হাত কাটা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে পাওয়া যায়। পরে ওই শিশুকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে চিকিৎসা করান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নারী কর্মকর্তা রুকসানা কামার। সেখানে রবিউলের কৃত্রিম হাত সংযোজন করা হয়। অথচ ওই রবিউলকে দিয়ে এখন রাজধানীর কাফরুল এলাকায় ভিক্ষা করাচ্ছেন তাঁর মা নাসিমা বেগম। রবিউলের কৃত্রিম হাতও খুলে ফেলা হয়েছে।” প্রতিবেদন প্রকাশের পর রবিউলকে দিয়ে আর ভিক্ষা না করানোর জন্য তার পরিবারকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত।
সেই আদেশে ছিল ভিক্ষাবৃত্তি মেনে নিতে বাধ্য হওয়া এক শিশুর প্রতি সহানুভূতি, সমবেদনা। কিন্তু সোমবার ১৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় বৈঠকে যে ‘সেনানিবাস আইন- ২০১৭’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেন, তাতে ভিক্ষুকদের জন্য রয়েছে ২০ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা। এটা কি জরিমানার নামে এক ধরনের প্রহসন?
ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনে বলা হয়েছে, ‘দেশের যে কোনো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রাস্তাঘাটে মলমূত্র ত্যাগ, মাতলামি, ভিক্ষাবৃত্তি বা জুয়া খেলার শাস্তি হিসেবে ২০ হাজার টাকা জরিমানা’ দিতে হবে। আরো কিছু অপরাধের জন্যও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। খোলা অবস্থায় মাংস বহন, অনাবৃত করে বিকলাঙ্গতা ও ব্যাধি প্রদর্শন, সেনানিবাস এলাকায় অবৈধ নির্মাণ, বেসরকারি বাজার বা কসাইখানা স্থাপন, লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা, সড়কের সরকারি ভূমি খনন, মাতলামি, আতশবাজি বা গুলি ছোড়াসহ অনেকগুলো কাজকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে মোট ২১৮টি ধারায় শাস্তিও ঘোষণা করা হয়েছে।
আইনটি অবশ্য নতুন নয়। ২৯২টি ধারা নিয়ে এ আইন ৯০ বছর আগেই প্রণীত হয়েছিল। ৯০ বছর পরে শুধু ধারা কমিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা বা জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ হাজার গুণও বেড়েছে জরিমানা। বিস্মিত হলাম জেনে যে, ভিক্ষুকদের ওপরও নামতে চলেছে ২০ হাজার টাকার জরিমানা!
অথচ সড়কের সরকারি ভূমি খনন, বেসরকারি বাজার বা কসাইখানা স্থাপন, লাইসেন্স ছাড়া বাজার বা কসাইখানা খোলা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা – এমন অনেক শাস্তিযোগ্য অপরাধের জরিমানা ভিক্ষুকের চেয়ে কম!
ভিক্ষাবৃত্তি অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভিক্ষা দেয়াও সমালোচনাযোগ্য কাজ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টার্নবুলকে তো গত বছরই ভিক্ষা দিয়ে তোপের মুখে পড়তে দেখেছি।
বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি এখনো অনস্বীকার্য বাস্তবতা। মোটা অঙ্কের জরিমানা করলেও এ বাস্তবতাকে রাতারাতি মুছে ফেলা যাবে না। বরং ভিক্ষুক হয়ত জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে ভিক্ষাকর্মে আরো বেশি করে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কেউ কেউ হয়ত ভিক্ষার টাকা ঘুষে ব্যয় করবেন। ঘুষেও জরিমানা থেকে রেহাই না পেলে অন্য পথে রোজগারের কথাও হয়ত ভাববেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মধ্যম আয়ের দেশ হবে, আর ভিক্ষুকরা কি চোর-ডাকাত হবে?
সূত্র : ভিক্ষা করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা! (ডয়েচে ভেলে)