একটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণকাণ্ডের পোস্টমর্টেম

অনুপম মাহমুদ ।।

দেশের খ্যাতনামা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। সামি, মিলা, কান্তা, জাহিদ সহপাঠী। একই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলো তারা। ক্যাম্পাসটা এতো বড় নয়, তাই সবাই সবাইকে চিনতো, জানতো। সবার ভেতরেই বেশ ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও ঘটনাচক্রে সামি ও মিলার মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ গভীরে প্রবেশ করায় অনার্সে পড়ার সময়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলো। ক্যাম্পাসেই সংসার জীবনের শুরু।

অন্যদিকে কান্তা আর জাহিদের মধ্যেও বন্ধুত্ব প্রেমের রূপ নেয়। ক্যাম্পাসের প্রেমিক প্রেমিকারা অনেকটা অসামাজিক হয়ে যায় একটা পর্যায়ে, নিজেদের ভুবনেই ডুবে থাকে তারা। কে কি করছে বা ক্যাম্পাসে কি হচ্ছে, সেটা নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? এটাই স্বাভাবিক ছিলো ক্যাম্পাসের সময়গুলোতে।

ব্রেকআপ না হলে বা হলেও কেন বা কি নিয়ে ঝামেলা, তা খুব কাছের বন্ধু ছাড়া জানার উপায় ছিলো না বাদবাকি ক্যাম্পাসবাসীদের। চারজনই পড়ালেখায় ভালো ছিলো, সামি একটু বেশিই ভালো ছিলো হয়তো। অনার্সের একেবারে শেষদিকে এসেও প্রথম ছিলো তার অবস্থান, তাই শিক্ষক হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে এগিয়েই ছিলো। আবার কান্তার শীতল নিঃশ্বাসে চাপে ছিল সামি, কারণ ও ছিলো ঠিক তার পরেই, দ্বিতীয় স্থানে।

মিলার বাবা হঠাতই অসুস্থ্ হয়ে যাওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে কিছুদিনের জন্য বিদায় নিয়ে বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। এটা এমন কোন বিষয় না যে ক্যাম্পাসে এটা নিয়ে আলোচনা হতে হবে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল। একটা গুজব এক কান দুই কান হয়ে পুরো ক্যাম্পাসকেই কাঁপিয়ে দিলো। শোনা গেলো কান্তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছে যে তাকে লাঞ্চিত করা হয়েছে। আর অভিযোগ এর তীর সোজা সহপাঠি বান্ধবীর স্বামী সামির দিকে!

পুরো ক্যাম্পাস হতভম্ব হয়ে গেলো। এটা কি করে সম্ভব? ছাত্র-ছাত্রীদের প্রগতিশীল একটা অংশ সক্রিয় হয়ে উঠলো, মৌন মিছিল হলো। সেদিন ক্যাম্পাসে এমন একটা প্রাণী ছিল না যে সেই র‍্যালিতে যায়নি। এটা একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ছিলো, আর ক্যাম্পাসেও এমন কাণ্ড আগে ঘটেনি। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একটি উপদলের সাথে সামির বেশ মাখামাখি ছিলো, তাই ছাত্র সংগঠনটি সামিকে বাঁচানোর একটা উদ্যোগ নিলো কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করে। কিন্তু আগে জানতে হবে, ঘটনাটা আসলে কি। খোঁজ শুরু হলো সামি কোথায়? ঘাপটি মেরে পরে রইলো ক্যাম্পাসের বাইরে। খুব কাছের কিছু বন্ধুর মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছানো গেলো অবশেষে।

সামির সোজা কথা, যা হবার তা দুজনের সম্মতিতেই হয়েছে। কিন্তু যেহেতু একজন ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছে, সেখানে সমাঝোতার দাবী তো ধোপে টিকবে না। তার ভাষ্য অনুযায়ী, কান্তার আহবানে সাড়া দিয়ে এক সিনিয়র ভাইয়ের ফ্ল্যাট বাড়ির চাবি নিয়ে ঘনিষ্ঠ আরেকজন বড় ভাইকে নিয়ে ঘটেছিল ছিলো এই ঘটনাটা। বড় ভাই সাক্ষী দিলেন, তাদের দুজনকে দেখে মনেই হয়নি কোন প্রকার জোর জবরদরস্তি ছিলো, বরং তারা আবারো দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো তার সামনেই নাকি। কিন্তু কথা হলো যার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর, তার সহযোগীর সাক্ষ্য এখানে গ্রহণযোগ্য হবে কি না। খুব সহজেই বলে দেয়া যায়, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। আর ক্যাম্পাসের রূপ তখন ক্রমেই রুদ্র মূর্তি ধারণ করছে, আন্দোলনকারীরা একধাপ এগিয়ে শুধু ধর্ষক নয়, তার সহযোগীদেরও শাস্তি দাবী করবে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

শেষ চেষ্টা হিসেবে সামির কাছের রাজনৈতিক বন্ধুরা গেলো ক্যাম্পাসের মধ্যে সবচেয়ে উপরে বসা চেয়ারের ব্যক্তিটির কাছে। সব শুনে বললেন, ও কি বোকা নাকি, ম্যানেজ করতে পারলো না? মেয়েটাইতো সব গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছে! বল এখন হাতেই বাইরে, আমার দ্বারা কিছুই করার নাই। আমাকে জড়িয়ো না।

অবস্থা বেগতিক আঁচ করতে পেরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটি সামির ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলে ক্যাম্পাসের আন্দোলনকে পর্যবেক্ষণে রাখলো। সামি এখন ওদের কেউ না, তার দায় নেয়ার প্রশ্নই উঠে না। সামি তার শেষ আশ্রয়স্থল হারিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলো তখন।

কান্তা তখন লোক চক্ষুর অন্তরালে, আর সে একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। আর যেহেতু সে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে, সেখানে ওটাই তার বক্তব্য এটাই ধরে নেয়া যায়। তার ছেলে বন্ধু জাহিদের অবস্থা ছিলো বজ্রাহতের মতোই স্তব্ধ। ইতিমধ্যে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সব কাগজের শিরোনাম তখন ঐ ক্যাম্পাস। অন্যদিকে মিলা ছুটে এলো ক্যাম্পাসে। কিছুতেই মানতে পারছিলো না তার স্বামীর অধঃপতন, শোনা যায় ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নিতে চেয়েছিলো। ঘনিষ্ট বান্ধবীদের প্রচেষ্টায় তাকে বাঁচানো গেলো।

তুমুল দাবীর মুখে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো, আর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কমিটি তার সুপারিশ সহ প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানায়। এমন একজনকে এই তদন্ত দলের প্রধান বানানো হয়, যার সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বময় ছড়ানো। যিনি আন্দোলনের সময় প্রকাশ্য সমাবেশে কান্তাকে তার কন্যাসম নয়, নিজের কন্যা (সহমর্মিতা বোঝাতে) বলে উল্লেখ করেছিলেন। যথাসময়ে নির্যাতিতার সাক্ষ্য নেয়া হয়। কান্তা সবিস্তারে জানায় ঘটনা। নোট শেয়ার করার নামে তাকে ফাঁদে ফেলে নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানায়। সামির দেখা পায়নি তদন্ত কমিটি।

এই ঘটনায় ক্যাম্পাসে নানা রকমের মন্তব্য, উক্তি, কটুক্তি, পক্ষে বিপক্ষে নানা মতবাদ, যুক্তি, পাল্টা যুক্তির এলোমেলো পঙ্গতিমালার কিছু ছিলো এমনঃ

– কান্তা কি বাচ্চা মেয়ে নাকি?
– আগুনের কাছে মোম গেলে আগুনের কি দোষ?
– সামি টিচার হইতে যেন না পারে, এইটা তারই একটা চক্রান্ত
– আসলে মাইয়াডাই খারাপ, তা না হইলে পোলাপাইনের মেসে যায়?
– সামি মানিকের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে।
– যত দোষ এই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর, জানে না বোঝে না আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ওরা জানেই না কাহিনী কি।
– কান্তা খারাপ হলেই কি তার সাথে এমন কিছু করতে হবে?
– রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকলে সামি এই কাজ করতে পারতো না।
– মিলা কেন সামিরে ধইরা রাখবার পারলো না?
– রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়ে ফায়দা নিচ্ছে।
– ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার ঘৃণ্য চক্রান্ত।
– মেয়েটা বোকা নাকি? আপোষ করলেই তো মান সম্মান থাকতো, এখন?
– আসলে সামির সহযোগীরা কান্তাকে ব্লেকমেইল করতে চাচ্ছিল, তাই এই ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই কান্তা সামির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নিজে বাঁচতে চেয়েছে।

উপরের সমস্ত পঙ্গতিমালায় এটা স্পষ্ট, এই ঘটনার সিংহভাগ দোষই কান্তার। ঠিক এই ঘটনাই ঘটে থাকে আমাদের দেশের প্রায় সমস্ত নির্যাতনের ঘটনায়। মেয়েটার পোশাক এলোমেলো, রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ায়, ওভার স্মার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। আইনের চোরাগলি দিয়ে বেড়িয়ে যায় নপুংশকের দল, আর আমরা আঙ্গুল তুলি ভিকটিমের দিকেই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে আবডালে ফিসফিস করে আলোচনায় সমালোচনায় একধরনের পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করি।

তদন্তে সামিকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে আজীবন বহিষ্কার করা হয় ক্যাম্পাস থেকে। আন্দোলন থেমে যায়, ক্যাম্পাস তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসে। ক্রমেই আমরা ভুলে যেতে থাকি একটি দুর্ঘটনার স্মৃতি।

লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী
সূত্র : একটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণকাণ্ডের পোস্টমর্টেম (জাগরণীয়া, ১৮ মে ২০১৭)

(দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব ঘটনা, চরিত্রের নামগুলো শুধু পরিবর্তন করা হয়েছে)

Similar Posts

error: Content is protected !!