ফাতিমা জাহান ।।
কামরূপ কামাখ্যা, নামটা যে কোনও বাঙালির খুব পরিচিত। অন্য কোনও কারণে নয়, এই জনপদ নিয়ে বিবিধ কল্পকাহিনী রয়েছে। কথিত আছে কামাখ্যা মন্দিরে ডাকিনী-যোগিনী থাকে যারা যাদু বিদ্যায় পারদর্শী। এখানে কোনও পুরুষ কোনক্রমে পৌঁছাতে পারলে তার আর নিস্তার নেই, কোনওভাবেই সে জাদু ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারেনা। সারাজীবন তার সেই সব যোগিনীদের দাস বা যৌন দাস হয়ে থাকতে হয়। আর কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে সেই মায়াপুরী থেকে বের হয়ে আসতে পারে তাহলে ফিরবে ঠিকই কিন্তু যৌবন তার কামরূপ কামাখ্যায় রেখে আসতে হবে।
এমনও অনেকের কাছে শুনেছি যে পুরুষরা অনেক সময় নিছক কৌতুহলবশত বা তন্ত্রমন্ত্র শেখার জন্য যায়। কিন্তু সেখান থেকে মন্ত্র শেখার পর বের হবার রাস্তা আর খুঁজে পায়না। বহু সাধনার পর হয়তোবা পথ খুঁজে বের হয়ে আসতে পারে কেউ তাও পারেনা। যারা বের হয়ে আসেন তারা অনেক বড় তান্ত্রিক হয়ে যান সাধনা বলে।
হিন্দুপুরানে আছে, কামাখ্যা হচ্ছে সতী বা পার্বতী আর তার স্বামী শিব দেবতার মিলিত হবার স্থান। সতীর মৃত্যু ঘটলে তার স্বামী শিবঠাকুর সতীকে কাঁধে করে নৃত্য করতে থাকেন। নৃত্যের তাণ্ডব সতীর দেহের বিভিন্ন অংশ খণ্ড খণ্ড আকারে খুলে পড়ে যায়। সতীর দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা প্রজনন অঙ্গ ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটি শহরে রয়ে যায় বা পড়ে যায়। সর্বমোট একান্নটি স্থানে সতীর দেহের অংশ রয়েছে। যার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশের চারটি স্থান বা মন্দিরেও আছে। গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির একান্ন পীঠের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পীঠ।
দিনটি ছিল বৃষ্টিমুখর। গৌহাটি বেড়াতে এসেছি আর কামাখ্যা মন্দিরে যাবনা সে কী করে হয়!
হোটেলে বসে ইন্টারনেটে উবার ট্যাক্সি বুক করলাম। যাক একা যাচ্ছিনা তাহলে। কোনও কারণে আটকা পড়লে ট্যাক্সিচালক তো আছেনই। রওনা হলাম কামাখ্যা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। যেহেতু আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল আর প্রবল বর্ষায় গা ছম ছম করছিল। ভেবেছিলাম গহীন বনের ভেতরে, অন্ধকার জনমানবহীন জায়গায় হবে এই মন্দির কিন্তু নীলাচল পাহাড়ের উপর উঠতে উঠতে চারপাশে লোকালয় চোখে পড়ল আর যাবার রাস্তাটাও পাকা, পিচ ঢালা। মন্দিরের কাছাকাছি ট্যাক্সিচালক ট্যাক্সি থামিয়ে আমাকে পায়ে হেঁটে ওপরে যেতে বলল। ট্যাক্সি থেকে নেমে পূজোর উপকরণ আর স্যুভেনিয়রের দোকানের ভিড় দেখে ভিমরি খেলাম। সব বয়সী মানুষের মিলনমেলা যেন। ভাবলাম এটা হয়তোবা বাইরের দৃশ্য ভেতরে নিশ্চয়ই ডাকিনী যোগিনীরা ওৎ পেতে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে সব বয়সী নারীপুরুষকে মন্দিরে ঢুকতে বা মন্দির থেকে বের হতে দেখলাম। প্রথমে যে দরজা পেলাম সেখান দিয়েই ঢুকলাম। ঢুকতে না ঢুকতেই একজন হাতে একটি বড়সড় থালা ধরিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড মাত্র পেয়েছিলাম ভাববার জন্য, ভাবলাম আমি তো পূজো দিতে আসিনি তবে কি এভাবেই এরা মানুষ বশ/ জাদু করে! পেছনে তাকাতে চাচ্ছিলাম দরজাটা আছে না উধাও হয়েছে দেখার জন্য তার আগেই ঝপাৎ করে কি যেন পড়ল থালায়, ওমা এ তো খাবার। লাইন ধরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করছেন। আর লাইন ধরে মন্দিরের ভক্তরা প্রসাদ নিচ্ছেন। আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে সেচ্ছাসেবীদের একজন ইংরেজিতে বুঝালেন যে এটা মন্দিরের প্রসাদ, আমি অহমীয়া ভাষায় বললাম, আমি এতক্ষণ তা বুঝতে পারিনি। প্রসাদ নয় এ যেন অমৃত, সবজি খিচুড়ি আর দু রকমের সবজি, সাথে পায়েস। আমি বোধকরি প্রথম ব্যক্তি যে ভগবানের দর্শনের পূর্বে প্রসাদ চেটেপুটে খেয়ে দর্শন করতে গিয়েছে।
পা বাড়ালাম মূল মন্দিরের দিকে। প্রবেশদ্বারে বম্ব ডিটেক্টরসহ পুলিশ প্রহরারত দেখলাম। অবশ্য ততক্ষণে আমার মনের ভয় উধাও। পেটে খেলে পিঠে সয় সে কারণেই বোধহয়।
আটশ’ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকতেই কিছু পুরুষ ভক্তের সাথে দেখা হলো, তারা রক্তিম বসনে আবৃত, লাল শার্ট, লাল লুঙ্গি আর গলায় লাল গামছা। এ মন্দিরের ড্রেসকোড বোধহয় লাল। অনেকেই লাল পরে এসেছেন। হাতের ডান দিকের মন্দিরটি সবচেয়ে পুরনো আর দেয়ালে খোদাই করা ভাস্কর্য শিব-পার্বতীর ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। অসাধারণ স্থাপত্যকলার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কামাখ্যা মন্দির। পুরানো মন্দিরটি একবার প্রদক্ষিণ করে ভেতরে যাবার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম, উদ্দেশ্য আর কিছুই নয় ডাকিনী-যোগিনীর সাক্ষাৎ লাভ। ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে সাক্ষাৎ তো পেলাম তবে কোনও তান্ত্রিক বা যোগিনীর নয় স্বয়ং মা কালির। মা কালি অবস্থান করেন এ মন্দিরে। সেবক ঠাকুররা সবই তো দেখছি পুরুষ।
দর্শন সেরে বের হলাম মানে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সফল করার জন্য। কত ধরনের মানুষের দেখাই না পেলাম সপরিবারে আসা সাধারণ ভক্ত থেকে শুরু করে পুরুষ যোগী, তান্ত্রিক কিন্তু কোথায় যোগিনী, ডাকিনীরা সব!
কৌতুহল সামলাতে না পেরে ধ্যানরত এক সাধুর পাশে বসে গেলাম। তিনি চোখ খুলতেই শুধোলাম যোগিনীদের কথা। তিনি মৃদু হেসে বললেন তিনিও তাদের দেখা পাননি। তাহলে কী সবই মায়া! না কল্পকাহিনী!
এখনকার দিনের তান্ত্রিকরা বেশ মডার্ন, হাতে স্মার্ট ফোন, কেউ কেউ ইংরেজিতে কথা বলেন। এরকম একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কিসের আশায় তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা করছেন। তিনি জবাব দিলেননা। আরেকজন বললেন, ‘সবই প্রভূর ইচ্ছায় হচ্ছে, আমি তো উপলক্ষ্য মাত্র।’ বুঝলাম এনারা কেউই সোজাসাপটা উত্তর দেবেন না।
বেশ আশাহত হলাম, যাদুবিদ্যার কিছুই না দেখে না জেনে ফিরে যাব ভেবে।
কামরূপ সম্পর্কিত কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। কামরূপ ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম, যা প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয় সীমান্তে অবস্থিত। তবে কামরূপ আসলে ছিল একটি রাজবংশ। কামরূপ রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সাল থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আসাম, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ, বিহার, ভুটান ও বাংলাদেশের কিছু অংশ জুড়ে ছিল। সংক্ষেপে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকা জুড়ে প্রসারিত ছিল কামরূপ রাজাদের রাজত্ব। ষোড়শ শতাব্দীতে অহম রাজা কামরূপ দখল করে নেয়। তবে আসাম রাজ্যের একটি জেলা এখনও সেই নাম ধারণ করে আছে।
উল্লেখ্য, কামরূপ জেলার সঙ্গে যাদুবিদ্যা বা তন্ত্রমন্ত্রের কোন সম্পর্ক নেই। তবুও নামটার কারণেই বোধহয় এত সাসপেন্সের জন্ম দিয়েছে।
আধবেলা ঘুরেফিরে যখন কোন রহস্যের সন্ধান করতে পারলামনা তখন ফিরে গেলাম। ডাকিনী যোগিনী থাকুক বা না থাকুক কামরূপ কামাখ্যা জনপদ এক ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিরপরিচিত থাকুক আমাদের কাছে।
কীভাবে যাবেন: সড়কপথে সিলেট হয়ে তামাবিল, বাংলাদেশ ভারত বর্ডার। বর্ডার পার হয়ে ট্যাক্সি করে গৌহাটি শহর যেতে লাগবে সাড়ে চার ঘন্টা। সেই ট্যাক্সি নিয়েই গৌহাটি শহরের কামাখ্যা মন্দির দেখতে যেতে পারেন। সকাল ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মন্দিরের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত। সাধারণত জুন মাসের শেষ দিকে তিনদিনের জন্য মন্দির বন্ধ থাকে তবে তখন মন্দিরের পাশে বসে আম্বুবাচী মেলা।
বিমানপথে যেতে পারেন ঢাকা থেকে কোলকাতা এবং আরেকটি ফ্লাইটে গৌহাটি। ঢাকা থেকে কোলকাতা ভ্রমন সময় প্রায় এক ঘন্টা, কোলকাতা থেকে গৌহাটি ভ্রমণকাল প্রায় দেড় ঘন্টা।
সব মানের হোটেল উপলব্ধ গৌহাটি শহরে। আর আসাম রাজ্যের মুখরোচক খাবার খেতে ভুলবেননা যেন।
সূত্র : কামরূপ কামাখ্যার রহস্যময় জনপদে (বাংলা ট্রিবিউন, ৩ জুন ২০১৭)