বাবা হুমায়ূন আহমেদের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। সেই চিঠি পড়ার সুযোগ প্রাপকের হয়নি, তবে এই লেখনী নিশ্চয়ই সব বাবা আর সন্তানের হৃদয়ে আলোড়ন তুলবে। লেখাটি ২০১২ সালে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ১৮ জুন বাবা দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রটি তাদের পাঠকদের জন্য পুনরায় ছেপেছে; এরই হুবহু প্রকাশ করা হলো আমাদের নিকলী ডটকম-এর পাঠকদের উদ্দেশে।
বাবার প্রথম অপারেশনের কিছুদিন পরে, জুলাই মাসে তাঁকে আমি একটি চিঠি লিখি। চাচা-চাচি যখন নিউইয়র্কে বাবার কাছে ছিলেন, সে সময় তাঁদের কাছে আমি চিঠিটা ই-মেইল করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, বাবার জ্ঞান ফিরে এলে তাঁরা চিঠিটি তাঁকে পড়ে শোনাবেন। কিন্তু সেটি আর হয়নি। মৃত্যুর আগে তাঁর জ্ঞান আর কখনোই পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এই চিঠিটি তাঁকে পড়ে শোনানোর সুযোগ হলো না বলে আমার ভেতরে আমি একটি গভীর শূন্যতা অনুভব করি। চিঠিটি খুবই ব্যক্তিগত; কিন্তু আমার মনে হয়, যদি অন্যেরাও এই চিঠিটি পড়েন, হয়তো আমার সেই শূন্যতা কিছুটা দূর হবে।
বাবা,
আশা করি ভালো আছ। আমি নিজে খুব ভালো অবস্থায় নেই। আমার টাইফয়েড হয়েছে। টাইফয়েডের জন্য পেটটা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। পুরো একটা সপ্তাহ ধরে শুধু চালের এক জঘন্য অরুচিকর জিনিস ছাড়া আর কিছুই খাইনি; বাংলায় যাকে সম্ভবত বলে ‘জাউ’। বিছানায় পড়ে থেকেছি, শুধু জাউ খেয়েছি; আর কল্পনায় ভেবেছি, কবে সেরে উঠব, কবে সুস্বাদু খাবারগুলো খেতে পাব। একটা সময়ে তো গলদা চিংড়ির জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, আর আমার মনে পড়ে গিয়েছিল অন্য কিছু।
যখন মায়ের সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। কারণ, আমার সব সময়ই মনে হতো, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, তুমি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু যখন তোমাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল, তখন আমি উপলব্ধি করলাম সেই দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রসায়নের ভাষায় আমি প্রত্যক্ষ করলাম একটা দহন, পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া। এক অনিবর্তনীয় প্রক্রিয়া।
আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, আমি তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাব, তুমিও আর আমাকে তোমার ছেলের মতো করে দেখবে না। বিবাহবিচ্ছেদের কয়েক দিন পরে তুমি আমাকে ফোন করলে। বললে, বিশাল সব গলদা চিংড়ি নিয়ে এইমাত্র তুমি বাজার থেকে এসেছ। বললে, তুমি ওগুলো রান্না করতে চাও, তোমার বাসায় আমার সঙ্গে বসে খেতে চাও। তুমি-আমি দুজনেই জানতাম, এটা সম্ভব হবে না। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ঘটা করে ভোজ করা যায় না। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হলো না। প্রায় আধঘণ্টা পরে ইন্টারকম বাজতে শুরু করল। গার্ড আমাকে জানাল, গেটের বাইরে আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে একটা জ্যান্ত গলদা চিংড়ি। প্রথমে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। তারপর মজা লাগল। খানিক উত্তেজনা নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। তুমি বললে, ‘বাবা, আমি খুব চাচ্ছিলাম এটা আমরা একসঙ্গে খাই। কিন্তু সেটা তো এখন সম্ভব না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, সব সময় আমি তোমার পাশে থাকব। একদিন আমরা আবার একসঙ্গে বসে ভালো খাবার খাব। কিন্তু আপাতত আমি চাই তুমি এটা খাও।’ তারপর তুমি আমার হাতে তুলে দিলে একটা জ্যান্ত গলদা চিংড়ি। পানির ফোঁটার মতো চোখ আর সরু সরু ঠ্যাংওয়ালা ওই সাংঘাতিক জীবটাকে আমার মনে হচ্ছিল আশা। এই আশা যে, যা-কিছুই ঘটুক না কেন, তুমি সব সময়ই আমার পাশে থাকার চেষ্টা করবে।
আমার মনে হয় না আমি তোমার পাশে ছিলাম, অন্তত তত পরিমাণে নয়, যতটা আমার থাকা উচিত ছিল। যখন তোমাকে আমি ফোন করতাম, প্রায়ই তুমি কথা বলার মতো অবস্থায় থাকতে না। আর যখন আমাদের কথা হতো, আমার এত খারাপ লাগত যে ভালো করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতাম না। আমি কখনোই তোমার মতো শব্দের কারিগর ছিলাম না। অস্ত্রোপচারের আগে তুমি যখন ঢাকায় ফিরে এলে, তখন তোমাকে দেখতে যাওয়া কষ্টকর ছিল। তোমার বাসায় যেতে প্রত্যেকবার গেটে বাধা পাওয়া ছিল বেদনাদায়ক। বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কোনো ছেলেরই প্রত্যেকবার নিরাপত্তাপ্রহরীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু এগুলো কোনো অজুহাতই নয়। তোমার কাছে আমার আরও বেশি বেশি যাওয়া উচিত ছিল। আমি চাই, সবকিছু বদলে যাক। আমি তোমাকে জানাতে চাই, আমি তোমাকে অসম্ভব মিস করি। তুমি জেনো, আমি যতটা তোমাকে আমার পাশে পেতে চাই, ততটা পাই না বলে আমার ভেতরটা এখনো পোড়ায়।
এই চিঠি তোমার জন্য আমার গলদা চিংড়ি।
তোমার ছেলে
নুহাশ
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র : বাবার কাছে নুহাশের চিঠি [প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০১৭]