দেশপ্রেমের জোয়ার ভাটা…

অনুপম মাহমুদ ।।

আমার বাবা যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তখন বয়েস ২৫ পেরুয়নি। সদ্য বাবা হয়েছিলেন (প্রথম সন্তানের বয়েস তখন ছয় মাস), ঘরে প্রিয়তমা স্ত্রী। আর নিজে ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। জীবনকে তুচ্ছ করে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে পিছপা হননি একটি স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষায়। নিরাপদে ঘরে ফিরবেন ভেবে কেউ যুদ্ধে যায়নি। অনেকেই ফিরে এসেছেন দেশ স্বাধীন করে, আবার অনেকেই রক্ত দিয়ে গাঢ় করেছেন সবুজের বুকে লাল সূর্যটাকে। ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ, আমাদের। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে গনিমতের মাল ভেবে সেদিন লক্ষ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম নিয়ে পৈশাচিক আনন্দে মেতেছিলো জানোয়ার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, যাদের সাথে যুক্ত ছিলো এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার।

আমার পূর্বপুরুষ যখন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন পাকিস্তানের অর্থ-অস্ত্র-রেশনে ভরপুর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মোজাহিদ আর শান্তি কমিটির পাণ্ডারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে আমাদের মা-বোনদের সেনা শিবিরে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করেছে। নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে এই সুযোগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, জেলখানায় জাতীয় চার নেতা খুন করে মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজবন্দী বানিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় মন্ত্রীত্ব থেকে শুরু করে সমাজে প্রবল প্রতিপত্তি ভোগ করেছে প্রতাপের সাথে।

১৯৪৭ সালে একটা ভ্রান্ত নীতি ও বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মের জিকির তুলে ১২০০ কিলোমিটার দূরত্বের দু’টি ভুখণ্ডকে একটি রাষ্ট্রের আওতায় আনা হয়েছিলো। যার প্রতিদান আমরা পেতে শুরু করেছিলাম কয়েক মাস পরে রাষ্ট্র ভাষার নাম করে বাংলাকে ছিনিয়ে নেয়ার একটা ষড়যন্ত্র থেকে। দেশপ্রেম বোধ করি সেদিনই আমরা প্রথম দেখেছিলাম পরাধীন বাংলায় ঢাকার রাজপথে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্র সমাজ তখন ফুঁসে উঠেছিলো। নানা চড়াই উতড়াই পার হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকেই। ভাষার জন্য জীবন দিয়ে আমরা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবো তাদের সৌজন্যে, যারা সেদিন আপোষ করেননি। আজ বিশ্বব্যাপি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

পূর্ববাংলায় আমাদের সংখ্যাও সেদিন বেশি ছিলো। ট্যাক্স আমরা কম দিতাম না, কিন্তু উন্নয়ন বঞ্চিত থেকেছি বছরের পর বছর। পূর্বের অর্থে সেদিন সমৃদ্ধ হচ্ছিল শুধুই পশ্চিম। এভাবেই প্রতারিত হতে হতে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এর পথ বেয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করেও যখন আমাদের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছিলো না, তখন আমরা বাধ্য হয়েই যুদ্ধে গিয়েছি। এটা ভুলে গেলে চলবে না, শুরুটা আমরা করিনি; বরং তারা নানা ছলা-কলায় সময় ক্ষেপণ করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা। এক রাতেই ঢাকা হয়েছিলো মৃত্যুপুরী…

কেন যেন মনে হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দেশপ্রেমে ভাটা পড়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনে ২৮৮ আসন পেয়েছিলো আওয়ামী লীগ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা ঘোষণা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রেফতার করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে গেছেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতাকে সপরিবারে। দেশপ্রেমের চূড়ান্ত ভাটা দেখা গিয়েছিলো সেদিন। যদিও কতিপয় দূরন্ত তরুণ-যুবা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলো ঠিকই, কিন্তু ঘরের শত্রু তখন বিভীষণ।

যদি খুব ভুল না করি আমাদের জাতীয় পোশাক ছিলো পুরুষদের লুঙ্গি-গেঞ্জি। যতদূর মনে পড়ে প্রাইমারি স্কুলে তাই পড়েছিলাম। এখন শুনতে পাচ্ছি ছেলেদের নাকি পায়জামা-পাঞ্জাবি, প্রিন্স কোট। মেয়েদের শাড়ি ছিলো, তাই আছে। এই সব পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে ১৯৭৫-এর পর থেকেই। তখন জাতির জনক একটা নিষিদ্ধ শব্দ। “জয় বাংলা” ভুলেই গিয়েছিলাম। পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠক হয়ে উঠেছিলাম শুধুই ঘোষক। স্বাধীনতা বিরোধীরা রাজনীতি করার সুযোগে এমপি এমনকি মন্ত্রী হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, গিয়েছে আরো উচ্চ পদে। প্রতিবাদ করতেই ভুলে যাওয়া আমরা জেগেছিলাম ১৯৯০ সালে, স্বৈরাচার এরশাদকে পদচ্যুত করতে পেরেছিলাম। আর এরপর সম্প্রতি গণজাগরণ দেখেছি শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে।

তার আগেও আমাদের অতীত ছিলো গৌরবোজ্জ্বল। আমরা মাস্টারদা সূর্যসেন-এর উত্তরসূরী। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সেই ব্রিটিশ আমলেই ছেলেদের সাথে এক হয়ে ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করেছেন। ইলা মিত্র, সেই যে তেভাগা আন্দোলনের সাঁওতালদের রানী মা, কি অমানুষিক যন্ত্রণাই না তাকে দেয়া হয়েছিলো নিরাপত্তা হেফাজতে। টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনে কুমিদিনী হাজং-এর মতো আদিবাসী নারী পর্যন্ত আমাদের পথ দেখিয়েছেন। আমরা নূর হোসেনের রক্তের উত্তরাধিকারী। ডাক্তার মিলন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজু, উত্তাল রাজপথের সেলিম দেলোয়ার। ৬৯-এর শহীদ মতিউর কিংবা আসাদ, আমরা তাদের চেতনার অনুসারী। আমাদের শহীদ রুমি বিদেশের সম্মানজনক স্কলারশীপ ফিরিয়ে দিয়ে যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে গিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহী হয়ে মামলার দায় নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছেন।

সুবিধাবঞ্চিত ভারোত্তোলক মাবিয়া বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের মূর্ছনায় কেঁদে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন দেশপ্রেম কাকে বলে। শহীদ মাতা রমা চৌধুরী খালি পায়ে হাঁটেন, মুক্তিযুদ্ধে নিহত তার সন্তান-এর কবর এই মাটির নিচে বলে। শহীদ আজাদের মা তার ছেলেকে হারিয়ে আর কখনো ভাত খাননি, কারণ তার ছেলে মায়ের কাছে একমুঠো ভাত চেয়েছিলেন। ছেলে হাজতখানার ফ্লোরে ঘুমাতো বলে নিজেও আমৃত্যু ফ্লোরেই ঘুমিয়েছেন।

কি হলো আমাদের? কিভাবে আমরা সব কিছু গুলিয়ে ফেলছি? কিভাবে আমরা আপোষ করি আমাদের রক্তের সাথে? আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে? আমার প্রতিবেশী যদি আমার বাবাকে অপমান করেন, আমি কি সেই প্রতিবেশীর নামে জয়ধ্বনি দেবো? যে নরপশু আমার মায়ের আঁচল টেনে ধরে আমি তার গুণগান গাইবো? যে পাকিস্তান আমাদের শোষণ করেছে, যুদ্ধে বাধ্য করে ত্রিশ লাখ নর-নারীকে হত্যা করেছে, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিয়েছে, বাংলাদেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মেধাশূণ্য করেছে, তাদের গান গাইতেই হবে? আমরা কি এতোটাই নিঃস্ব? আমাদের রক্ত কি পচে গেছে? নাকি ১৯৭১ সালে যে কুলাঙ্গারেরা বীর্য রেখে গিয়েছিলো এটা তারই ফসল?

জুলফিকার আলী ভুট্টোর সেই নোংরা উক্তি অনুযায়ী, দেশে কি তবে শুয়োরের বাচ্চার সংখ্যাই বেশি? আফ্রিদিকে বিয়ে করতে চেয়ে বঙ্গললনা যখন গ্যালারিতে প্ল্যা-কার্ড উঁচিয়ে ধরেন, তিনি ভুলে যান সে নিয়াজীর উত্তরসূরী। ওরা সেই মেয়েটির মা-বোনদের অসম্মান করেছেন ১৯৭১ সালে। কি মহিমা এই পাকিস্তানি জাতির? কোনো এক আড্ডায় আমি ক্ষোভ প্রকাশ করায় এক বান্ধবী বলেছিলেন, তোরা জেলাস… আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১৯৭১ সালেও কি আফ্রিদির বাপেরা এমনি ড্যাশিং ছিলো না? তাহলে সেদিন আমার পূর্বসূরিরা অকারণেই ১৯৭১ নিয়ে বাজে কথা ছড়িয়েছেন, তারা লাঞ্ছিত হননি, হয়তো উপভোগ করেছেন…

আমরা কেউ রাজনীতি থেকে দূরে নই। আমাদের জন্ম হয়েছে স্রোতের বিপরীতে, যুদ্ধ করে। যদি ধমনীতে শহীদের রক্ত থাকে, যদি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম হই, তবে কোনো ভাবেই পাকিস্তানের জয়ধ্বনি দিতে পারি না। মাতৃভূমি আর দেশ একটাই, সেটা হলো বাংলাদেশ। অন্য কোন দেশের গোলামী করি না। যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র হাতে নিতে কুণ্ঠিত হবো না। তবে এবার যুদ্ধটা সহজ হবে না, কারণ এতোদিনে দুধ-কলা দিয়ে যে কালসাপ পুষেছি, তারা এখন অনেক সংগঠিত আর বীভৎস। তারপরেও বলি, প্রয়োজনে যুদ্ধ হবে তোমাদের সাথে, আপোষ হবে না…

লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

Similar Posts

error: Content is protected !!