আহমদ আমিন (বিশেষ প্রতিনিধি), কিশোরগঞ্জ ।।
ইফতারিতে শুধু পানি, সাহরিতে শাক-ভাত। তাও কোনোদিন জুটেছে, কোনোদিন জুটেনি। এভাবেই পুরো রমজান কেটেছে হাওরের বেশিরভাগ কৃষকের। দুদিন পরেই ঈদ। অন্য বছর শিশুদের নতুন পোশাকের বায়না মধ্য রমজানেই মেটাতো কৃষক। এবার রমজান শেষ হলেও ধান হারানো কৃষক পরিবারে নতুন জামা কেনা হয়নি। ফসলহারা কৃষকের মুখে ঈদের দিন সেমাই-চিনি মুখে উঠবে কি না অজানা। ঈদের আনন্দ নেই হাওরে। এবারের ঈদটা মলিনভাবে কাটবে তাঁদের।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কিশোরগঞ্জের হাওরের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ও কৃষকদের সাথে কথা বলে এমনটাই ধারণা পাওয়া গেছে।
নিকলীর সিংপুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রাম। চৈত্রের অকাল বন্যায় এ গ্রামের অন্তত পাঁচশ’ কৃষক ধান হারিয়েছেন। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের কৃষকেরা ইন্দা-চুল্লি গ্রামে থাকেন। এ গ্রামের কৃষকদেরকে ধান হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাঁদের চোখে-মুখে এখনও অশ্রু। ধান হারানোর পর থেকেই ধারকর্জ-দাদনের ওপরে চলছে তাদের জীবন।
কাশিপুর গ্রামের কৃষক মো: ফরিদ মিয়া। সোয়া ছয় একর জমিতে তিনি বোরো ধান করেছিলেন। চৈত্রের অকাল বন্যায় সব ধান তলিয়ে গেছে। দুই ছেলে, তিন মেয়ে নিয়ে তার ৭ জনের সংসারে চালের যোগান দিতে কাজের খোঁজে এখন নরসিংদীতে আছেন। শুক্রবার কথা হয় তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগমের সাথে। জানালেন, রমজানে প্রতিবছর বাড়তি খাবারের যোগান থাকতো তাদের ঘরে। এবার রমজান পার করতে হয়েছে শাক-পাতা দিয়ে খেয়ে।
দুদিন পরে তো ঈদ, ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামা কিনেননি? এমন প্রশ্নে কেঁদে ফেললেন মরিয়ম। বললেন, ‘অন্যবার তো ১৫ রমজানের মধ্যে কাফড়-চোফর কিনা অইতো। এইবার ঘরে ভাতই নাই, পেটঅই চলে না। ফোলাফানরে নতুন কাফড় দ্যাম কী দিয়া? ফোলাফানের বাপ দনহে কাম করতো গেছে। এক টেহাও ফাঠাইতো ফারে নাই। এবার ফুরান কাফড় দিয়াই ঈদ করন লাগবো।’
ফরিদ মিয়ার মতোই ধান হারিয়ে কাজের খোঁজে বাড়ি ছেড়েছেন গ্রামের কৃষক কাজল মিয়া। স্ত্রী বিলবিছ আক্তার জানালেন, ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে তার স্বামী দুই একর জমিতে এবার বোরো চাষ করেছিলেন। এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বিলকিছ রোজা পার করছেন। দৈনিক দুই কেজি চাল লাগে তাদের। তার স্বামী যেদিন টাকা পাঠান সেদিন নগদে কিছু চাল কিনেন। বাকি দিনগুলোতে দোকান থেকে বাকিতে চাল কেনেন। ছেলে মেয়ে ও তার জন্য ঈদের কোনো পোশাক কিনতে পারেননি। পারবেন এমন সম্ভাবনাও দেখছেন না।
বিলকিছ বললেন, ‘এইবার আমরার কফাল মন্দ। নতুন কাফড়ে ঈদ করার ভাইগ্য নাই।’ গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ ইন্নছ আলী (৯০)। কিছুদিন আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর নিঃসন্তান এই বৃদ্ধর আপন বলতে আর কেউ নাই। ইন্নছ আলী জানান, ফসল হারানোর পর এই গ্রামে জাকাত-ফিতরা দেয়ার সামর্থ্যও হারিয়েছেন কৃষকেরা। অন্য বছর এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে জাকাত-ফিৎরা পেয়ে ঈদের আনন্দে শামিল হতেন তিনি। এবার সে ব্যবস্থাও নেই। ইন্নছ আলীর কণ্ঠে হতাশার সুর। বললেন, ‘কেডা জাকাত ফেরতা দিবো। হগলেই অহন গরীব অয়া গ্যাছে। যারা জাকাত ফেরতা দিতো ধান ডুইব্বা যাওনে হেরার ঘরঅই অহন খাওন নাই।’
সিংপুর ইউনিয়নের ডুবি গ্রামের কৃষক মো: ইদু মিয়া জানালেন, অকাল বন্যায় চার একর জমির ধান হারিয়ে এখন নিঃস্ব তিনি। ৭০ হাজার টাকা ঋণ আছে তার। ঘরে চাল না থাকায় মাঝে-মধ্যে সেহরি না খেয়েই রোজা রেখেছেন তিনি। ঈদে পরিবারে লোকজনের জন্য নতুন জামা কিনবেন দূরের কথা ঈদের দিন পরিবারের লোকদের মুখে সেমাই-চিনি তুলে দিতে পারবেন কিনা সে চিন্তা তার চোখে-মুখে। ইদু মিয়া বললেন, ‘ভাই এইবার আমরার ঈদ নাই। খুব কষ্টে আছি। নতুন জামা কিনবাম হেইডা তো দূরের কতা; ঈদের দিন সেমাই-টেমাই খায়াম এই টেহাও নাই।’
ডুবি গ্রামের কৃষাণি লতিফা বেগম জানালেন তার স্বামী কামরুল জামান এবার পত্তন নিয়ে ৩৩ কানি জমি করেছিলেন। ২ লাখ টাকা ঋণ আছে তাদের। ঈদে পরিবারের শিশু-সন্তানদের জন্য নতুন জামা কিনবেন এই সামর্থ্য নেই তাদের। লতিফা বললেন, “৩৩ কানি ক্ষেত গেছে গা ডুইব্বা। হের ফর থাইক্কা খায়া-না-খায়া আছি। কেই আমরারে কোনো সহযোগিতা দেয় নাই। দুই ছ্যাড়া গেছে গা বাড়িততো (বাড়ি থেকে)। ফোলাফানরে কেডা কাফড় কিইন্না দিবো।
গ্রামের কৃষক ছুবেদ ব্যাপারী জানালেন, তার ১০ কানি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এবারের রোজায় ইফতারে পানি ছাড়া কিছুই জোটেনি। শাক-পাতা দিয়ে সন্ধ্যা ও সাহরির খাবার চালিয়েছেন। মাছ কিনতে পারেননি এ রোজায়। ছুবেদ ব্যাপারির কণ্ঠে আক্ষেপ ‘অন্য বছর আমি গরীব-মিসকিনরে জাকাত-ফেরতা দিছি। এইবার ধান ডুইব্বা যাওনে আমরা ফতের ফহির অয়া গেছি। ঈদ সামনে, ফোলাফানের লাইগ্যা জামা-কাফড় কিনতারছি না। ঈদের দিন বালা-বুরা খায়াম এই আশাও নাই।’
শুধু ডুবি ও কাশিপুর গ্রাম নয়, কিশোরগঞ্জের হাওরের ধান হারানো পরিবারগুলোর এখন প্রায় একই অবস্থা। অন্যান্য বছর কৃষকরা ধান বেচে ঈদের খরচ জোগালেও এবার তার উপায় নেই।
ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করনশি গ্রামের কৃষক আদম খান জানান, ২ একর জমির এক ছটাক ধানও তিনি ঘরে তুলতে পারেননি। এখন ঈদে কেনাকাটা দূরের কথা, বাজার খরচ করতে পারছেন না। একই গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, ‘গত বছর দেড় একর জমিত একশ মণের বেশি ধান ফাইছলাম। এইবার এক সেরও ফাইনাই। ছেলেমেয়ের জন্য কাপড়-চোপড় কিছুই কিনতাম ফারছি না।’ জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুনির উদ্দিন জানান, অকাল বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় এবার হাওরের প্রায় শতভাগ কৃষকের ঘরে অভাব। তাদের ঘরে কোনো ঈদের আনন্দ নেই।