একটু উঁকি দিয়ে ঝুঁকে হাঁটতি, তাই আদর করে ডাকতাম আমরা উক্কু। আমাদের জুতোর হিল যদি আগে ক্ষয়ে যেতো, তবে তোর জন্য আগে সামনের অংশ। কথায় কথায় ঠোঁট কামড়ে আর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় কথা বলতি তুই। তোর আরেকটা নাম আছে, যা শুধু জানতাম আমরা, মানে আমাদের বাসার লোকজন। শখের বশবর্তী হয়ে আব্বা একবার বাসায় গরুর খামার গড়ে তোলেন, তো শহরে গরুর খাবার বিশেষ করে খড়ের খুব একটা সহজলভ্যতা ছিলো না। তুই যাচ্ছিলি বাসার সামনে দিয়ে। আম্মাকে দেখে স্বভাবসুলভ দাঁড়িয়ে গেলি, আর বললিঃ খালাম্মা, বন (খড় কে অনেকেই বন বলে আমাদের এলাকায়) আছে আমাদের বাসায়, আপনি কিচ্ছু চিন্তা কইরেন না, আমি আপনার জন্য বন নিয়ে আসবো। সেই থেকে তোর নামের আগে “বন” শব্দটিও যুক্ত হলো আমাদের বাসায়… যদিও তোর বন আসেনি।
আমাদের সময় মিঠু ছিলো স্কুলের ও শহরের সেরা এথলেট। হুট করে তুই স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নাম লেখিয়ে মিঠুকেও হারিয়ে দিয়েছিলি। আর সেই চমক থেমেছিলো তোর জাতীয় পর্যায়ে রেকর্ডসহ কয়েকটা মেডেল গলায় ঝুলিয়ে। নিজের প্রতি যত্ন নিলে তোর নাম বারবার উচ্চারিত হতো আজ আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে। স্কুল নয় শুধু, কলেজ পর্যন্ত ছিলো এই চর্চা, তার পর হারিয়েই গেলি।
এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকটা মাস বাকি, আমাদের স্কুলের হোস্টেলের একটা দুর্ঘটনায় তোর নাম এলো। বিশ্বাস করিনি, সরকারি স্কুলের নিয়ম তোয়াক্কা না করে তোকে বাঁচানোর জন্য ছাত্রদের নিয়ে মাঠে নামলাম, হেড স্যারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। স্যার আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, ডেকে নিয়ে বললেন কি হয়েছিলো সেদিন! বিস্মিত হয়েছিলাম, জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোকে, অস্বীকার করিসনি। নিজেকে সেদিন প্রতারিত মনে হয়েছিলো। তবে স্কুলের সুনাম ক্ষুণ্ণ যেন না হয় সেই প্রচেষ্টা থেকে পিছপা হইনি। তখন কতিপয় দুষ্ট শিক্ষক উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেছেন আমাকে বারবার, তাদের স্বরূপ জেনে গিয়েছিলাম বলেই সেদিন জেলে যাইনি। মজার বিষয় হলো, তুই-ই আমাকে প্রথম এই বিষয়টি জানিয়েছিলি পরম চতুরতায়। আর আন্দোলনে আমার পাশেই ছিলি, একবারও ভাবলি না সত্য খুব বেশিদিন চাপা থাকে না।
এসএসসির অংক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করায় ম্যাজিস্ট্রেট তোকে বহিষ্কার করেছিলো, আর সেই নোটিশ পুরো কেন্দ্রের প্রতিটি রুমে পড়ে শোনানো হয়, এটাই রীতি। উদ্দেশ্য, আমরা যেন সতর্ক হই। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কলেজে ভর্তি হয়ে গেলি আমাদের সাথেই। কিভাবে কি হলো আজো বুঝতে পারি না।
আমার সাথে তোর কোন একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতা কাজ করতো, কেন করতো জানি না। তবে কেন যেন আমাকে খোঁচা দিলে বা বিব্রত করতে পারলে বেশি খুশি হতি তুই। যেমন আমি ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বছর যখন কোথাও ভর্তি হইনি, তখন তুই আম্মা বা ছোটবোনকে পেলেই জিজ্ঞাসা করতি “অনুপম কোথায় ভর্তি হইছে?” আমি ঢাকা আর জাহাঙ্গীরনগর ছাড়া কোথাও এডমিশন টেস্ট দেইনি সে বছর। আর তুই খুব ভালো করেই জানতি সব, তার পরেও কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ নেয়ার জন্য তাই করতি। একবার রটিয়ে দিলি তুই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস, থাকিস মুজিব হলে। এমন কি আমাকেও বলেছিস। কিছুদিন পর জানা গেলো সেটা সঠিক ছিলো না।
সবচেয়ে ভুল কাজ করেছিলি তোর মার্কশিট ঘষামাজা করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের সময় মাত্র ১৭ জন আমরা ইন্টারে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। তার মধ্যে ছেলে মাত্র ৫ জন, তার ওপর ৩ জন ইমপ্রুভমেন্ট। আমি ছাড়া আর একজন কিন্তু কোনভাবেই তুই ছিলি না। আমরা একসাথেই রেজাল্ট দেখেছিলাম। হুট করেই ছড়িয়ে দিলি এবং বলে বেড়ালি তুইও ফার্স্টক্লাস পেয়েছিস। তুই ফার্স্ট ক্লাস পেলে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তুই গেলি ভুল পথে, নিজেকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। তোর মার্কশিটের কারসাজি বেশিদিন টিকেনি। তোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন করিস এসব। সেদিন দার্শনিক এর মতো উত্তর দিয়েছিলি, যা এখনো কানে বাজেঃ “একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, পিছনে কি হইছে, মানুষ সব ভুলে যায়”।
তোর ভালো অনেক গুণ ছিলো। ক্লাসে আমি সবসময় বসতাম বাম পাশের তৃতীয় সারির ডানদিকে, আর তুই আমার পাশেই। আর কেউ বসতো না, আমরা পরে আসলেও। একবার আমার এক বান্ধবীকে ক্লাসের একটা ছেলে বাজেভাবে বিরক্ত করছিলো। আমি দেখছিলাম ডানদিকে বসা বান্ধবীটি খুব উশখুশ করছিলো, জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেললো, বললো না কিছুই। পাশের বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করতেই বলছিলো, একটি ছেলে ওর পিঠে ফুঁ দিচ্ছিলো পুরো ক্লাস জুড়েই। আমি শুধু বললাম ওকে আমি মেরেই ফেলবো… আমাকে কিচ্ছু করতে হয়নি, তুই নিজেই ওকে পিটিয়ে আমার কাছে নিয়ে এলি। আরেকবার আরেক বন্ধুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নীর সাথে একটি ছেলের বদমায়েশি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। সারা কলেজ জুড়ে অমুক প্লাস তমুক, সাথে নোংরা কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ দেয়াল চিত্র। তাকে সময় দিয়েছিলাম ২৪ ঘণ্টা, মুছে এসে ক্ষমা চাইতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর ওকে হোস্টেল থেকে ধরে এনেছিলাম, আর সেদিন প্রথম কাউকে পিটিয়েছিলাম। ওকে কলেজ থেকে বের করে বলেছিলাম, আর কোনদিন ক্যাম্পাসে দেখলে হাড় ভেঙ্গে দেবো। সেদিনও তুই ছিলি আমার সাথেই।
তোর বন্ধু ভাগ্যও ভালোই ছিলো। জীবনের প্রথম প্রেমপত্র যেটা রক্ত দিয়ে লিখেছিলি, সেটা তোর নয়, মাসুদ-এর ছিলো। এমন ত্যাগ কেউ করেছে কখনো! তোর অনেক অন্যায় আবদার মিটিয়েছে বন্ধুরা, শুধু তোকে খুশি দেখার জন্য। স্কুলে পড়ার সময় তোর নামে পোস্ট অফিসে চিঠি এসেছিলো ইউএসএ থেকে ডিভি ওয়ান-এর। তোর নামের আরেকজন ভদ্রলোক আমার এলাকার বড়ভাই সেই চিঠি নিজের দাবি করে আটকে দিয়েছিলো। সে এক আজব কাহিনি। আজ তোরা দুজনেই নেই এই পৃথিবীতে…
সিলেট চলে গেলাম পড়তে, শুনেছিলাম তুই গিয়েছিস ইন্ডিয়াতে, আইন পড়ছিস। ধীরে ধীরে শহরের সাথে যোগাযোগটা কমে আসছিলো। অনেকের সাথেই কথা হতো না, দেখা হতো কেবল ঈদের ছুটিতে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের দিনরাত্রি। তোর সাথে শেষ দেখা হলো একবার ঢাকায়, বললি প্র্যাকটিস করছিস জজ কোর্টে, শুনে খুব ভালো লেগেছিলো। আরো অনেক উচ্চাকাংখা আর স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিস, কিন্তু তোর বেশ ভূষায় কেমন যেন একটা উদ্ভ্রান্তের ছাপ ছিলো। বুঝতে পারিনি সেদিন। যেদিন শুনলাম, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সারাটা জীবন তুই মিথ্যা আর অলীক কল্পনায় নিজেকে জড়িয়ে ধরে একটার পর একটা ঘটনার জন্ম দিয়েছিস। ভেবেছিস, একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, পেছনের কাহিনী কেউ ঘাঁটবে না। অথচ দেখ, কত আগেই না চলে গেলি… মরণ নেশায় আসক্ত ছিলি তুই। সূচের ফোঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করেছিস নিজেকে। অবশেষে ধনুস্টংকার কেড়ে নিলো তোকে রত্ন…
(পুরোটাই সত্য, তবে অনুরোধ করছি, দয়া করে কেউ আমার বন্ধু “রত্ন” কে খুঁজতে চাইবেন না। ও যেখানেই থাকুক, শান্তিতে ঘুমোতে দিন… এই ঈদে তোকে খুব মনে পড়েছে বন্ধু।)
লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী